অদিতির সাথে পরিচয় না হলে ঈশ্বর সৃষ্ট মানুষের যে সংজ্ঞা তার অনেক কিছুই হয়ত অজানা থেকে যেতো। বাইরে দেখা মানুষটার ভেতর যে একই রকম হয়না অদিতি তার ঐশ্বরিক প্রমান। অদিতি ভট্টাচার্য্য। বয়সে আমার চাইতে দুই বছরের বড়। লম্বা চুল আর শাড়িতে খুব সুন্দর লাগে তাকে। আকারে ছোট হওয়ায় প্রথম দেখায় ইননোসেন্ট ইননোসেন্ট মনেহয়। আমার কাছেও তাই মনে হয়েছিল। পশ্চিম বঙ্গের এই বাঙ্গালী মহিলার সাথে পরিচয় নিউ ইয়র্কে।
সদ্য পেন্সেল্ভ্যানিয়ার ফিলাডেলফিয়া হতে নিউ ইয়র্কে মুভ করেছি। ট্রান্সফার নিয়ে সেলসম্যাননের চাকরিটা ফিরে পেয়েছি এই মেগা শহরে। ডিসেম্বরের এক সন্ধ্যা। কনকনে শীত। বিরামহীন তুষারপাতে তলিয়ে গেছে শহরের সবকিছু। চাকরির প্রথম দিন। সেজেগুযে হাজির হয়েছি কর্মক্ষেত্রে। কমিশন ভিত্তিক কাজ। বিক্রি করতে পারলেই কেবল পয়সা। স্টোর ম্যানেজার পরিচয় করিয়ে দিল ডিপার্ট্মেন্ট ম্যানেজারের সাথে। লাতিনো এই মহিলা খুব আন্তরিকতার সাথে আমাকে স্বাগত জানালেন ফ্লোরে। বাঁকা হাসি দিয়ে জানালো এই বিভাগে ১২ জন মহিলার বিপরীতে কেবল ১জন পুরুষ সেল্যাসম্যান কাজ করছে।
শীতের রাত, কাস্টমার বলতে কেউ নেই। এমন আবহাওয়ায় আশাও করছেনা কেউ। আমি হাত গুটিয়ে কাউন্টারের পেছনে দাঁড়িয়ে আছি। বাইরের তুষারপাতে মুগ্ধ হচ্ছি। কর্কশ গলায় চীৎকার করে উঠল কেউ একজন। কাউন্টারের ভেতর হতে বেরিয়ে যাওয়ার কড়া নির্দেশ দিল। আমি অবাক হলাম কারণ ফ্লোর ম্যানেজার আমাকে এখানে রেখে গেছে। ম্যানেজারের উপর আরও কেউ থাকতে পারে তার আন্দাজ ছিলনা। মহিলা আর কেউ নন, অদিতি ভট্টাচার্য্য। খাঁটি ভারতীয় উচ্চারণের ইংরেজীতে বুঝিয়ে দিল কাউন্টারের কাছাকাছি আসার আমার কোন অধিকার নেই। ম্যানেজার দৌড়ে এসে পরিচয় করিয়ে দিল বাকি সবার সাথে। আমি এখানকার নতুন আগমন শুনে করোলা তিতার মত মুখ তিতা করে ফেলল অদিতি। মিন মিন করে জানালো চাকরি করি আর না করি, কাউন্টারের পেছনে এভাবে দাঁড়ানো নিয়ম বর্হিভূত।
এবং এভাবেই শুরু। প্রতিদিন কিছু একটা নিয়ে খুনসুটি করে। দফায় দফায় উপদেশ দেয়...এভাবে না, ওভাবে। এখানে না, ওখানে। আমি শুধু শুনি আর চিন্তা করি, হু দ্যা ফাঁ* সী ইজ! আমি ইচ্ছা করেই কমিশনে ঢুকতে ৭দিন সময় নেই। কটা দিন দরকার প্রোডাক্ট গুলো ভাল করে চেনার। স্টক রুমের কোথায় কোন প্রোডাক্ট সেটা জানাও ছিল জরুরি। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি... আই উইল পে ইউ ব্যাক!
উপদেশ সেশনের এক পর্যায়ে এই মহিলা জানতে চাইলেন আমি চলার মত ইংরেজি জানি কিনা। ইতিপূর্বে ২/১ জন বাংলাদেশি এখানে চেষ্টা করেও নাকি টিকতে পারেনি দুর্বল ইংরেজির কারণে। উত্তরে হাসি দিয়ে জানালাম, সময়ই বলে দেবে আমার ইংরেজির দৌড়। রুশ আমার দ্বিতীয় ভাষা। ইংরেজি তৃতীয়। রেগো পার্কের এই এলাকাটা রুশদের ঘাঁটি। তবে সপ্তাহ খানেক কাজ করার পর বুঝতে পারলাম আমার গ্রাহকদের শতকরা ৫০ ভাগই হিস্পানিক। স্প্যানিশ ভাষা এখানে মূল ভাষা। বাকি সব হাতে রেখে বিক্রয় কাজে স্প্যানিশ ভাষার যে সমস্ত বাক্য দরকার তার উপর ক্রাশ তালিম নেয়া শুরু করলাম। খুব জটিল কোন মিশন ছিলনা। মাস খানেক পর নিজকে তৈরী মনে হলো। এবং আমি বিপুল বিক্রমে নেমে পরলাম কাস্টমার শিকারে।
ইতিমধ্যে ধারণা পেয়ে গেছি অদিতি ডিপার্টমেন্টের ২য় সেরা সেলসপার্সন। তার উপর ডমিনিকান রিপাব্লিকান এক মহিলা। ওরা দুই বান্ধবী গেল প্রায় ১২ বছর ধরে এখানে রাজত্ব করছে। প্রথম যেদিন রুশ ভাষা ব্যবহার করে কাস্টমারের কাছে পণ্য ধরিয়ে দিলাম অদিতির চোখে মুখে প্রচন্ড অবিশ্বাস। চোস্ত উচ্চারণের ইংরেজির ভাণ্ডারটা একটু সময় নিয়ে খুলতে হলো। ততদিনে অদিতি বুঝে গেছে সাধারণ কোন কো-ওয়ারকার নিয়ে খেলছেনা সে। মাস না ঘুরতে সবাইকে টপকে উঠে গেলাম ১ নাম্বারে।
১২ বছরে এই প্রথম সত্যিকার চ্যালেঞ্জের মুখে পরতে হলো মহিলাকে। আমিও নাছোড়বান্দা। কোন কাস্টোমার ছাড় দিতে রাজি নই। দুই মাসের মাথায় ফ্লোরের বাকি সবাইকে নিয়ে গোপন মিটিংয়ের আয়োজন করল অদিতি। আমার কারণে নাকি বাকি কেউ কোন আয়-রোজগার করতে পারছেনা। প্রথম সাড়ির কয়েকজনকে নিয়ে গেল স্টোর ম্যানেজারের কাছে। অভিযোগ দিল আমার বিরুদ্ধে। বিগ বস ডেকে পাঠালেন। আমার বিক্রয় জাস্টিফাই করতে কোন অসুবিধা হলনা। ম্যানেজারকে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় ফ্লোরের এক্টিভিটি নজর রাখার জন্যে অনুরোধ করলাম। মহিলা সেলসপার্সনদের প্রায় সবার হয় স্বামী অথবা স্বামীর পাশাপাশি নাগর এসে ভিড় জমায় কাজে। ওখানে সময় ব্যায় করতে হয় ওদের। ফলে সাফার করে কাষ্টমারের দল। আমি ছিলাম এসবের বাইরে।
ধোপে টেকেনি অদিতির অভিযোগ। এসব অভিযোগ আমাকে আরও আগ্রাসী হতে সাহায্য করল। ইতিমধ্যে বিক্রিতে দুর্বল ২/১জন কো-ওয়ারকার ভিড়িয়ে নিলাম আমার দলে। তাদেরই একজন ছিল ত্রিনিদাদ টোবাগোর শ্যারণ। কথা প্রসঙ্গে শ্যারণ জানালো প্রতিদিন স্টোরের মুল ফটকে দাঁড়িয়ে অদিতি নাকি তার ভগবানের দরবারে প্রার্থনা করে আমার অসূস্থতার জন্যে। কিন্তু আমি অসূস্থ হইনা। বরং এই মহিলার এতদিনের হানিমুন কি করে আঁতুর ঘরে নেয়া যায় তা নিশ্চিত করতে থাকি।
থ্যাংক্স গিভিং দিবসে আমরা সবাই একে অপরের সাথে উপহার বিনিময় করি। আমিও করি। সে যাত্রায় অদিতিকে বাংলাদেশি গানের একটা সিডি উপহার দিলাম। পরের দিন সিডিটা ফেরত দিয়ে জানালো এসব গার্বেজ গান নাকি সে শোনানা। রবীন্দ্র সঙ্গিত আর প্রথম ও একমাত্র গান। অপমানটা হজম করতে একটু কষ্টই হলো। তবে তা ফিরিয়ে দিতে আমাকে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি।
অদিতির স্বামী ও তার ১৫ বছরের ছেলে কোলকাতা যাচ্ছে। সবাইকে ঘটাকরে জানালো সে। এসব আমি এক কান দিয়ে শুনি আর অন্য কান দিয়ে বের করে দেই। স্বামী সন্তান চলে চলে যাওয়ার পরদিনই আমাকে একটা প্রস্তাব দিল। জ্যাক্সন হাইটসের সিনেমা হলে ভাল একটা হিন্দি ছবি এসেছ। আমাকে নিয়ে ছবিটা দেখতে চায়। মুভির পর তার নাকি পরিচিত ভাল একটা রেস্তোরা আছে, ওখানে ডিনারেরও আমন্ত্রণ। কো-ওয়ারকারদের বাকি কেউ এমন প্রস্তাব দিলে আমি নিশ্চয় লুফে নিতাম এবং বিছানায় রাত কাটানোর সুযোগও হয়ত হাতছাড়া করতাম না (ছিলাম ব্যাচেলর)। কিন্তু এ ছিল অদিতি। ভয়াবহ চরিত্রের ভারতীয় এক মহিলা। সুযোগটা নিলাম তবে তা ছিলা প্রতিশোধের।
বিনয়ের সাথে জানিয়ে দিলাম হিন্দি আমি কম বুঝি। আর বুঝলেও ওসব বস্তাপঁচা, অবাস্তব, অলীক কাহিনীর ছবি আমি দেখিনা। আমার জন্যে এসব সময়ের অপচয়। অপমানে লাল হয়ে গেল তার গোলগাল মুখ। মোট ৬ বছর চলেছিল আমার চাকরি। আমার অত্যাচারে ইতিমধ্যে অনেকেই চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। অদিতি প্রায়ই অবসরে যাওয়ার কথা বলে। আমি শুনি আর হাসি। হাসি আর মনে মনে কল্পনা করি চাকরির প্রথম রাত!
ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের চাকরি নিয়ে সান আন্তোনিও চলে যাওয়ার কথা আগেরদিন পর্যন্ত কাউকে জানাইনি কেবল ম্যানেজার ছাড়া। অদিতিই প্রথম বলল তার চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। সবকিছু ফাইনাল। শোনার পর আমি বললাম আমার প্রস্থানের সময় ও তারিখ। অদিতি থ হয়ে গেল। দু'বছর পর নিউ ইয়র্ক বেড়াতে গিয়ে শুনেছিলাম অদিতির বিদায় পর্ব। চাকরি আগেই ছেড়ে দিয়েছিল। নতুন করে ফিরে আসার দরখাস্ত গ্রহন করেনি ষ্টোর কর্তৃপক্ষ। কারণ ওরা আর ফুলটাইম এম্পপ্লোয়ি হায়ার করেনা। আমার চৌদ্দগুষ্টি আর দেশ উদ্ধার করে লম্বা এক ভাষনের মধ্য দিয়ে শেষ করেছিল তার ক্যারিয়ার।