ড্রাগ, সুন্দরী আর সাগর পারের দেশ কলোম্বিয়ায় - ৫ম পর্ব

Submitted by WatchDog on Friday, May 28, 2010

Photobucket

রোদের তীব্র ঝাঁজে মগজ গলে যাওয়ার মত অবস্থা। প্লেনের নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রার তুলনায় এ মনে হল হাশরের ময়দান যেন। উপরের দিকে না তাকিয়েই আন্দাজ করে নিলাম সূর্যটা বোধহয় মধ্যচান্দি বরাবর দুহাত উপর হতে আঘাত হানছে। ঘন্টা খানেক আগে দেখা বোগোটার সাথে এর কোন মিল খুঁজে পেলাম না। বসন্তের মৃদুমন্দ বাতাস আর চারদিকে সবুজের সমারোহ বোগোটাকে অনেকটা ইউরোপীয় শহরের মতই মনে হবে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হল আমরা একই দেশে আছি। সাতটা দিন থাকতে হবে এ শহরে। সামনের দিনগুলোর কথা ভেবে কিছুটা হতাশ হলাম। রোদের এমন কড়া মেজাজের সাথে আপোষ করতে গেলে কড়কড়ে ভাজা হয়ে ফিরতে হবে নিউ ইয়র্কে। গিন্নির ডাকে নজড় ফেরাতে মনটা অবশ্য হাল্কা হয়ে গেল। তার চোখে মুখে রাজ্যের ভাল লাগার ছোঁয়া। এ জন্যেই এতদূর আসা। সে খুশি তো আমি খুশি। আয়োজনও সার্থক।

হোটেলের বাসটাকে খুঁজে না পেয়ে একটু অবাক হলাম। লিমা হতে আমাদের মগজ ধোলাই করা হয়েছিল আয়োজনে কোন ত্রুটি থাকবে না বলে। ধোঁকা দেয়া হয়েছে ভাবতে ইচ্ছে হল না। পৃথিবীর এ অঞ্চলে ট্যুরিজম খুবই গোছানো একটা ব্যবসা, যার সাথে জড়িয়ে আছে লাখ লাখ মানুষের রুটি রুজির প্রশ্ন। ভ্রমণ প্রিয় মানুষদের স্ব স্ব দেশে আকর্ষণ করা নিয়ে গোটা দক্ষিন আমেরিকা জুড়ে চলে তীব্র প্রতিযোগিতা। কলম্বিয়া ইচ্ছে করে এ প্রতিযোগীতায় কালি ঢালবে তার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে পারলাম না। নিশ্চয় কোথাও কোন গোলমাল হয়েছে! প্রযুক্তির যুগে হারিয়ে যাওয়ার ভয় নিতান্তই ছেলেমানুষি, এমনটা বুঝিয়ে গিন্নিকে আশ্বস্ত করে চাতকের মত তাকিয়ে রইলাম এয়ারপোর্ট হতে বেরিয়ে যাওয়া আঁকাবাঁকা রাস্তাটার দিকে।

একটা নয়, একে একে তিনটা বাস এসে থামল আমাদের সামনে। বোগোটা হতে উড়ে আসা যাত্রীদের প্রায় সবাইকে দেখলাম আমাদের সংগী হতে। লাগেজ উঠানো পর্ব শেষ হল বিদ্যুৎ গতিতে। বাসে উঠে সীট নিয়ে বসতেই ক্ষমা চাওয়ার হিড়িক পরে গেল চারদিকে। ’নো হার্ড ফিলিংস’ বলে আমরাও ক্ষমা করে দিলাম। রাস্তার কাজ হচ্ছে সামনে, এয়ারপোর্ট আসার এক লেন বন্ধ এবং দেরিটা নাকি এ জন্যেই। বাংলাদেশের মানুষ আমি, ট্রাফিক জ্যামের কারণে মিনিট বিশেক দেরী ডালভাত হিসাবেই মেনে নিলাম। বাস ছাড়ার সাথে সাথে ভুলে গেলাম এসব খুচরো ঝামেলা।

অদ্ভুত সুন্দর একটা বাস। সাইজে ছোট হলেও আরামে কোন ঘাটতি নেই। একই পোশাকের ড্রাইভার, কন্ডাক্টর, হেলপারদের দেখে মনে হল কোন এক অদৃশ্য সুতায় পুতুলের মত নাচানো হচ্ছে তাদের। বোগোটায় দেখা ধারাল শরীরের মেয়েগুলোর তুলনায় সামনে বসা জৌলুস হীন মেয়েগুলোকে খুবই আনইমপ্রেসিভ মনে হল। এদের ইংরেজী বলার জ্ঞানও খুব একটা যুতসই মনে হলনা। এয়ারপোর্ট হতে বেরিয়ে মূল রাস্তায় পরতেই যাত্রীদের সবাই ব্যস্ত হয়ে পরল চারদিকের প্যানোরমা নিয়ে। শহরকে তিন দিক হতে ঘিরে রেখেছে সিয়েরা নেভাদা দ্যা সান্তা মার্তা পাহাড়ের চূড়াগুলো। খন্ড খন্ড মেঘ রাজ্যের আলসেমি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে চূড়া গুলোর কোল ঘেষে। ধোয়ার মত এক ধরনের নীল আস্তরণ পাহাড়ি প্যানোরমায় একে দিয়েছে অদ্ভুত এক প্রসন্নতা। ভেতর হতে বাইরের পৃথিবীকে নিথর নিস্তব্ধ মনে হলেও পড়ন্ত বিকেলের আকাশটাকে মনে হল প্রাণে ভরপুর। নীলের সমুদ্রে ডুবে আছে গোটা আকাশ, সাথে হরেক রকম পাখির মেলা। শহরের রাস্তাঘাট খুব একটা উন্নত মনে হল না। অনেকটা আমাদের দেশের মত। চারদিকে অযত্ন আর অবহেলার ছোয়া।

মিনিট পনেরোর ভেতর পরিবর্তন চোখে পড়ল। গাইড জানাল আমরা এসে গেছি প্রায়। শহরের পাকা রাস্তা ছেড়ে মাটির রাস্তা ধরতেই দমে গেলাম ভেতরে ভেতরে। এ কোথায় চলছি আমরা! সিকউরিটি‌ গেট পার হচ্ছি একটার পর একটা। গেটে দাঁড়ানো তামাটে চামড়ার স্থানীয় লোকগুলোকে প্রথম দৃষ্টিতে একদল রবোট বলেই মনে হবে। ভাষা নেই কারও মুখে, কথা যা বলছে তাও ইশারায়। লোহার গেট খুলেছে একটা একটা করে, আমরা ভেতরে ঢুকছি স্বশস্ত্র প্রহরীদের লম্বা স্যালুট সাথে নিয়ে। হলিউডের সায়েন্স ফিকশন ছবির মত মনে হবে চারদিকের দৃশ্যপট। মনে হবে অসৎ উদ্দেশ্যে গোপন কোন গবেষণাগারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমাদের। আরেকটু ভেতরে ঢুকতেই পরিবর্তনটা প্রকট হয়ে ধরা পরল। শেষ ফটক পার হয়ে সামান্য একটু এগিয়ে থেমে গেল আমাদের বাস। ইউনিফর্ম পরিহিত একদল যান্ত্রিক আদম হুড়মুড় করে ঘিরে ফেললো আমাদের। লাগেজগুলো নামিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করল সবাইকে। মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে গেলাম আমরা।

উঁচুমতো একটা ডিবি পার হয়ে অফিসের দোড় গোড়ায় পা রাখতেই চোখের সামনে আছড়ে পরল অবিস্মরণীয় এক দৃশ্য। ক্যারাবিয়ান সাগর।

চলবে।


ভালো লাগলে শেয়ার করুন