এই একটা বাস্তবতা চোখে পরলে ভীষন হিংসে হয়; লাতিনোদের লাইফষ্টাইল! ক্ষুধা, দারিদ্র, রোগ, অনাচার, অবিচার, ড্রাগ, সবই আছে পৃথিবীর এ প্রান্তে, কিন্তু পাশাপাশি জীবনকে উপভোগ করার আছে অন্তহীন ইচ্ছা, আছে প্রতিশ্রুতি। এ ধরনের ইচ্ছার বিরুদ্বে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না নিজ নিজ রাষ্ট্র, ধর্ম অথবা যুগ যুগ ধরে বেড়ে উঠা সাংস্কৃতি। রাষ্ট্র ও ধর্মের সাথে বিবর্তনশীল সাংস্কৃতির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কারণেই হয়ত লাতিনোদের সামাজিক জীবন পৃথিবীর অন্য যে কোন জীবনের চাইতে বেশী জীবন্ত এবং উপভোগ্য। সামরিক শাষন আর দারিদ্রের ভারে নূয্য বলিভিয়ানদেরও যেমন দেখা যায় কঠিন একটা দিনের শেষে ক্লাব, রেস্তোরা, অথবা ডিস্কোতে ছুটে যেতে, তেমনি ইকুয়েডরীয় কলা বাগানের গরীব শ্রমিকরাও দিনান্তে বেরিয়ে পরে উপভোগের সন্ধানে। কলোম্বিয়ায় এর প্রভাব আরও প্রকট, আরও বেশী লক্ষ্যনীয়। সকাল ১০টার মধ্যেই বগোটার রাস্তাঘাট পরিপূর্ণ হয়ে গেল কর্মমূখী মানুষ আর ট্যুরিষ্টদের পদভারে। বসন্তের মৌ মৌ গন্ধে বিপদজনক সুন্দরীদের উদ্দাম চলাফেরা মধ্যমগজে কেমন একটা ভোতা সূড়সূরি দিয়ে যায়, বাধ্য করে চাওয়া পাওয়ার হিসাব মেলাতে। এক 'অটোপিস্তা এল ডোরাডো' রাস্তাটাই যেন পুরো কলোম্বিয়ার কালেইডোস্কোপ; একে অপরের কোমর জড়িয়ে সন্তানাদি সহ হাটছে স্বামী স্ত্রী, মধ্যপথে চুম্বনরত প্রেমিক প্রেমিকা, হাই হীল আর মিনি স্কার্ট পরা মধ্যবয়সী সুন্দরীদের নিতম্বের দোলা, রেস্তোরা হতে উড়ে আসা B-B-Q'র ধোঁয়া, কেমন যেন নেশা ধরিয়ে দেয় লাতিন ভাললাগায়।
প্লাজ্যা দ্যা বলিভার’এ এসে থামতে হল। এটাই কলোম্বিয়ার রাজধানী বগোটার কেন্দ্রস্থল। প্রবেশমূখে ইতালিয়ান শিল্পী পিয়েতরো তেনারানীর তৈরী সাইমন বলিভারের বিশালকায় একটা ষ্ট্যাচু, দক্ষিনে প্যালেস অব জাষ্টিস, কংগ্রেস ভবন এবং পশ্চিমে ফ্রেঞ্চ ষ্টাইলে তেরী ল্যায়াভেনো বিলডিং অথবা বগোটার মেয়র অফিস। প্লাজার এদিক ওদিকে উড়ে বেড়াচ্ছে বেশ কিছু কবুতর। এক কথায় পুরানো এবং নতুনের সমাহারে চমৎকার একটা স্থাপনা যা দেখতে পৃথিবীর সব প্রান্ত হতে ট্যুরিষ্টরা ভীড় জমায়। একটা ফ্যাক্ট উল্লেখ না করলে লেখাট অসম্পূর্ন থেকে যাবে হয়ত, পুরো লাতিন আমেরিকা জুড়ে সাইমন বলিভারের প্রভাব। দক্ষিন আমেরিকার দেশ ভেনিজুয়েলা, কলোম্বিয়া, ইকুয়েডর, পেরু এবং বলিভিয়াকে স্প্যনিশ উপনেবিশবাদ হতে মুক্ত করতে ভেনিজুয়েলান এই নেটিভ অন্য এক লাতিন বীর হোসে দ্যা সান মার্টিনের সাথে মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন। ভেনিজুয়েলার বড় শহরগুলোর প্রায় সব প্লাজারই নামকরন করা হয়েছে এই বীরের নামে। সাইমন বলিভারের পুরো নাম সাইমন হোসে আন্তনিও দ্যা লা সান্তিসিমা ত্রিনিদাদ বলিভার পালাসিওস উ ব্লাংকা। ছবি তোলা এবং এলোমেলো ঘুরাফেরায় ঘন্টাখানেক সময় পার হয়ে গেল। আমাদের সময় খুবই সীমিত, তাই পরবর্তী ঠিকানা সাইমন বলিভার পার্কের দিকে পা বাড়ানোর সিদ্বান্ত নিলাম।
কিছুদূর হাটতেই রাজ্যের ক্ষুধা এসে চেপে ধরল দুজনকে। খালি পেট নিয়ে ঐতিহাসিন বিষয়বস্তূ দেখার পরিভ্রাজক আমি নই, তাই পেটের পাওনা মেটানোর তাগাদা দিলাম গিন্নীকে। মার্কিন ফাষ্ট ফুড ম্যাকডোনালড্ আর বার্গার কিং’এর ছড়াছড়ি চর্তুদিকে, কিন্তূ এতদূর এসে এসব খাওয়ার ইচ্ছা হলনা। বলতে গেলে প্রায় অভ্যাসই হয়ে গেছে, যে দেশেই যাই না কেন, স্থানীয় খাবারের স্বাদ গ্রহন আমার ভ্রমন আইটেনিনারীর অবিচ্ছেদ্য অংশ। অনেক সময় তা চোখ এবং নাক বন্ধ করে খেতে হয়, কিন্তু তাতে পিছিয়ে আসিনা। এন্ডিসের ভয়াবহ উচ্চতায় হোয়াংকা হোয়াসি নামের একটা জায়গা আছে পেরুতে। ট্রাইবাল অধ্যুষিত ঐ এলাকার খোলা আকাশের নীচে স্থানীয় খাদ্যের স্বাদ যতদিন বেঁচে থাকব স্মৃতি হয়ে বেঁচে থাকবে। পৃথিবীর অলিগলি ভ্রমনের এগুলোই হয়ত আলটিমেট প্রাপ্তি। শেষ পর্য্যন্ত পইয়্যো ল্যা ব্রাসাতেই (গ্রীলড্ চিকেন) থামতে হল সীমিত অপশনের কারণে। এই পইয়্যো ল্যা ব্রাসার রাজত্ব লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে। গ্রীলড্ মুরগীকে এত আপন করে খেতে পৃথিবীর দ্বিতীয় কোন অংশে দেখা যাবেনা। এ যাত্রায় সামান্য একটু বৈচিত্র চোখে পরল যা দক্ষিন আমেরিকার অন্য কোন দেশে চোখে পরেনি। প্রথাগত ফর্ক & নাইফের পাশাপাশি একজোড়া প্লাষ্টিকের হ্যান্ড গ্লাবস্ দেয়া হল ব্যবহারের জন্যে। হাত ব্যবহারের স্বাধীনতা পেয়ে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পরলাম বোধহয়, গিন্নী চোখের ইশারায় সেটাই বুঝিয়ে দিল। চমৎকার আবিস্কার, ভাজা মুরগী খাওয়ায় ডিসপোজেবল্ হ্যান্ড গ্লাবস্, আমার জন্যে এ ছিল কেরামতি জাহিরের মোক্ষম মুহুর্ত! আস্ত মুরগীটাকে টেনে ফানা ফানা করে ফেল্লাম মুহুর্তেই। আমার আর্ধাংগীনি মুগ্ব চোখে তাকিয়ে দেখল স্বামীর মুরগী নিধন বীরত্ব। ম্যাশ পটেটোর সাথে গ্রাবি মিশিয়ে আহার পর্ব শেষ করতেই হুশ হল, বলিভার পার্কে ফিরে যাওয়ার মত যথেষ্ট সময় নেই আমাদের হাতে। সান্তা মার্তার ফ্লাইট ধরতে এয়ারপোর্ট ফিরে যেতে হবে যথা সম্ভব দ্রুত।
এ যাত্রায় আর বাস নয়, টেক্সি ক্যাব নিতে হল অনেকটা বাধ্য হয়ে। ড্রাইভারকে বল্লাম বলিভার পার্কের চারদিকটা একটু ঘুরে যেতে। ট্যাক্সিতে বসে বগোটাকে বেশ অন্যরকম মনে হল। কলোম্বিয়ার জাতীয় পতাকার মতই শহরটাকেও মনে হল অসম্ভব রকমের হলুদ। মানুষগুলোকেও মনে হল উড়ছে। কোথায় যেন আনন্দের মেলা এবং সবাই মনের আনন্দে ছুটে যাচ্ছে সে দিকটায়।
- চলবে