গল্প আমাকে দিয়ে হয়না। তাই যদি হতো তাহলে পৃথিবীর যত গলিতে পা রেখেছি, যত মানুষের সাথে মিশেছি তাদের সবাইকে নিয়ে লিখতে গেলে জমজমাট গল্প লেখা যেতো। এসব গল্পের প্রেক্ষাপট ছিল। ছিল পার্শ্ব চরিত্র। স্মৃতির গলি হাতড়ালে খুঁজে পাওয়া যাবে নায়িকাদেরও। মাঝেমধ্যে লিখতে ইচ্ছে করে। পাঠকদের সাথে শেয়ার করতে ইচ্ছে করে জীবন নদীর গল্প। সব গল্প যদি কবরে নিয়ে যাই কষ্ট থেকে যাবে। আর আমার মত ভ্রমণ পিপাসীদের বঞ্চিত করা হবে কিছু কাব্যময় মুহূর্ত হতে। গল্প লিখতে প্রতিভা লাগে। এ প্রতিভা চর্চার ফসল হতে পারেনা। বরং মহা-বিস্ময়ের মহাকালের কোন এক গলিতে ঈশ্বর বলতে কেউ একজন থেকে থাকলে এটা তারই দান। এ যাত্রায় পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ'তেও ঘটবে এমন একটা ঘটনা যা নিয়ে অনেকেই উপন্যাস লিখতে পারতো। সে গল্প একটু পরের। আমি এখনো সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেতর। ট্রেনের জানালায় বসে বাইরের পৃথিবী দেখছি। তন্ময় হয়ে দেখছি বাইরের জীবন। এ যেন সেলুলয়েডের ফিতায় ধরা বিশাল এক মুভি।
লিথুনিয়ার রাজধানী ভিলনিউস ছাড়ার পর আর কোথাও থামার মত ষ্টেশন নেই। মাঝে মধ্যে ট্রেনের গতি শ্লথ হয়ে আসে। কখনো আবার সময় কভার করার জন্যে ঝড়ো গতিতে ছুটে চলে। এ অঞ্চলে শীতের প্রভাব অন্য যেকোনো এলাকার চাইতে একটু বেশী এবং দীর্ঘস্থায়ী। ভাল করে তাকালে উঁচু গাছগুলোতে বরফের অবশিষ্ট দেখা যায়। গ্রীষ্মের স্থায়িত্ব এখানে খুব ছোট। জুনের শেষদিকে মধ্যরাতেও সূর্যের দাপট থাকে। আবার মধ্য জানুয়ারিতে চব্বিশ ঘণ্টাই থাকে অন্ধকারের রাজত্ব। বেলারুশ সীমান্ত পার হয়ে কখন প্রিবাল্টিক এলাকা ত্যাগ করেছি বুঝার উপায় থাকেনা। কারণ আজকের মত সে সময় লিথুনিয়া, লাটভিয়া অথবা এস্তোনিয়া আলাদা কোন দেশ ছিলনা। ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন নামের জগাখিচুড়ির একটা দেশ।
বেলারুশ সীমান্তের শেষ শহর গ্রদনো। ওটাই আমার গন্তব্য। ওখানেই মোকাবেলা করতে হবে সমাজতন্ত্র নামের স্বৈরশাসনের উত্তাপ। এ সীমান্ত শহরে পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল। সমীকরণটা খুব একটা সহজ নয় এ সীমান্তে। রুশরা এ সীমান্তের বর্ণনা দিতে গেলে অনেকটাই আবেগপ্রবণ হয়ে উঠে। কারণ এ সীমান্ত দিয়েও প্রবেশ করেছিল দখলদার হিটলার বাহিনী। ছোট এ শহরের প্রতিটা ইট সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকার। অনেক জায়গায় অক্ষত রাখা আছে হিটলার বাহিনীর পৈশাচিকতা। আমরা যারা এ পথে ভ্রমণ করি তাদের অবশ্য এসব দেখার খুব একটা সময় থাকেনা। ট্রেন থামে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস পার হওয়ার জন্যে।
নিয়ম অনুযায়ী নেমে পরলাম ট্রেন হতে। অপেক্ষা করার জন্যে নির্দিষ্ট একটা জায়গা আছে। কাস্টম অফিসার ও তাদের ট্রেইনড কুকুরগুলো ট্রেনের প্রতিটা ওয়াগন চেক করবে। এমনকি ট্রেনের তলায় পাঠাবো অভিজ্ঞ কুকুরদের। অনেক সময় হোস পাইপ দিয়ে গরম পানি ছুড়ে নিশ্চিত করবে ওখানটায় কেউ লুকিয়ে নেই। অনেক বার বার্লিন ওয়াল অতিক্রম করার সময় দেখেছি একই চিত্র। সোভিয়েত ইউনিয়ন হতে এক ডলার বাইরে নেয়ারও অনুমতি নেই। অথচ দুই দিন তিন রাতের এ লম্বা জার্নিতে বেঁচে থাকার জন্যেই চাই নগদ অর্থ। সীমান্ত শহর গ্রদনোই হচ্ছে সোভিয়েত অর্থ রুবেল ব্যবহারের শেষ ঠিকানা। সীমান্ত অতিক্রম করে পোল্যান্ডে ঢুকলে বাস্তবতা অন্যরকম। ডলারই একমাত্র বিনিময় মাধ্যম। সোভিয়েতদের জন্যে সমস্যাটা এখানেই। সীমান্ত বাহিনীর মূল কাজ হচ্ছে আমার মত বিদেশীদের বৈদেশিক মুদ্রার উৎস খোঁজা ।
হরেক উপায়ে মানুষ মুদ্রা পাচার করতে বাধ্য হয় এ পথে। বিশেষকরে যারা বিরাট অংকের ডলার নিয়ে বাইরে যায়। আমি কোন বারই ২০০/৩০০ ডলারের বেশী নিয়ে যাইনি। এ যাত্রায় আমার পুঁজি ছিল ৩০০ ডলার। পকেটের এক কোনায় লুকিয়ে দিব্যি ভাল মানুষের আচরণ করে পার পেয়ে যাই। মনুষ্য ও কুকুর পর্ব শেষ হওয়ার পর আমাদের আমন্ত্রণ জানালো নিজ নিজ ওয়াগনে ফিরে যাওয়ার। ষ্টেশনের ক্যাফেটেরিয়া হতে যথেষ্ট পানি ও ফলমূল কিনে ফিরে গেলাম নিজ সীটে। ফিরে যা দেখি তাতে কোনদিনও অবাক হইনা। কারণ জানতাম এমনটা হবে। অনেক সময় বালিশ পর্যন্ত কেটে কুটে চেক করে। লণ্ডভণ্ড থাকে বিছানা। ওরা তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেরায় লুকানো গুপ্তধন। আফ্রিকান ছাত্রদের বেলায় কাস্টমস থাকে মার্সিলেস নির্মম। অনেক সময় এখানেই শেষ হয় তাদের ভ্রমণ পর্ব। কারণ একটাই, মুদ্রা পাচার।
ঘণ্টা তিনেক পর গ্রদনো হতে রওয়ানা দিল সেন্ট পিটার্সবার্গ হতে ছেড়ে আসা ট্রেন। মিনিট দশেক পর হাজির পোলিশ কাস্টম ও সীমান্ত পুলিশ। একটা দেশের ইমিগ্রেশন পুলিশের কাজ যদি হয়ে তার সীমান্ত অক্ষত রাখা, পোল্যান্ড সীমান্তের এ অংশে এলে সে ধারণা পালটে যেতে বাধ্য। তরুণ, বৃদ্ধ, সুন্দরী যে পুলিশই আসুক না কেন, তাদের প্রথম প্রশ্ন, তোমার কাছে কি বিনিময় করার মত ডলার আছে? প্রশ্নটা সরকারীভাবে বিনিময়ের জন্যে নয়, বরং ব্যক্তিগত পর্যায়ের লেনাদেনা। সমাজতন্ত্র মানুষকে কতটা নষ্ট করতে পারে পৃথিবীর এ অংশে না এলে বুঝতে পারতাম না।
আমার কাছে যে ৩০০ ডলার ছিল তার সবটাই এখন বৈধ! পোল্যান্ডে তা বদল করার মত বোকামি করতে গেলাম না। আমাকে এখনো অনেকদূর যেতে হবে। সামনে বেলাওস্তক। ট্রেনের চাকা বদলের জায়গা। সবকিছু প্ল্যান মাফিক শেষ হলে মধ্যরাতে হাজির হবো দেশটার রাজধানী ওয়ারশতে। চলুন কিছুটা বিশ্রাম নেই। কারণ অনেক ঘটনা ঘটবে পরের দিন। ভিসার জন্যে আমাকে দৌড়াতে হবে বার্লিনস্থ ব্রিটিশ এম্বাসিতে। ভিসা পাওয়ার পর লোকাল ট্রেন ধরে যেতে হবে নেদারল্যান্ড এম্বেসিতে বেনেলাক্সের ভিসা নিতে (BENELUX - Belgium, Nederland & Luxembourg).
দ্রষ্টব্যঃ ট্রেনের ছবিটা এ পথের নয়। জার্নির এ পথে কোন পাহাড় নেই।
চলবে।