পিরোজপুর-৩ আসন
সাংসদ ডা. আনোয়ারের যত 'কীর্তি-কাহিনী'
সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার আগে তিনি তো ভালো লোকই ছিলেন। নিজে চিকিৎসক, স্ত্রীও। দু'জনে মিলে এলাকার সর্বস্তরের মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে সকলের মনও জয় করেছিলেন। তারই পুরস্কার হিসেবে আওয়ামী লীগের ঐতিহ্যের বিন্দুমাত্র অংশীদার না হওয়া সত্ত্বেও গত নির্বাচনে পিরোজপুর-৩ আসনের মানুষ তাকে নির্বাচিত করেছিলেন। ভোটে জিতে একেবারে বদলে গেলেন তিনি। যেন অন্য এক মানুষ। তিনি ডা. আনোয়ার হোসেন। এলাকায় এখন তিনি সমালোচিত, নিন্দিত। দীর্ঘদিন প্রবাসে ছিলেন। ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এর আগে গুঞ্জন ছিল তিনি জাতীয় পার্টিতে যোগ দিচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে টিআর, কাবিখায় অনিয়ম, ডিসিআর বাণিজ্য, নদী বাণিজ্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আত্মীয়করণ ও প্রতিপক্ষদের ওপর হামলা ও মামলায় জড়ানোর অনেক অভিযোগ রয়েছে। তবে প্রথাসিদ্ধ ভাষায় তিনি এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, এসব দুষ্ট লোকের রটনা।
মঠবাড়িয়া বিএনপির সভাপতি দেলোয়ার হোসেন মুন্সী সমকালকে বলেন, 'আমরা তো বিরোধী দল, তাই বিরুদ্ধে বলবই। কিন্তু তার (এমপি) দুর্নীতি-অনিয়মের কথা এখন মানুষের মুখে মুখে। উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন দুলাল বলেছেন, 'দুর্নীতিতে অনার্স পেয়েছেন এমপি সাহেব। টিআর, কাবিখা, ভিজিডি, ভিজিএফের বরাদ্দ কোথায় যায়, কী হয় কেউ জানে না। তার দুর্নীতির ফিরিস্তি দিয়ে শেষ করা যাবে না।' রুহুল আমিন দুলাল বলেন, ক্ষমতায় এসেই এমপি ডা. আনোয়ার শুরু করেন বিরোধী দলকে দমন-নিপীড়ন। শুধু ২০০৯ সালেই ৩০টি মামলা করা হয়েছে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। গত ৩ বছরে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা হয়েছে শতাধিক। অভিযোগে প্রকাশ, গত ৩ বছরে মঠবাড়িয়ায় প্রকাশ্যে কোনো টেন্ডার হয়নি।
এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে এমপি ডা. আনোয়ার হোসেন বলেন, মঠবাড়িয়ায় বিএনপি মায়ের কোলে আছে। দমন-নিপীড়নের কোনো নজির এখানে নেই। কারও বিরুদ্ধে কোনো হয়রানিমূলক মামলা দেওয়া হয়নি। টিআর-কাবিখাসহ সরকারি বরাদ্দ বণ্টনে বিএনপির অভিযোগ প্রসঙ্গে এমপি ডা. আনোয়ার বলেন, বিধি অনুযায়ী সবকিছু বণ্টন হয়। কমিটির মাধ্যমে কাজ হয়।
এক সময়ে জনপ্রিয় এই মানুষটি নির্বাচনের পর কেন এত নিন্দিত হলেন তার কারণ খুঁজতে সম্প্রতি সরেজমিনে মঠবাড়িয়া ঘুরে জানা গেছে সাংসদ ডা. আনোয়ার হোসেনের ডিসিআর ও নদী বাণিজ্য, সরকারি পুকুর ভরাট, টিআর, কাবিখা বণ্টনে অনিয়ম, আত্মীয়করণ এবং দলের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টিসহ বহুবিধ অনিয়মের খবর।
ডিসিআর বাণিজ্য :মঠবাড়িয়া পৌর শহরের প্রাণকেন্দ্রে দুইশ' বছরের পুরনো তোহা বাজার। এ বাজারটি উপজেলার প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র। বাজারের যেসব খোলা স্থানে দূর-দূরান্তের রকমারি ব্যবসায়ীরা এসে দোকান সাজিয়ে বসতেন সাপ্তাহিক হাটের দিনে, সেই খোলা এবং গরুর হাটের জায়গায় ভিটি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ডিসিআরের মাধ্যমে কমপক্ষে ৮-১০ জন ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীকে ওই বরাদ্দ দিয়েছেন এমপি আনোয়ার। অভিযোগ আছে, প্রত্যেক বরাদ্দপ্রাপ্তকে জায়গা অনুযায়ী ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা দিতে হয়েছে। শুধু তোহা বাজারই নয়, উপজেলার ভগীরথপুর বাজার, বাবুরহাটসহ বড় বড় বন্দরের ভিটিও (খোলা জায়গা) মোটা টাকার বিনিময়ে এমপি তার অনুগতদের ডিসিআরের মাধ্যমে বরাদ্দ দিয়েছেন। ভগীরথপুর বাজারে ভিটি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১২০টি এবং বাবুরহাটে ৭০ থেকে ৮০টি। এ দুই বাজারে প্রতিটি ভিটি বরাদ্দের জন্য ৫০ হাজার থেকে লাখ টাকা নেওয়ার অভিযোগ আছে। এ ছাড়া গত ৩ বছরে উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের প্রত্যেকটিতে ৩৫ থেকে ৫০ জনকে ডিসিআরের মাধ্যমে সরকারি জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দপ্রাপ্তরা কেউ দলের, কেউবা এমপির ব্যক্তিগত অনুসারী। তবে বরাদ্দ পেতে প্রত্যেককেই দিতে হয়েছে 'নগদ নারায়ণ'। ২০০৮ সাল থেকে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও হাটবাজারে ৪ থেকে ৫ একর সরকারি জমি এবং এক হাজার ভিটি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এসব ভিটি বরাদ্দের মাধ্যমে এমপি এবং তার সহযোগীরা কোটি টাকার বাণিজ্য করেছেন।
ডিসিআরের মাধ্যমে ভিটি বরাদ্দের বিষয়ে এমপি ডা. আনোয়ার হোসেন মজার কথা বলেছেন, তিনি নাকি কাউকেই কোনো জমি বরাদ্দ দেননি। বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। তিনি হয়তো সুপারিশ করেছেন। ২০১০ সালের মাঝামাঝি সময়ে বঙ্গবন্ধুর নামে মার্কেট করার পরিকল্পনা নিয়ে মঠবাড়িয়া পৌর শহরের প্রাণকেন্দ্রের একটি সরকারি পুকুর ভরাট করা হয়। বিভিন্ন মহলের অভিযোগ, এমপি ডা. আনোয়ার ওই মার্কেটে স্টল বরাদ্দ দেওয়ার নামে শতাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নেন। একাধিক বরাদ্দপ্রত্যাশীরা জানিয়েছেন, তারা ২-৩ লাখ টাকা করে দিয়েছেন স্টল বরাদ্দ পেতে। পৌর শহরের মিরুখালী সড়কের মুদি ব্যবসায়ী আবুল বাশার স্বীকার করেছেন, এমপি আনোয়ারের ছোট ভাই দেলোয়ারের কাছে স্টল বরাদ্দের জন্য আড়াই লাখ টাকা দিয়েছেন। এমপি আনেয়ারের এ কোটি টাকা গোছানোর বাণিজ্য এলোমেলো করে দিয়েছেন স্থানীয় বিএনপির সহ-সভাপতি মোঃ ইউসুফুজ্জামান। তিনি পুকুর ভরাটের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করলে আদালত সেখানে স্থিতাবস্থা রাখার নির্দেশ দেন। মার্কেটের নামে অর্থ বাণিজ্যের অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যা দাবি করে ডা. আনোয়ার বলেন, কেউ যদি এ অভিযোগের প্রমাণ দিতে পারে তাহলে দশগুণ টাকা ফেরত দেব।
শ্মশানের পাশে মসজিদ : পৌর শহরের মিরুখালী সড়কে হিন্দু সম্প্রদায়ের একমাত্র শ্মশানঘাট। তার পাশেই সরকারি জায়গা দখল করে এমপি আনোয়ারের মরহুম পিতা ইসাহাক আলী হাওলাদারকে প্রতিষ্ঠাতা দেখিয়ে মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতা দিলীপ পাইক সমকালকে জানান, শ্মশানের পাশে মসজিদ নির্মাণ শুরু করা হলে এমপির কাছে গিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছি। এমপি সাহেব বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে তার ঘনিষ্ঠ আওয়ামী লীগ নেতা মনিরুজ্জামান আবুর ওপর মসজিদ নির্মাণের দায় চাপিয়ে দেন। এ ছাড়া এমপি আনোয়ার তার বাড়ির সামনে জেলা পরিষদের টাকায় মসজিদ নির্মাণ শুরু করেন। ওই মসজিদ নির্মাণের জন্য টিআর ও কাবিখা বরাদ্দ দেওয়ারও অভিযোগ আছে। জেলা পরিষদ থেকে ২৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়ার পর এমপি আনোয়ারের বাড়িতে মসজিদ নির্মাণের বিষয়টি জানাজানি হলে জেলা পরিষদ পরবর্তী বরাদ্দ বাতিল করেছে।
শ্মশানের পাশে মসজিদ নির্মাণের বিষয়ে এমপি ডা. আনোয়ার হোসেন বলেন, অতীতে ওই শ্মশানের পাশে গোরস্তান মসজিদ ছিল। এটা ৩০ বছর আগের কথা। তিনি তখন দেশের বাইরে ছিলেন। তখন কীভাবে তার বাবাকে ওই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা করা হয়েছে তা তিনি জানেন না।
নদী বাণিজ্য :মঠবাড়িয়া উপজেলার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বলেশ্বর নদে জাল ফেলার জন্য গত ৩ বছর ধরে সিরিয়াল করে দিচ্ছেন এমপি ডা. আনোয়ার হোসেন। বিনিময়ে মোটা অঙ্কের অর্থ বাণিজ্যের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। এ অভিযোগ বলেশ্বর তীরের জেলেদের। জেলেরা অভিযোগ করেছেন, তাদের বাদ দিয়ে এমপি তার ঘনিষ্ঠ দলীয় নেতাকর্মীদের নদী দখলে রাখতে জাল ফেলার লিখিত অনুমোদন দিয়েছেন। মৎস্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, এভাবে নদীতে জাল ফেলার সিরিয়াল করে দেওয়ার আইনগত বৈধতা নেই সংসদ সদস্যদের। সরাসরি সাগরের সঙ্গে সংযোগ থাকার কারণে বলেশ্বর নদ মৎস্য ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত। এ নদে মাছ ধরেন হাজার হাজার জেলে। যুগ যুগ ধরে নিজেদের নিয়মে জাল ফেলতেন জেলেরা। সমঝোতার মাধ্যমে সামনে-পেছনে জাল ফেলা হতো। কিন্তু ২০০৯ সালে বলেশ্বরে জেলেরা তাদের অধিকার হারায়। নদের কোন অংশ কে নিয়ন্ত্রণ করবে তা নির্ধারণ করে ২২ জনের তালিকা ঠিক করে দেন এমপি আনোয়ার। ২০০৯ সালের মে মাসে সিল-স্বাক্ষর দিয়ে ওই তালিকা অনুমোদন করেন তিনি। ফলে জেলেদের স্থলে বলেশ্বরের দখল চলে যায় এমপি আনোয়ারের অনুসারীদের হাতে। যারা কেউ পেশায় জেলে নন।
এ ব্যাপারে ডা. আনোয়ার সাংবাদিকদের বলেছেন, বলেশ্বরে জাল পাতা নিয়ে প্রতিবছর জেলেদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। পরস্থিতি শান্তিপূর্ণ করতেই তিনি সিরিয়ালের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তবে এ ক্ষেত্রে অর্থ বাণিজ্যের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা দাবি করে তিনি বলেন, কেউ প্রমাণ দিতে পারলে যে কোনো শাস্তি মাথা পেতে নেবেন।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আত্মীয়করণ :মঠবাড়িয়া উপজেলার অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পরিষদের নেতৃত্বে রয়েছেন এমপি ডাঃ আনোয়ার হোসেন ও তার আত্মীয়-স্বজন। মহিউদ্দিন আহম্মেদ মহিলা কলেজ, সাফা ডিগ্রি কলেজ, ধানিসাপা মাদ্রাসা ও দাউদখালী মাদ্রাসার সভাপতি এমপি নিজেই। এমপির বড় ভাই জালালউদ্দিন আহম্মেদ কেএম লতিফ ইনস্টিটিউশন, বেতমোড় আশ্রাফুল উলুম ফাজিল মাদ্রাসা ও পশ্চিম মিঠাখালী দাখিল মাদ্রাসার সভাপতি। ছোট ভাই প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদার দেলোয়ার হোসেন চিত্রা পাতাকাটা মাদ্রাসার সভাপতি। বয়োবৃদ্ধ মতিউর রহমান এমপি ডা. আনোয়ারের শ্বশুর। তিনিও পৌর শহরের উদয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি। এমপির শ্যালক বেলায়েত হোসেন পৌর শহরের মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি। এ ছাড়া এমপির দূরের কিংবা কাছের আত্মীয়স্বজনও আছেন উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে।
প্রসঙ্গ যুদ্ধাপরাধ : ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দেয়, আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত সাংসদ ডা. আনোয়ার হোসেন যুদ্ধাপরাধী। নির্বাচন চলাকালে মঠবাড়িয়ায় প্রচারিত এক লিফলেটে ডা. আনোয়ারের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তোলা হয়। ওই লিফলেটে তুলে ধরা হয় লেখক সাইদ বাহাদুরের লেখা 'গণহত্যা ও বধ্যভূমি '৭১' বইয়ের 'মঠবাড়িয়ায় গণহত্যা' অংশটি। সেখানে বলা হয়েছে, ডা. আনোয়ার হোসেন মঠবাড়িয়ায় গণহত্যায় সহযোগী ছিলেন। ২০১০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্যুনালে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন মুক্তিযুদ্ধকালীন মঠবাড়িয়ায় ভয়াল সূর্যমনি গণহত্যায় শহীদ সুধাংশু কুমার হালদারের স্ত্রী কনক বালা হালদার। অভিযোগে তিনি ডা. আনোয়ারের বিরুদ্ধে সরাসরি গণহত্যায় জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করেন। যুদ্ধাপরাধ প্রসঙ্গে এমপি ডা. আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে সমকালের সরাসরি কোনো কথা না হলেও গত ২৫ মার্চ তিনি নির্বাচনী এলাকা মঠবাড়িয়ার বড়মাছুয়ায় অনুষ্ঠিত এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে দাবি করেন, তিনি এবং তার পরিবারের কেউ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ছিলেন না। একটি কুচক্রী মহল তাকেসহ তার পরিবারকে যুদ্ধাপরাধী বানাতে চায়।
http://www.shamokal.com/