ভ্রমণের উপর কিছু লিখতে এখন আর ইচ্ছে করেনা। কেন করেনা এর কোন কারণ নেই। হতে পারে বয়স বাড়ার সাথে অলসতা ভর করছে।
শুক্রবারে রওয়ানা দিয়ে রোববার ফিরে আসা, সর্বসাকুল্যে ১১০০ কিলোমিটার ড্রাইভ। এ ধরণের ড্রাইভ একসময় ডাল-ভাতের মত সহজ মনে হলেও এখন শরীরের উপর দিয়ে যায়। ক্লান্তি এসে চেপে ধরে।
প্রথম স্টপেজ ছিল রজওয়েল।
এলিয়েনদের নিয়ে যাদের আগ্রহ আছে তাদের কাছে অপরিচিত নয় এ শহর। নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিমের এ শহরে নাকি ১৯৪৭ সালে ভিনগ্রহের এলিয়েনদের ফ্লাইং-সসার ল্যান্ড করেছিল। এ নিয়ে অনেক কাহিনী আছে। তৈরি হয়েছে একাধিক ছায়াছবি। হয়েছে টিভি সিরিজ।
গোটা শহর জুড়ে এলিয়েনদের দাপট। রেস্তোরা হতে শুরু করে ইনস্যুরেন্স কোম্পানির বিলবোর্ডেও শোভা পায় এলিয়েনদের মূর্তি। বাচ্চাদের ডে-কেয়ারও সাজানো হয় শিশু এলিয়েনদের সামনে এনে। এক কথায়, এলিয়েন সিটি।
গেল একমাস ধরে বৈরী আবহাওয়া বিষিয়ে তুলছিল জীবন। শুক্রবার সকাল হতেই হারিয়ে যাওয়া সূর্য সান্ডিয়া পাহাড়ের ওপার হতে উকিঝুকি মারার চেষ্টা করছিল। দশটা বাজার আগেই বেরিয়ে পরি গাড়ি নিয়ে।
ফ্রীওয়ে আই-৪০ ধরে রওয়ানা দিয়ে সাউথ বাউন্ড স্টেইট ফ্রীওয়ে ২৮৫ ধরলে পৌঁছানো যায় রজওয়েল নামের এই শহরে। ততক্ষণে জীবন হতে খসে যায় একে একে ৩টা ঘণ্টা।
আই-৪০ হতে বেরুতেই রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে গেল। মাইলের পর মাইল নির্জন রাস্তা। চারদিকে বিরানভূমির মেলা। হঠাৎ হঠাৎ রেঞ্চের সাইনগুলো বলে দেয় বিশাল এই শূন্যতাকে বুকে আগলে কিছু মানুষ বাস করছে আমেরিকার বুনো পশ্চিমে। গরুর পালের বহর দেখা গেলেও কাউবয়দের দেখা নেই। হয়ত গরুর পাল রেঞ্চে ফেরানোটা বেলা শেষের কাজ, যা দ্রুতগামী গাড়ি হতে দেখা যাবেনা।
যত দক্ষিণে যাচ্ছি পাম্পে তেলের দাম ততই কমে আসছিল। নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যের তেলের খনিগুলো ওদিকেই।
মাঝপথে দুটো বিরতি নিয়ে প্রায় চার ঘণ্টা পর দিগন্তরেখায় ভেসে উঠল রজওয়েলের ছবি। ছোট মত এই শহরের বর্ণনা অনেক ওয়েস্টার্ন বই অথবা মুভিতে দেয়া আছে। হুবহু মিলে যাবে বাস্তবের সাথে।
রুক্ষ ও বৈরী আবহাওয়ার সাথে লড়াই করে টিকে থাকার নামই আমেরিকার বুনো পশ্চিম। এখানে জীবন আছে, তবে সে জীবন নদীর মত বয়ে যাওয়া পূব উপকূলের জীবনের মত নয়। এখানে জীবন মানে লড়াই।
এলিয়েন সিটির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানোর সাথে সাথে স্থানীয় চার্চ হতে বারটা বাজার ঘণ্টা বেজে উঠল। চারদিকের অবিচ্ছিন্ন নীরবতা ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল। ঘণ্টার ধ্বনী প্রতিধ্বনি ক্ষণিকের জন্যে তরঙ্গের আবহ বইয়ে মিলিয়ে গেল নির্জন প্রেইরীতে।
এমন একটা বিরতির দরকার ছিল। শরীর মন দুটোই ছিল ক্লান্ত ও বিষন্ন। একদিকে বৈরী আবহাওয়া অন্যদিকে ছোট ভাইয়ের মৃত্যু, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে কষ্ট হচ্ছিল। পেরু হতে শ্যালকের আগমন অনেকটাই বদলে দিল দৃশ্যপট। বাধ্য হয়েই রাস্তায় নামতে হয়েছিল কারণ গিন্নীকে কথা দিয়েছিলাম এবং সে অনুযায়ী সে নিশ্চিত করেছিল ভাইয়ের আগমন।
আমেরিকার বুনো পশ্চিমের নিজস্ব কিছু মাদকতা আছে যা কাছে না এলে বুঝা যায়না। এর সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকা মাইলের পর মাইল বিরাণভূমি। সাময়ের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট-বড় অসংখ্য পাহাড়। নির্মম আবহাওয়া জয় করে বেড়ে উঠা রেঞ্চ। রেঞ্চার, গরুর পাল, কাউবয়, র্যাটল স্নেইক, শেরিফ আর নির্মম বন্দুক যুদ্ধের অপর নামই বোধহয় আমেরিকান ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ওয়েস্ট। বই পড়ে অথবা মুভি দেখে পশ্চিমের সাথে পরিচিত হওয়া এক জিনিস, অন্য জিনিস কাছে এসে এর স্পন্দন অনুভব করা।
এই ওয়াইল্ড ওয়েস্টেরও কিছু ইতিহাস আছে, যার সাথে জড়িয়ে আছে দেশটায় ইউরোপীয়ান সেটলার আগমন ও ভায়োলেন্ট এক্সপানসানিজম।
নিউ মেক্সিকোর অঙ্গরাজ্যের যে শহরটায় গত ১৬ বছর ধরে বাস করছি তার চারপাশ ঘিরে বেড়ে উঠেছে আদিবাসী আমেরিকানদের আবাসভূমি। লোকাল ভাষায় যাদের বলাহয় পুয়েবলো।
দেশটার ইতিহাসের অনেক পাতা সিক্ত হয়ে আছে আদিবাসীদের রক্তে। ঝমকালো শহর ছেড়ে কিছুটা দূরে গেলেই চোখে পড়বে অন্য এক আমেরিকা যেখানে আলোর ঝলকানী নেই, নেই সম্পদের উদ্দামতা। পুয়েবলোর পরতে পরতে রাজত্ব করে অভাব, অনটন, অশিক্ষা, কুশিক্ষা। হতাশার চাদরের নীচে লুকিয়ে থাকে অন্য এক আমেরিকা। সে আমেরিকায় চলমান রাজনীতির নাম গন্ধ নেই। কাগজে কলমে প্রতিটা পুয়েবলো এক একটা মিনি আমেরিকা। ওরা মেইন আমেরিকা হতে প্রায় অনেকটাই স্বাধীন। আছে নিজেদের গভর্ণর, মন্ত্রীসভা, পুলিশ, আইন ও আদালত। তারের বেড়া দিয়ে আলাদা করে রাখে নিজদের সীমানা। ও সীমনা অতিক্রম করার স্বাধীনতা নেই সাদা অথবা কালো আমেরিকার।
সান্তা আনা ও তেসুকে নামের দুই পুয়েবলোর মন্ত্রীসভার মিটিংয়ে যোগ দেয়ার সুযোগ হয়েছিল চাকরির সুবাধে। সব বিবেচনায় ওরা শত বছর পিছিয়ে। এমন অনেক পুয়েবলো আছে যেখানে আয় রোজগা্রের একমাত্র মধ্যাম একটা ক্যাসিনো। ফ্রীওয়ে ধরে মাইলের পর মেইল ড্রাইভ করলে রেঞ্চের পাশাপাশি দিগন্তরেখায় সহসাই ভেসে উঠবে ক্যাসিনোর সাইন। সান্দিয়া, ইসলেটা, সান ফেলিপে, তেসুকে, সান ইলদেফন্সো, নাভাখো, কোমাঞ্চি...এসব কেবল কিছু নামই নয়, বরং আমেরিকান ইতিহাস ও সভ্যতার অন্ধকারময় দিক।
রজওয়েলের এলিয়েন মিউজিয়াম দেখার পর শহরটায় তেমন কিছু করার ছিলনা। স্থানীয় সামস্ ক্লাব নামের একটা স্টোরে দুপুরের খাবার খেয়ে আবারও বেরিয়ে পরি রাস্তায়। এ যাত্রায় আমাদের ঠিকানা আরও দক্ষিণের শহর কার্লসবাদ।
ইকোনোলজ নামের মোটেলটা বলতে গেলে খালিই ছিল। শনিবারের জন্যে এ ছিল অস্বাভাবিক ব্যপার। হতে পারে শীতকালটা এমনই করে পার করে দেয় স্থানীয় হোটেল ব্যবসায়ীরা। অবশ্য কোভিডের প্রভাব স্থানীয় জনগণ কাটিয়ে উঠেছে এমনটাও বলা যাবেনা।
চমৎকার পরিবেশের মোটেলটা প্রথম দেখায় পছন্দ হয়ে গেল।
নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ। আমাদের অঙ্গরাজ্যে ক্রাইমের হার অন্য যে কোন অঙ্গরাজ্যের তুলনায় বেশী। তাই নৈশ অভিযান হতে বিরত থাকার আমার প্রস্তাব বাকিরা মেনে নিল।
রাত গড়ানোর সাথে শীতের তীব্রতাও বাড়তে শুরু করল। দুদিক হতে খোলা থাকার কারণে মোটেলের রুম জমে বরফ হওয়ার উপক্রম হলো। অবশ্য সেন্ট্রাল হীটিং চালু করার সাথে কেনে গেল শীতের দাপট।
সকাল দশটার ভেতর রওয়ানা হয়ে গেলাম কার্লসবাদ ক্যাভারর্ণ ন্যশনাল পার্কের দিকে। রাস্তা আরও আঁকাবাকা, আরও জটিল হয়ে উঠে গেছে অনেক উঁচুতে। এন্ডিসের অনেক উঁচুতে উঠেছি, মুখোমুখি হয়েছি অনেক ভয়াবহতার। তবে এ যাত্রায় পার্থক্য ছিল আমার নিজের ড্রাইভ। এ এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার কিছু মুহূর্ত। গাড়িতে বাকি সবাই উপভোগ করছিল ভার্টিক্যাল জার্নি, আর আমি প্রতি মুহূর্তে অপেক্ষা করছি শেষ ঠিকানার।
কার্লসবাদ ক্যাভার্ণের পরিচিতি বিশ্বব্যাপী। প্রায় ৫০০ মিটার নীচের এ গুহার বর্ণনা দেয়ার মত ভাষা নেই আমার ভাণ্ডারে। কেবল সত্যিকার লেখক ও পরিব্রাজকদের পক্ষেই সম্ভব এমন অলৌকিক কিছুর লেখনি দিয়ে জীবন্ত করা।
দ্রুত গতির এলিভেটর দিয়ে তলানিতে থামতেই গিন্নী নিজের অসূস্থতার কথা জানান দিল। যদিও অভয় দিল খারাপ কিছু ঘটবেনা। কিছুটা দূরত্ব অতিক্রম করার পর জ্ঞান হারানোর অবস্থায় চলে গেল। পাগলের মত ছুটে গিয়ে একপ্রান্তে রেঞ্জাদের একজনকে পেলাম। দমকা বাতাসের মত ছুটে এলো ঘটনাস্থালে।
মাটির ৫০০ মিটার নীচে শুরু হল আধুনিক আমেরিকার ডিসপ্লে। একে এক ছয় জন রেঞ্জার ছুটে এল। নার্সও ছিল একজন। প্রাথমিক চেক-আপে খারাপ কিছু পাওয়া গেলনা। ওদের সন্দেহ প্যানিক এট্যাক। হুইল চেয়ারে বসিয়ে উপরে নিয়ে এলো। বাইরে বেরিয়ে একেবারে বোবা হয়ে গেলাম। মূল ফটকে অপেক্ষা করছে এম্বুলেন্স। হেলিকপ্টার ড্রাইভারকে তৈরী রাখা হয়েছে। গোটা পার্কের অর্ধেকের বেশী রেঞ্জার সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলো।
খোলা বাতাসে অনেকক্ষণ বসে থাকার পর স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এল। সীমাহীন কৃতজ্ঞায় আবদ্ধ করে রেঞ্জাররা বিদায় জানালো। আমরাও ফিরতি পথে পা বাড়ালাম।