১৯৯৮ সাল। যাবাে কলকাতা-মুম্বাই। ঢাকা এয়ারপাের্ট পৌছে প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জে দেখি আমার চেনা চমৎকার এক যুবতী, বয়স ছাব্বিশ-সাতাশ। শাদা কাপড়ের স্কিনটাইট প্যান্টের ওপর হাল্কা গােলাপি রঙয়ের স্লিভলেস টাইট গেঞ্জি পরা, দুটো বােতামই খােলা। উন্নত বুক দৃষ্টি কেড়ে নেয় প্রথম দেখাতেই। কপালে সানগ্লাস, পায়ে পেন্সিল হিল স্যান্ডাল সু। তার ডাগর চোখ যেন না বলা সব কথা বলে দেয় প্রথম দর্শনেই। ফোলা ফোলা দুই গালে সামান্য হাসলেই টোল পড়ে। সামান্য মােটা ঠোট আবেদনময়ী। বাড়তি কিছু প্রসাধনী সৌন্দর্যকে কিছুটা উৎকট করেছে কিন্তু আকর্ষণ বেড়েছে হাজার গুণ।
তার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছি না। মনে করতে পারছি না কে সে, কেন তাকে এতাে আপন মনে হয়। বার বার স্মৃতির পাতা রিওয়াইন্ড করছি, হদিস করতে পারছি না। তাকে ইশারায় হ্যালাে বলতেই সে হেসে প্রতিউত্তর দিল ।
সব বয়সের যাত্রীর নজর তার দিকে। আমিও নানান সুযােগে তাকে দেখতে লাগলাম। কথা বলার সুযােগ খুজতে লাগলাম। তাকে চিনতে না পারলেও আমাকে হয়তাে চিনবে সে আশায় তার দৃষ্টি আকর্ষণের ব্যর্থ চেষ্টা করছি। | স্লিভলেস গেঞ্জি ঠেলে তার উদ্ধত বুকের নিপল উকি দিচ্ছে যা সহজেই দৃষ্টিগােচর হচ্ছে। শাদা প্যান্টের নিচে আকর্ষণীয় হিপের উপর প্যান্টির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। আমি চোখ ফেরাতে পারি না।
চোখের দৃষ্টিতে তার বাহ্যিক সৌন্দর্য দেখছি আর মনের এক্সরে দিয়ে শরীরের আবৃত লােভনীয় অংশ নিয়ে গবেষণা করছি। সবাই তার শরীরের অনাবৃত বিশেষ জায়গাগুলাে দেখছে হা করে। আমার খুব রাগ হচ্ছে। মনে হয়, তার সব কিছু একমাত্র আমিই দেখবাে, অন্যদের তাকানােও অন্যায়।
তার প্রতি আমার রাগও হচ্ছে এই শীতের মধ্যেও কেন সে স্লিভলেস গেঞ্জি পরেছে। যদি সােয়েটার পরতো তবে হয়তাে সবাই এমন করে তাকাতাে না। তাকে আকর্ষণীয় লাগে বুঝেই এই আটসাট ড্রেস পরেছে। | বিমান যথানিয়মে এক ঘণ্টা লেট। আমার খারাপ লাগছে না। মনে মনে খুশি হলাম, এ সুন্দরীকে আরাে কিছু সময় কাছ থেকে দেখতে পাবাে সেই আশায়। জানি না কোন দেশে উড়াল দেবে এই ললনা। কারণ আমার যাত্রার সময়ের কাছাকাছি আরাে দুটো প্লেন দাড়িয়ে আছে – থাই ও সউদি এয়ারলাইন্সের।
যখন বাের্ডিং কার্ড সংগ্রহের ঘােষণা এলাে লক্ষ্য করলাম সেও হাতের ব্যাগটা নিয়ে বিমানের কাউন্টারের দিকে যাচ্ছে। তার পাশাপাশি দাড়াতে চেষ্টা করে ফেল মারলাম। আমি হলাম আজন্মের পােড়া কপাইল্লা। তার থেকে দশ বারােজন পেছনে। তার শরীরের ঘ্রাণ নেয়া হলাে না । বিমানে ওঠার সময়ও তার কাছাকাছি হতে পারলাম না। আমার থেকে সে প্রায় পঞ্চাশ ষাটজন। পেছনে। হতাশ মনে বিমানে আমার আসনের সামনে ব্যাগ হাতে দাড়িয়ে আছি। তাকে আবারও কাছ থেকে দেখার সুযােগ হবে যদি তার আসন আমার পেছনে হয় তবে আমাকে ক্রস করে তাকে যেতে হবে। রেডি হয়ে আছি যখন সে আমাকে ক্রস করবে তখন উপরে লাগেজ বক্সে লাগেজ রাখার ভান করে তার শরীরের স্পর্শ নেবাে। কিন্তু এক কেহেরমান টাইপের লােক আমার ব্যাগ নিয়ে দাড়িয়ে থাকায় বিরক্ত হয়ে প্যাসেজ ছেড়ে সিটে বসতে বললেন। ওই যাত্রী হয়তাে ভেবেছেন তার স্ত্রীকে দেখার জন্য সেখানে দাড়িয়ে আছি। বসে আছি, তার দেখা নেই। হয়তাে সামনে বসেছে অথবা এক্সিকিউটিভ ক্লাসের যাত্রী। হতাশায় আমার বুকটা ভেঙে যাচ্ছে।
এমন সময় সে এলাে এয়ারহস্টেসের সঙ্গে হাসতে হাসতে। একদম সামনে, আমার পাশে দাড়িয়ে দুহাত তুলে লাগেজ বক্সে তার লাগেজ রাখছেন। তার সুর মসৃণ শেভ করা দুবগল বাহু দেখতে পাচ্ছি। দুহাত উপরে তােলায় তার প্যান্ট ও গেঞ্জির মাঝখান থেকে তার অপূর্ব সুন্দর নাভি-পেট দেখে আমি উত্তেজনায় সপ্তমে পৌছে গেছি। জানি না সে কোন সিটে বসবে। আমার কাছাকাছি বেশ কয়েকটা সিট এখনাে ফাকা। আমাকে হতবাক করে আমার পাশের সিটেই বসলাে এয়ারহস্টেসের সহায়তা ছাড়াই। উত্তেজনা আর আবেগে কাপছি, ঘেমে যাচ্ছি। সে খুব সুন্দর করে ইংরেজিতে অনুরােধ করলাে জানালার পাশের সিট বদল করার। এক বাক্যে রাজি হলাম।
সিট ছেড়ে দেয়া তাে সামান্য ব্যাপার। ক্ষমতা থাকলে বিমানের সব যাত্রী নামিয়ে দিয়ে সারা জীবন তােমায় নিয়ে আকাশে ভাসতাম। সাধ্য থাকলে পুরাে বিমানটি তােমায় দিয়ে দিতাম, সঙ্গে বলাকা ভবন বােনাস!
বসে আছি তার পাশে, যাকে আমি দুঘণ্টা ধরে কামনা করছিলাম। আমার দিকে অনেক যাত্রী হিংসুটে দৃষ্টি দিচ্ছে তা অনুভব করছি। তার সঙ্গে কথা বলার সুযােগ খুজছি। সে তার ব্যাগ থেকে সিটি অফ জয় বের করে মনােযােগ সহকারে পড়ছে। ভাবখানা এমন, কাল যেন তার এসএসসি পরীক্ষা শুরু হবে। পাশে আমার উপস্থিতি সে ভুলেই গেল অথচ তাকে খুশি করতে আমার সিট ছেড়ে দিয়ে কি আত্মত্যাগটাই না স্বীকার করলাম! সুন্দরী মেয়েরা একটু অকৃতজ্ঞ হয় মনে করে নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম।
এয়ারহস্টেস হালকা নাশতা দিয়ে তাকে বিশেষ খাতির করলেন সে কিছুই নিল না। নিজ ব্যাগ থেকে চুয়িং গাম বের করে খুব কসরৎ করে চুষতে লাগলাে। তখন নিজেকে চুয়িং গাম ভাবতে ভালাে লাগছিল। আশপাশের যাত্রীরা তাকে দেখার জন্য বিভিন্ন রকমের কসরৎ করছেন তা টের পেয়ে যতােটা সম্ভব তাকে আড়াল করে রাখি শুধু একা দেখবাে বলে।
এবার এয়ারহস্টেস এমবারকেশন ফরম পূরণ করার জন্য সবার সামনে সরবরাহ করলেন। আমি ওৎ পেতে আছি ফরম পূরণ করার সময় তার পরিচয় জানার জন্য। সে তার কোমরের বেল্ট থেকে ইনডিয়ান পাসপাের্ট বের করলাে। সুযােগ পেয়ে বললাম, ইনডিয়ান সিটিজেনদের ওই ফরম পূরণ করার প্রয়ােজন নেই।
সে ভ্রু নাচিয়ে গালে টোল ফেলে শুধু হাসলাে, আমার বুকের মধ্যে ঢেউ খেলে গেল। সে পাসপাের্ট খুলে ফরম পূরণ করতে লাগলাে। লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে তার দিকে ঝুঁকে পড়ে দেখলাম নাম লেখা শতাব্দী রয়, এক্ট্রেস।
চিৎকার করে বলে উঠলাম, আপনি শতাব্দী রায়? (বর্তমানে প্রচারিত ক্লিয়ার শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপনের মতাে, তুমিই শাহেদ? টাইপের)।
অবচেতন মনেই শতাব্দীর হাত ধরে কথা বলছি। তিনি একটু অপ্রস্তুত হলেন এবং বেশ জোরে হাসলেন ।
হ্যা, এই তাে শতাব্দী রায়, হাসলেই গালে টোল পড়ে, সামান্য দাতের মাঢ়ি বের হয়। আমার উচুস্বরের কথা শুনে এবং উৎফুল্লতা দেখে শতাব্দী সামান্য বিব্রত হলেও বিরক্ত হননি। পাশাপাশি সিটের যাত্রীরা আমাদের দেখছেন।
এক নিঃশ্বাসে বললাম, জানেন, আপনাকে নিয়ে কল্পনায় কতাে কি করেছি, কতাে কি ভেবেছি...।
আমার স্বপ্নের শতাব্দী রায় নাটোরের বনলতা সেনের মতাে ডাগর চোখ তুলে জিজ্ঞাসা করলেন, আমাকে নিয়ে আপনি কল্পনায় কি ভেবেছেন, কি করেছেন?
লজ্জিত হয়ে আমতা আমতা করে বললাম -ইয়ে, মানে না - এই সব আর কি। আপনার অভিনীত প্রায় সব মুভিই আমি দেখেছি এবং অনেক মুভি আমার সংগ্রহে আছে।
শতাব্দী জানতে চাইলেন, তার অভিনীত কি কি মুভি দেখেছি, কোন ছবি বেশি ভালাে লেগেছে। ইত্যাদি।
বললাম, আপনার অভিনীত সব মুভিই আমি দেখেছি, যেমন ওই যে কি যেন মুভিটা- ওই যে আপনি ... একটা মুভির নামও মনে করতে পারলাম না!
অথচ শতাব্দীর অনেক ছবি মুভি কম্পােজ করে কমপিউটারে সংরক্ষণ করে রেখেছি। তা নিয়ে আমার বৌ কতাে খােচা মেরেছে। সংসারে অশান্তি পর্যন্ত দেখা দিয়েছিল অথচ আজ আমার স্বপ্নের নায়িকাকে তার অভিনীত একটা মুভির নাম পর্যন্ত বলতে পারছি না। আমার কল্পনায়, রক্তে, ঘামে, স্বপ্নে মিশে আছে শতাব্দী রায় অথচ আজ তার সামনে আমার সব স্বপ্ন, সব স্মৃতি বিস্মৃত হলাে, এ লজ্জা আমায় কেন দিলেন বিধাতা? | শতাব্দী কিছুটা উদাস কণ্ঠে শুধালেন, আমার নাম দেখার আগে কি আপনি বুঝতেই পারেননি আমি শতাব্দী রায়? বললাম, না, চিনতে পারিনি। তবে খুব পরিচিত, খুব আপন মনে হচ্ছিল।
আবার শতাব্দী কিছুটা খেদোক্তি করে বললেন, আমি আপনার এতাে প্রিয় নায়িকা, আমার অভিনীত সব মুভি দেখেছেন, মুভির কালেকশন আছে অথচ আমার অভিনীত একটা মুভির নামও বলতে পারলেন না? পাথর হয়ে গেলাম লজ্জায়-দুঃখে! একটু ধাতস্থ হয়ে তার চোখের দিকে তাকিয়ে তার অভিনীত একটা মুভির নাম বললাম, পেন্নাম কলকাতা। জানালাম ওই মুভি দেখার পরই মূলত আপনার ভক্ত হয়ে যাই ... আমার কল্পনার রাজ্যে আপনাকে নিয়ে একাকী বিচরণ। তারপর তার অভিনীত বিভিন্ন মুভি সম্পর্কে বলতে শুরু করি ... বলতে থাকি কলকাতার বিনােদন পত্রিকা তাকে নিয়ে বিভিন্ন লেখা প্রসঙ্গে ... এবার দেবী বিশ্বাস করলেন, অনুভব করলেন আমি তার কতােটা ভক্ত। কলকাতা পৌছার ঘােষণা দিল বিমান। আমি আমার পরিচয় দিলাম... একটা ভিজিটিং কার্ড তাকে দিলাম। তিনিও তার ভিজিটিং কার্ড দিলেন। শাদা রঙের একশ চল্লিশ গ্রাম গ্লসি পেপারে বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা শতাব্দী রায়, তার সই পৃন্ট করা। নিচে দুইটি টেলিফোন নাম্বার, কোনাে ঠিকানা নেই। কার্ডটা রেখে আমার নােট বুকটা বের করে তার হাতে দিল টিনএজ ভক্তের মতাে।
আমার দিকে ভুবন ভােলানাে হাসি দিয়ে একটু ভেবে লিখলেন ... আমার আজব ভক্ত (কিছুটা পাগলাটেও) যিনি আমাকে দেখেও চেনেননি। আমার অভিনীত একটা মুভির নামও বলতে পারেন। না, সই শ্রদ্ধাস্পদ ... কে শতাব্দী রায়, তারিখ.... শেষে তার মােবাইল ফোন নাম্বার লিখে দিলেন।
আমিও মােবাইল নাম্বার দিলাম। শতাব্দী জানতে চাইলেন কলকাতায় কোথায় থাকবাে এবং এয়ারপাের্টে আমার জন্য কোনাে ট্রান্সপাের্ট থাকবে কি না। হােটেলের নাম বললাম এবং জানালাম এয়ারপাের্ট থেকে ট্যাকসিক্যাবে হােটেলে যাবাে। তিনি হেসে বললেন, আমার ড্রাইভার আমার জন্য অপেক্ষা করবে। যদি আপনাকে হােটেলে লিফট দিই ...।
এক বাক্যে রাজি হলাম...।
— অনলাইন থেকে সংগৃহীত