মার্চের ২৭ তারিখ, ২০০২ সাল। তরুন এক প্যালেষ্টাইনি বুকে বোমা বেধে ইস্রায়েলি শহর নেতনিয়ার পার্ক হোটেলে নিজকে উড়িয়ে দেয়। সাথে নিয়ে যায় ৩০ জন ইস্রায়েলির জীবন। দিনটা ছিল ইহুদিদের পবিত্র পাস-ওভার দিন। যারা মারা যায় তাদের প্রায় সবাই ছিল বয়স্ক ট্যুরিষ্ট। এরিয়েল শ্যারণ ঘোষণা দেন চরম প্রতিশোধের। রক্তের বদলে রক্ত নেয়ার কঠিন শপথ নেন এই জেনারেল। এর আগে তিনি ১৯৮২ সালের দক্ষিণ লেবানন অভিযানের সময় রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়ে কসাই হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।
শ্যরণ কথা দিয়ে কথা রাখেন, তাই বিশ্বের কাছে পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল কি ঘটতে যাচ্ছে প্যালেষ্টাইনের মাটিতে। পার্ক হোটেল ম্যাসাকারের দুদিন পর মার্চের ২৯ তারিখ ইস্রায়েলিরা সেনার সামরিক অভিযানে ঢুক পরে পশ্চিম তীরে। ১৯৬৭ সালের ৬ দিনের আরব-ইস্রায়েলি যুদ্ধের এটাই সবচাইতে ভয়াবহ অভিযান।ইস্রায়েলিরা এ অভিযানের নাম দেয় অপারেশন ডিফেন্সিভ সীল্ড। প্যালেষ্টাইন লিবারেশন আর্মির রামাল্লাস্থ সদর দফতর ও দলটার চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাতের কার্যালয় অবরোধ করে ফেলে ইস্রায়েলি বাহিনী। শুরুহয় প্যালেষ্টাইনিদের উপর নির্যাতনের ষ্টীম রোলার।চেয়রাম্যান আরাফতকে গৃহবন্দী করে চারদিক ট্যাংক কামান দিয়ে আটকে ফেলে রামাল্লায়।
নিউ ইয়র্কের বেইসমেন্টের রুমটায় বসে এসব দেখতে গিয়ে একসময় প্রতিজ্ঞা করি যুদ্ধের শেষ ও অবরোধের অবসান হলে চেয়ারম্যান আরাফাতকে দেখতে রামাল্লায় যাবো। পুরানো ইচ্ছাটাকে ঝালাই করে সুযোগ খুঁজতে থাকি ইস্রায়েল তথা প্যালেষ্টাইন যাওয়ার। কিন্তু সে যুযোগ আর আসেনি।
২০০৪ সালে চেয়ারম্যান আরাফাত মারা যান। তার মৃত্যুতেও আছে অনেক বিতর্ক। বলাহয় ইস্রায়েলিরা তাকে স্লো পয়জনিং করছিলো। সময় গরিয়ে অনেকগুলো বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু আমি আমার স্বপ্ন, ইচ্ছা ও প্রতিজ্ঞা হতে সরে আসিনি। গন্তব্য ইস্রায়েল হয়ে প্যালেষ্টাইন।
দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরু যাওয়ার প্লান অনেকদিনের। আমার গিন্নীর জন্মস্থান। পারিবারিকভাবে আমাদের পরিকল্পনাটা এরকম; পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ ও পেরু সফরে যাওয়া। একবছর পেরু হলে পরের বছর বাংলাদেশ। এভাবেই চলে আসছিল। বাচ্চারাও মানসিকভাবে তৈরী হচ্ছিল জুলাই'র শেষদিকে নানার দেশে যাওয়ার।
সময়টা উত্তর আমেরিকার জন্যে গ্রীষ্মকাল হলেও দক্ষিন আমেরিকায় তখন শীতকাল। পেরু সহ দক্ষিণ আমেরিকার অনেকদেশ ইতিমধ্যে আমি বহুবার গেছি। এ যাত্রায় নতুন করে যাওয়ার আগ্রাহটা হারিয়ে ফেললাম বেশকিছু কারণে। প্রথমত; ওটা আমার দেখা দেশ। নতুন কিছু দেখার নেই। দ্বিতীয়ত; ওখানে গেলে ঘরে বসেই কাটাতে হবে ছুটির এক মাস। মা আর মেয়ে মিলে শপিংয়ে যাবে আর বাসায় বসে আমি বাচ্চাদের দেখবো। মন চাইছিলো না ছুটিটা এভাবে কাটাতে।
শেষমুহূর্তে এসে আমি অস্বীকার করলাম এ যাত্রায় পেরু যাওয়ার। ওরাও অবাক হলোনা। হয়ত মনে মনে ধরে নিয়েছিল আমি যাচ্ছিনা। কারণগুলো অনেক আগেই গিন্নীকে বলেছি। তাই সে অবাক হলনা। মার্চের মাঝামাঝি ওরা চলে গেল দক্ষিনের দিকে।
আমি যথারীতি কাজে যাই। বাসায় ফিরে সময় কাটাই ভার্চুয়াল দুনিয়ায়। ধারণটা হঠাৎ করেই মাথায় এলো।এখান হতে চলে যাবো আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনাস আয়ার্সে। সপ্তাহখানেক ওখানে কাটিয়ে ফ্লাইট ধরবো আরও দক্ষিনের। একবারে মেরুর কাছের দ্বীপ ইসলাস মালভিনাস'এ। যার ইংরেজি নাম ফকল্যান্ড আইল্যান্ডস।
দ্বীপ নিয়ে বৃটিশ ও আর্জেন্টাইনদের যুদ্ধের সময় কিছুটা ধারণা পেয়েছিলাম এর বৈচিত্রতার উপর। অনলাইল গবেষণার ম্যারাথন চালিয়ে উপসংহারে আসতে বাধ্য হলাম শীতের সময়টা ওখানে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময় নয়। তাছাড়া দ্বীপের ফ্লাইট ধরতে আমাকে যেতে হবে চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে। ওখান হতে ইসলাস মালভিনাসে মাসে কেবল দুটো ফ্লাইট।
হঠাৎ করে পেরুর রাজধানী লিমায় হাজির হয়ে গিন্নী ও বাচ্চাদের অবাককরে দেয়ার প্লানটা মাঠে মারা যাওয়ায় হতাশ হলাম। টিকেট আগেই কেনা ছিল। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহেই ওরা চলে গেল। বাচ্চারা একটু অবাক। ইতিমধ্যে ওরা দুজনেই অনেকদেশ ভ্রমণ করেছে। অনেক পথ-ঘাট মাড়িয়েছে। কিন্তু কোনদিন বাবাকে ছাড়া কোথাও যায়নি।
এয়রাপোর্টে বিদায় জানাতে ওদের চোখ ছল ছল করে উঠল। বুঝতে পারলো না কি ঘটতে যাচ্ছে। মন খারাপ দুজনেরই। এক পা আগায় তো দুপা পিছনে ফিরে। এবং তাকিয়ে থাকে। সবারই মন খারাপ। তবে আমি জানতাম ভোরে লিমায় পা রাখা মাত্র যে কোলাহল শুরু হবে তাতে ক্ষণিকের জন্য হলেও ভুলে যাবে বাবার কথা। নানী, নানা, খালা, খালাতো বোনদের ভীড়ে তলিয়ে যাবে বিদায়ের বিষাদ।
ডালাস হতে কানেক্টিং ফ্লাইট। আট ঘণ্টার জার্নি। চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইলাম বর্হিগমন টার্মিনালে। হাইওয়ে ধরে বাসায় ফিরতে একধরণের হাহাকার বয়ে গেল পা হতে মাথা পর্যন্ত। গোটা বাড়িজুড়ে ভৌতিক নীরবতা। ওদের খেলনাগুলো দেখে কান্না এসে গেলো।
ঘন্টাখানেক পর ডালাস হতে ফোনে সবার সাথে কথা হলো। ওরা উপভোগ করেছে জার্নি। মন হালকা হয়ে এলো। আগামীকাল শনিবার। অফিসে যাওয়ার তাড়া নেই। অনেকদিন রাত জাগা হয়না। তাই সিদ্বান্ত নিলাম ফেলে আসা পথ ধরে আজ ফিরে যাবো সুখময় অতীতে। এবং রাত জেগে সন্ধান শুরু করবো ইস্রায়েল যাওয়ার পথ।
কেবল বৈধ কাগজপত্র ও আর্থিক সংগতি থাকলেই ইস্রায়েলের মত সমস্যাসংকুল দেশে যাওয়া যায়না। সমস্যার আগ্নেয়গিরিতে বাসকরে দেশটা। কখন সে আগ্নেয়গিরি হতে লাভা বিষ্ফোরিত হবে কেউ জানেনা। একদিকে প্যালেষ্টাইন লিবারেশন অর্গেনাইজেশন, ইসলামিক জেহাদের মত পশ্চিম তীরের সংগঠন। উত্তরে লেবাননের হেজবল্লাহ, গোলাইন হাইটসের ওপারে সংঘাতময় সিরিয়া। সবমিলিয়ে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির সাথেই হতে পারে দেশটার তুলনা।
তবে গেল ক'বছর ধরে সব ফ্রণ্টেই শুনশান নীরবতা। মাঝেমধ্যে স্যাটলারদের সাথে প্যালেষ্টাইনিদের সংঘাত সাময়িক উত্তেজনার সৃষ্টি করলেও তা অল-আউট ইন্তেফাদায় গড়ায়নি। রাজনৈতিক বাস্তবতা সহসাই পরিস্থিতি বদলে দেবে তেমন অবস্থাও ছিলনা। মনের গভীরে কিছুটা দ্বিধা থাকলেও অজানাকে জানার, অচেনাকে দেখার পুরানো ইচ্ছাটারই জয় হলো।
দুদিনের অনুসন্ধানের পর মনের মত রুট ও দামে টিকেট পাওয়া গেল।
- চলবে।