ভিলনিউস। পূর্ব ইউরোপ হতে যাত্রা করে পশ্চিম ইউরোপে যাওয়ার পথে প্রথম বিরতি। সেন্ট পিটার্সবার্গ হতে প্রায় ৭২৫ কিলোমিটার পথ। দু'দিন দু'রাত্রির বিরামহীন ট্রেন জার্নির প্রথম পর্বে সাধারণত কোন বৈচিত্র থাকেনা। জানালার বাইরে তাকালে শুধু মাইলের পর মাইল সোভিয়েত জনপদ। কোথাও শূন্য, কোথাও আবার বিছিন্ন দু'একটা পরিবারের নির্জনাতায় বেঁচে থাকার লড়াই। বছরের প্রায় ন'মাস এদিকটায় তুষারপাত হয়। বরফের আচ্ছাদনে মুখ লুকায় বাড়ি-ঘর, গাছ-পালা সহ গোটা শহর। এর আগেও বেশ ক'বার এসেছি লিথুনিয়ায়। প্রথম আসা ক্লাসমেটদের সাথে শীতের ছুটিতে। দ্বিতীয়বার লন্ডন যাওয়ার পথে অনেকটা বাধ্য হয়ে।
সে বছরের তুষারপাত অতীতের সব রেকর্ড ভেঙ্গে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছিল। জনজীবনে নেমে এসেছিল নজিরবিহীন স্থবিরতা। একই পথে লন্ডন যেতে কোন অসুবিধা হয়নি। ভারি তুষারপাতের কারণে ট্রেনের গতি ছিল মন্থির, ছিল অতিরিক্ত সতর্কতা। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল ফেরার পথে। বার্লিন দেয়াল পেরিয়ে পশ্চিম হতে পূর্ব বার্লিনে পা রাখা মাত্র অনুভব করতে পারলাম পার্থক্যটা। তাপমাত্রা হিমাংকের নীচে প্রায় ৩০ ডিগ্রী। সাথে তীব্র হিমেল বাতাস। ট্রেন সোভিয়েত দেশে ঢুকবে কিনা এ নিয়ে দোটানায় ছিল কর্তৃপক্ষ। পোলান্ডের রাজধানী ওয়ারশ'তে অতিরিক্ত সময় বসে থাকতে বাধ্য করল। সার্ভিস ট্রেন লাইন পরিস্কার করছে। গ্রীণ সিগন্যাল পেলেই কেবল সামনে বাড়বে। টেনেটুনে ভিলনিউস পর্যন্ত আসতেই পথচলা একেবারে থেমে গেলো।
আগাথা কৃষ্টির রহস্য উপন্যাস Murder On Orient Express যাদের পড়া আছে অথবা মুভি দেখা হয়েছে তাদের বুঝতে সুবিধা হবে। ইস্তাম্বুল হতে ছেড়ে আসা ট্রেন ব্রেল্গ্রেডের কাছাকাছি কোথাও থামতে বাধ্য হয় তুষারপাতের কারণে। এবং সে রাতে ট্রেনে সংগঠিত হয় একটি খুন। ঐ খুন ও ট্রেনে উপস্থিত ডিটেকটিভ হেরকুল প্যুয়ারোকে ঘিরে প্রসারিত হয়েছে আগাথা কৃষ্টির উপন্যাস। আমার বেলায় কোন খুন না হলেও গোটা একটা দিন কাটাতে হয়েছিল ভিলনিউসে। পৃথিবীর রঙ এতটা শুভ্র হতে পারে শহরে সময়টা না কাটালে বুঝতে পারতাম না। ট্রেন ষ্টেশনের ক্যাফেটেরিয়ায় বসে বসে সময় হত্যা ছিল আমার জন্যে নতুন অভিজ্ঞতা। মাথার উপর ঝুলছিল ঘরে না ফেরার চরম অনিশ্চয়তা। রেলের লাইন বরফের এতটা নীচেই ডুব ছিল যা পরিস্কার করার গাড়িগুলো কুলিয়ে উঠতে পারছিলনা। ট্রেনের হীটার বন্ধ করে দেয়ায় ওখানে অপেক্ষা করাও সম্ভব ছিলনা। এমন অনিশ্চয়তার বেড়াজালে আটকে যখন হাবুডুবু খাচ্ছি তখনই পরিচয় হয় মেয়েটার সাথে।
মারিয়া তিশেভিচ। লম্বায় প্রায় ৬ ফুট। পায়ে হাইহীল বুট। গায়ে ফারের কোট ও মাথায় শীতের টুপি। সবকিছু মিলিয়ে অসম্ভব সুন্দরী এক মহিলা। ক্যাফেটেরিয়ার টেবিলে বসে কফি খাচ্ছি। ভীরের কারণ জায়গা না পেয়ে মারিয়াও যোগ দিল আমার টেবিলে। প্রথম দেখার হাসিটাই বলে দিল আলাপে অপরিচিতার কোন আপত্তি নেই। প্রতিবেশী অংগরাজ্য লাটভিয়ার রাজধানী রিগার ট্রেনের অপেক্ষায় আছে সে। আমি হেসে জিজ্ঞেস করলাম কোন বাস্কেটবল ম্যাচে অংশ নিতে যাচ্ছে নাকি। দেখতে অনেকটা বাস্কেটবল খেলোয়াড়রের মতই দেখাচ্ছিল। উত্তরে জানালো, আমার মতই শীতের ছুটি কাটাতে যাচ্ছে। ট্রেন ছাড়ার আগ পর্যন্ত দুজনের আর ছাড়াছাড়ি হয়নি। ঠিকানা ও ফোন নাম্বার বিনিময়ের মধ্যদিয়ে সমাপ্ত হয়েছিল পরিচয় পর্ব। ততক্ষণে জীবন হতে কেটে গেছে প্রায় ২০ ঘণ্টা। মারিয়ার সাথে আবারও দেখা হবে। তবে সেটা ভিন্ন জায়গায়, ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে।
এ যাত্রায় নির্ধারিত ৩০ মিনিটের এক মিনিটও বেশী অপেক্ষা করতে হয়নি। অনেক স্মৃতির এ শহরটায় কেবল ট্রেন ষ্টেশনে কাটাতে একটু কষ্টই হয়েছিল। ভিলনিউসের পুরানো শহর দেখতে তখনো ইউরোপ হতে শত শত পর্যটক ভীড় জমাতো। একসময় এ শহরকে বলা হতো ইউরোপের সংস্কৃতিক রাজধানী। শহর বাসিন্দাদের অশিকাংশই ছিল ইহুদি। নেপোলিয়ান বলতেন, জেরুজালেম অথ দ্যা নর্থ। সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হলেও শহর ও অংগরাজ্যের সবকিছুতে ছিল স্ক্যান্ডিনেভিয়ান প্রভাব। ওদের ভাষায়ও ছিল প্রতিবেশী ফিনিশদের সুর। এস্তোনিয়া, লিথুনিয়া ও লাটভিয়া নিয়ে সোভিয়েত প্রি-বাল্টিক অঞ্চলে রুশরা নিজেদের অবৈধ দখল কোনদিনও শক্ত করতে পারেনি বিভিন্ন কারনে। ওদের সাথে আপন হয়ে মিশলে বিষয়টা সহজেই পরিস্কার হয়ে যায়।
ট্রেন চলছে তো চলছেই। চার সীটের রুমটায় আরামের কোন ঘাটতি ছিলনা। প্রতি ওয়াগনে একজন করে কন্ডাকটার। ধবধবে সাদা বিছানা ও সাথে গরম চায়ের ব্যবস্থা এক সময় এসব রীতিমত নেশা ধরিয়ে দেয়। সহযাত্রীদেরও কাছে নিয়ে আসে। এ পথে বহুবার জার্নি করেছি। হরেক রকম মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে। একে অন্যের জীবন শেয়ার করেছি। প্রথম দিকের উত্তেজনা ততদিনে থিতু হয়ে আসায় সে যাত্রায় ট্রেনের কড়িডোরে দাঁড়িয়ে বাইরের পৃথিবীকে দেখতে যাইনি। শুধু সময় গুনেছি কখন পৌঁছবো পরিবর্তী ঠিকানায়।
বেলারুশের এক সীমান্ত দিয়ে ঢুকে অন্য সীমান্ত গ্রজনি ক্রস করলেই পা রাখবো পোল্যান্ডের সীমান্ত শহর বেলাওস্তাকে। ওখানে বদল হবে ট্রেনের চাকা। ব্রডগেজ আর মিটার গেজের মিলন হয় এ সীমান্ত শহরে। ভারী ভারী ক্রেন এক লহমায় উপরে তুলে নেয় ট্রেনের বগী গুলো। বসানো হয় নতুন চাকা। এবং ঘণ্টা খানেরকের ভেতর তৈরী হয় নতুন চলা।
একবার এক সহযাত্রী সোভিয়েত জেনারেলকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ওয়ারশ জোটভুক্ত দেশগুলোর মাঝে এ তারতম্যের কারণ। উত্তরে ভদ্রলোক বলেছিলেন, এ সোভিয়েত ওয়ার ষ্ট্রাটেজির আরেকটা অংশ। ভবিষতে যাতে নতুন কোন হিটলার এক দৌড়ে সীমান্ত অতিক্রম করে সোভিয়েত দেশে ঢুকতে না পারে তা নিশ্চিত করতে এই ব্যবস্থা।
ট্রেন লিথুনিয়ার বুক চিড়ে এগিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে সবুজের সমাহার। অনেকক্ষণ বাইরে তাকালে তন্দ্রা এসে যায়। বসন্তের শেষ ও গ্রীষ্মের শুরুতে পৃথিবীর এ অঞ্চলের মানুষ খোলাস হতে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। বদলে যায় শরীরের পোষাক। বিশেষ করে তরুনীরা অপেক্ষায় থাকে নিজেদের অপ্রকাশিত যৌবন প্রকাশের জন্যে।
পরবর্তী ষ্টপেজ সোভিয়েত সীমান্ত শহর বেলারুশের গ্রজনী।
- চলবে