বিকেলে ভোরের গল্প - পর্ব ৭

Submitted by WatchDog on Thursday, March 25, 2021

Berlin Wall

বার্লিন দেয়াল। দেশ, মহাদেশ, এমনকি সংসার বিভক্তির দেয়াল দেখেছি। সময়ের প্রবাহে সবই মেনে নিয়েছি। অভ্যস্ত হয়ে গেছি এসব বিবর্তনে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাসের সাক্ষী এই বার্লিন দেয়ালের সামনে যতবার দাঁড়িয়েছি ততবার শিরদাঁড়া বেয়ে বয়ে গেছে অদ্ভুত একটা শীতল শিহরণ। মেনে নিতে কষ্ট হয় কেবল একজন মানুষের কারণে প্রাণ হারিয়ে ছিল কোটি কোটি মানুষ।

দেয়ালের সামনে দাঁড়ালে সেলুলয়েডের ফিতার মত চোখের সামনে ভেসে উঠে ১৯৪৫ সাল। যুদ্ধের পূর্ব ফ্রন্ট হতে রুশদের বার্লিন অভিযানের কাহিনী কেবল সিনেমায় দেখিনি, যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অনেক সৈনিকের মুখ হতে শুনেছি এর ভয়াবহতা।

আমার ইতিহাস শিক্ষক আনাতোলি স্তেপানভিচ তার যুদ্ধাভিযান শেষ করেছিলেন এই বার্লিন শহরে। আহত হয়েছিলেন। যুদ্ধের শেষ প্রহরে ট্যাংকে চড়ে ঘুরে বেরিয়েছিলেন যুদ্ধ বিধ্বস্ত বার্লিন শহরে।

এ দৃশ্য বর্ণনা আবেগে থর থর করে কাঁপছিলেন। দু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরছিল অশ্রুধারা। একটা ডকুমেন্টারিও দেখিয়েছিলেন ক্লাসে। সেখানে তিনি ছিলেন। শত শত তরুণ সৈনিকদের মাঝে হ্যান্ড-সাম একজন। হাতে বেয়নেট সহ রাইফেল।

আমাদের ডর্মের গার্ড তাতিয়ানা আলেক্সেয়েভনার স্বামী প্রাণ হারিয়েছিলেন বার্লিন যুদ্ধে। তিনি নিজেও ছিলেন বার্লিনের দোরগোড়ায়। নার্স হিসাবে সেবা করেছিলেন যুদ্ধাহত সৈনিকদের। চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা শুনলে রক্ত হিম হয়ে আসে।

ব্যাটল ফর বার্লিন মিশনে পশ্চিম হতে আসা মিত্র বাহিনীর বাকি দেশের সৈন্যরা নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে দখল নেয় শহরে এক অংশ। এই অংশই তখন পশ্চিম বার্লিন হিসাবে পরিচিত ছিল। বার্লিনের পূর্ব অংশের দখল চলে যায় সোভিয়েতদের হাতে। পূব ও পশ্চিম বার্লিনের বিভক্তি নিশ্চিত হয় মিত্র বাহিনীর নিজেদের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির মাধ্যমে।

এর আগে কম করে হলেও ত্রিশবার অতিক্রম করেছি বার্লিন দেয়াল। হয় চলন্ত ট্রেনে, অথবা পায়ে হেঁটে। ট্রেনের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর না হওয়ায় সাধারণত হেঁটেই মোকাবেলা করেছি একই শহরে দুই রাজার শাসন।

দেয়ালের দুই পাশে দুই ধরণের জীবন। পূবের জীবন নিয়ন্ত্রিত হয় সমাজতান্ত্রিক শাসনের কঠিন যাঁতাকলে। পশ্চিমে পুঁজিবাদের বাজার ভিত্তিক খোলা অর্থনীতি। পার্থক্যটা চোখে পরতে বাধ্য।

পশ্চিম বার্লিনে পা রাখা মাত্র চোখ পরবে এর চাকচিক্য। চারদিকে আলোর ঝলকানি। হরেক রকম গাড়ির মিছিল। পাশাপাশি দারিদ্রের অবস্থানও চোখে পরতে বাধ্য।

গৃহহীনরাও হাঁটছে পাশাপাশি। ওদের কোন গন্তব্য নেই। এলোমেলো হেটে বেড়ানো মানুষরা মনে করিয়ে ঝলমলে আলোর অন্য-পীঠেই বাস করে অন্ধকার এক জীবন।

শহরের Zoologischer Garten ষ্টেশনের প্লাটফর্মে মাতাল গৃহহীনদের দেখলে একটা সন্দেহ দানা বাধতে বাধ্য; ওরা আসলেই কি বাজার অর্থনীতির বাই-প্রোডাক্ট, না;কি জীবন হতে পালিয়ে বেড়ানো একদল ব্যর্থ মানুষের সেলফ আইসোলেশন।

বার্লিনের পূর্ব অংশেই যত পুলিশ ও ইমিগ্রেশন ঝামেলা। পশ্চিমে এর নাম গন্ধ নেই। দেয়াল সীমান্তে পূর্ব জার্মান পুলিশদের দেখলে মনে হবে দম দেয়া একদল হায়েনা। হায় হ্যালো বলার সংস্কৃতি নেই। চেহারায় সব সময় একটা বিরক্তির ভাব। চোয়াল থাকে শক্ত।

বরাবরের মত এ যাত্রায়ও পূর্ব জার্মান পুলিশের হাতে পাসপোর্ট হস্তান্তর করা মাত্র জমে গেল। পাসপোর্ট পাতার ছবির পৃষ্ঠা খুলে কয়েক সেকেন্ডের জন্য অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। কম করে হলেও দশবার টার্গেট বদল করল। একবার আমার দিকে, আবার পাসপোর্টের দিকে। এসব দৃশ্যের সাথে আমার অনেকদিনের পরিচয়। তাই অবাক হলাম না। ভিসা নিয়েই দেশটায় পা রেখেছি। তাছাড়া পূর্ব জার্মানিতে অবৈধ অভিবাসীদের কোন চাপ ছিলনা। এ দেশে বাইরের পৃথিবী হতে কেউ থাকতে আসেনা। পুলিশের চোখের তেলেসমাতিতে তাই ভীত হওয়ার কোন কারণ ছিলনা আমার। আমি জানি এভাবেই ওদের ট্রেনিং দেওয়া হয়।

এই দেয়াল এক অর্থে দুই পরাশক্তির ফোর ফ্রন্ট। তাই সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে এ নিয়ে সন্দেহ ছিলনা।

ট্রেনে করে বার্লিন দেয়াল অতিক্রম করতে গেলে নিরাপত্তার অংশ হিসাবে হোস পাইপ দিয়ে গরম পানি ঝড় বইয়ে দেয়া হয় ট্রেনের তলায়। এভাবেই নিশ্চিত করা হয় পূর্ব জার্মানদের কেউ লুকিয়ে পশ্চিমে যাচ্ছেনা।

কম করে হলেও পাঁচ মিনিট সময় নেয় ইমিগ্রেশন পুলিশ। কোন প্রশ্ন থাকলে তা খাঁটি জার্মান ভাষায় ছুড়ে দেয়। সমস্যা দেখা দিলে এসকর্ট করে নিয়ে যায় গোপন কুঠুরিতে।

না, এ যাত্রায়ও আমার কোন সমস্যা হলোনা। খটাস করে এক্সিট সিল মেরে ফিরিয়ে দিল পাসপোর্ট। তিন চার কদম হাঁটলেই পা রাখা হয় পশ্চিম বার্লিনে।

অনেকদিন পর আবারও পশ্চিম বার্লিনে। সকাল প্রায় ১১টা। জীবন ততক্ষণে ফুল স্কেলে এগিয়ে চলছে।

চারদিকে গাড়ির মিছিল। বিপণি বিতানগুলোতেও মানুষ গিজ গিজ করছে। পীপ শো গুলোতেও ভিড়। ওখানে কাউন্টারে জার্মান মার্ক ঢাললে ছোট একটা জানালা খুলে যায়। মেয়েদের কাপড় খোলা দেখার বিনোদনের জায়গা। কাছেই অনেক হার্ড-কোর পর্ণের মুভি থিয়েটার। বার্লিনের পূব পাশে এসব অকল্পনীয়। অনেক ক্ষেত্রে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দুই সমাজ ব্যবস্থার পার্থক্য বাস্তবতা উপলদ্বি করার পারফেক্ট প্রেক্ষাপট।

দুইটার দিকে আমাকে নেদারল্যান্ড গামী ট্রেন ধরতে হবে। ব্যায় করার মত কিছুটা সময় আছে হাতে। দেশে ফোন করতে হবে। মার সাথে কথা বলা হয়না অনেকদিন।

প্রতিবার পশ্চিম বার্লিনে পা রেখে প্রথম যে কাজটা করি তাহলো ফোন করে বাড়ির সবাইকে অবাক করে দেয়া। পূর্ব ইউরোপের কোন দেশ হতেই এমনটা সম্ভব ছিলনা। ফোন করতে গেলে আগ বাড়িয়ে পোষ্ট অফিসে বুক করে আসতে হয়। ওরা ফোন করে সময় সীমিত করে দেয়। আমার ১২ বছরের সোভিয়েত জীবন কেবল দুইবার সক্ষম হয়েছিলাম দেশে কথা বলতে। তাও কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে। এমনটাই ছিল সমাজতান্ত্রিক রীতিনীতি।

- চলবে


ভালো লাগলে শেয়ার করুন