রাশানদের ইউক্রেইন আক্রমণ তীব্রতর হচ্ছে। ইতিমধ্যে একাধিক শহরের দখল নিয়েছে রাশিয়া। রাজধানী কিয়েভকে চারদিক হতে ঘিরে ফেলে ইতিমধ্যে স্নায়ুর যুদ্ধে নিজেদের সুবিধাজনক অবস্থায় নিয়ে গেছে।
পুতিনের যুদ্ধ পরিকল্পনা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে;
এক, ইউক্রেইনকে চাপের মধ্যে রেখে ২০১৪ সালে দখল করা ক্রাইমিয়ার এনেক্সশেসনের স্বীকৃতি পাওয়া। ঐ অঞ্চলের মালিকানা ইউক্রেইন ত্যাগ করলে পশ্চিমাদের আরোপিত অর্থনৈতিক অবরোধের কোন বৈধতা থাকবেনা।
দুই; অবরোধের মাধ্যমে ইউক্রেইনের পশ্চিম অঞ্চলকে পূর্বাঞ্চল হতে বিচ্ছিন্ন করা গেলে সাপ্লাই চেইন ব্যহত হবে। কিয়েভ সহ বাকি ইউক্রেইনে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সংকট শুরু হবে। এবং এই সংকট এক সময় দেশটার জনগণকে জালেনস্কি সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সাহায্য করবে।
তিন; একটা নির্দিষ্ট সময়ের ভেতর বর্তমান ইউক্রেইন সরকার ক্রেমলিনের দাবি মেনে না নিলে গোটা দেশের দখল নেয়া। ভিক্টর ইয়ানুকিভিচের মত পুতুলকে ক্ষমতার বসিয়ে ইউক্রেইনকে রাশিয়া-মুখী করা।
চার; উজবেকিস্তান, বেলারুশ, জর্জিয়ার মত ইউক্রেইনে মস্কোর আজ্ঞাবহ কাউকে প্রতিষ্ঠিত করা গেলে হারানো সোভিয়েত সাম্রাজ্যের ঐতিহ্য কিছুটা হলেও উদ্ধার করা সম্ভব হবে পুতিনের পক্ষে। এবং তা সাধারণ রুশ জনগণের হৃদয় জয় করে আমৃত্যু ক্ষমতায় থাকার পথ মসৃণ করবে তার জন্যে।
ইউক্রেইন সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা দেশগুলোকে অনুরোধ করছে ইউক্রেইনের আকাশকে নো-ফ্লাই জোন ঘোষণা করার জন্যে। এ ধরণের ঘোষণা দিলে ন্যাটো জোটকে তা ডিফেন্ড করতে হবে। তা না করলে ন্যাটোর কমিটমেন্টকে হাসির পাত্র করবে ঐ অঞ্চলের বাকি দেশগুলোর সামনে। ইউক্রেইনের আকাশে রুশ বিমান দেখা মাত্র গুলি করা হবে রাশানদের বিরুদ্ধে ন্যাটোর যুদ্ধ ঘোষণা করা। ন্যাটো পুতিন বাহিনীর বিরুদ্ধে সন্মুখ যুদ্ধে নামবে না এটা শুধু পুতিন না, খোদ জেলেনস্কিরও জানা আছে। দুই পারমানবিক শক্তি সম্পন্ন একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নামা মানে অল-আউট বিশ্বযুদ্ধের সূচনা।
আক্রান্ত না হলে মার্কিনীরা আগামী ১০০ বছর তৃতীয় কোন দেশে নিজেদের সৈন্য পাঠিয়ে যুদ্ধ করতে যাবে এমন সম্ভাবনা খুবই স্লিম। আফগানিস্তান হতে মার্কিনীদের লজ্জাজনক বিদায় দেশটার জনগণ এত সহজে ভুলে যাবেনা। নতুন করে এ পথে হাঁটতে গেলে হোয়াইট হাউসকে জনগণের ম্যান্ডেট নিতে হবে। মিথ্যা প্রি-টেকস্টে ইরাক আক্রমণের পর দেশের জনগণ প্রেসিডেন্টের নতুন যুদ্ধে জড়ানোর অজুহাত কোনভাবেই বিশ্বাস করবে না। তাই ইউক্রেইনে সরাসরি মার্কিন ইনভলভমেন্ট এ মুহূর্তে আউট অব কোশ্চেন।
ইউক্রেইন ন্যাটোর সদস্য নয়। তাই এই জোট নিজেদের সমরাস্ত্র নিয়ে মাঠে নামতে বাধ্য নয়। জালেনস্কিকে উপরে উঠিয়ে ন্যাটো জোটের নীচ হতে মই সরিয়ে নেয়ার তামাশা তারাই করতে পারেন যাদের সমসাময়িক বিশ্ব ব্যবস্থার উপর সম্যক জ্ঞান নেই।
ইউক্রেইন সহ সোভিয়েত ব্লকের বাকি ১৩টি দেশের স্বাধীনতায় ন্যাটোর কোন উস্কানি অথবা ভূমিকা ছিলনা। এসব দেশের স্বাধীনতা ছিল প্রায় ১০০ বছর বলশেভিকদের ডাণ্ডার শাসনের বিরুদ্ধ জনগণের বিদ্রোহের ফসল। ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন ধর্মের কোটি কোটি মানুষকে সোভিয়েত ইউনিয়ন নামের একটা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে আজীবন আটকে রাখতে পারবে এমনটা ভাবা ছিল রুশ কম্যুনিস্ট নেতা ও জেনারেলদের ভুল হিসাব। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্ময়কর উন্নতির যুগে পৃথিবী এখন একটা গ্লোবাল ভিলেজ।
রুশরা আগেও ইউক্রেইন আক্রমণ করেছে। ক্রাইমিয়া অঞ্চল দখল করে নিজদের শাসন পোক্ত করেছে। অভিযান চালিয়েছে জর্জিয়ায়। বেলারুশে বসিয়েছে নিজেদের পাপেট। কয়েক মাস আগে ওখানেও মানুষ রাস্তায় নেমেছিল আলেকজান্ডার লুকাসেনকোর বিরুদ্ধে। ঝড় উঠেছিল উজবেকিস্তানেও। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের ছত্রছায়ায় ঐ সব দেশেও ডালপালা মেলেছে স্বৈরতন্ত্র। একনায়ক ও পরিবার-তান্ত্রিক লুটপাট এখন আর ঢেকে রাখতে পারছেনা পুতিনের পাপেটরা।
স্মরণকালের ভয়াবহ অবরোধের মুখে পরেছে রুশ অর্থনীতি। বাইরে হতে দেখলে মনে হবে এ ধরণের অবরোধ পুতিনের পতন তরান্বিত করবে।
আসুন একটু ভেতরে ঢুকে দেখে আসি কেন এসব অবরোধ কাজ করবেনা।
রাশিয়া পৃথিবীর অন্যতম তেল ও গ্যাস রফতানীকারক দেশ। বিশ্ববাজারের তেলের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে রাশান তেলের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিশেষকরে ইউরোপে।
পাশাপাশি তেল উৎপাদনকারী দুই দেশ সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের সাথে রয়েছে রাশিয়ার বাণিজ্যিক লেনাদেনা। পৃথিবীর যেসব দেশ ডিক্টেটরের হাতে কুক্ষিগত তাদের প্রায় সবাই পুতিনের বন্ধু। তা ছাড়া ভারত ও চীনের মত বিলিয়ন জনসংখ্যার দেশের সাথেও আছে রাশিয়ার আদর্শিক ও ঐতিহাসিক সম্পর্ক। তাই কেবল অর্থনৈতিক অবরোধে আটকে পুতিনকে কাবু করার সম্ভাবনা এ মুহূর্তে নেই।
পুতিনকে বহির্বিশ্ব হতে আলাদা করতে চাইলে তার তেলের সাপ্লাই লাইন ছোট করতে হবে। এমনটা চাইলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তার মজুদ তেল উত্তোলন বাড়াতে হবে ব্যাপক হারে। ইরানের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা জরুরি ভিত্তিতে উঠিয়ে নিতে হবে। ভেনিজুয়েলার নিকোলাস মাদুরোর সাথে বৈরী সম্পর্কের ইতি ঘটিয়ে সে দেশের তেলও বাজারে প্রবেশ নিশ্চিত করতে হবে। সৌদি সহ মধ্যপ্রাচ্যের তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর সাথে মার্কিন সম্পর্ক ঝালাই পূর্বক উৎপাদন বাড়ানোর নিশ্চয়তা নিতে হবে।
তেল ও গ্যাস রফতানি বন্ধ করা গেলেই পুতিনের পৃথিবী ছোট হয়ে আসবে। তাকে ক্ষমতা হতে সরানোর জন্যে তখন বাইরের কোন দেশের হস্তক্ষেপ দরকার হবেনা। রুশ জনগণই সে দায়িত্ব পালন করবে।
সন্দেহ নেই সময় মত পুতিন ম্যাডনেসের ইতি টানা না গেলা পরবর্তী ভিক্টিম হবে ক্ষুদ্র দেশ মলদোভা। নিজেদের ভবিষ্যৎ আঁচ করে পেরে প্রি-বাল্টিক দেশ লাতভিয়া, লিথুনিয়া, এস্তোনিয়া এবং প্রতিবেশী পোল্যান্ড, চেক রিপাবলিক ইতিমধ্যে ন্যাটো জোটে নাম লিখিয়েছে। এসব দেশে হারানো সোভিয়েত সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের কোন সুযোগ নেই পুতিনের।
ইউক্রেইন-রুশ কনফ্লিক্ট বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের জন্যে দূরের কনফ্লিক্ট মনে হলেও এ সংঘাত খুব শীঘ্রই প্রভাব ফেলবে এসব দেশের অর্থনীতিতে। দেখার বিষয় পুতিন দীক্ষায় দীক্ষিত বাংলাদেশের ডিক্টেটর শেখ হাসিনা নিজের অবৈধ শাসনের গ্রীপ কতটা শক্ত করতে পারবেন। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিন্দা জানাতে অস্বীকার করে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে নিজের অবস্থান পরিস্কার করে দিয়েছেন পুতিনের সাগরেদ এই স্বৈরশাসক।
রুশ ইউক্রেইন যুদ্ধ অথবা সম্পর্কের তাবৎ সমীকরণ রাতারাতি বদলে যাবে যদি ২০২৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করেন।