এটি কোন স্থান, নদ-নদী বা বিলঝিল সম্বন্ধে কিংবদন্তি নয়। এটি একটু অন্য ধরনের কিংবদন্তি। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের সূক্ষ্ম যে মিলন ভূমি- বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে না। এটি সেই ধরনের কিংবদন্তি। তবে লােকবিজ্ঞানে কিংবদন্তির যে সংজ্ঞা দেয়া আছে, তাতে কিন্তু পড়বে। কারণ দেশ-বিদেশের কিংবদন্তির একটি উল্লেখযােগ্য মটিফ হল ‘পরীদের গল্প। (ফেয়ারী লিজেন্ড)
সংজ্ঞা থাক, ভূমিকাও থাক। কিংবদন্তি শুনুন।
এ কিংবদন্তির নায়ককে আমি নিজেই দেখেছি। বাড়ি ছিল পাবনার সাজাদপুরে। আত্মীয়। কিন্তু তার জীবন কেটেছে আমাদের নানাবাড়ি, টাঙ্গাইল। বাড়ি কেন ছেড়েছিলেন তারও ইতিহাস আছে। ছােটখাটো মানুষটি ছিলেন। গায়ের রঙ কাঁচা সােনার মতন। ছেলেবেলা থেকেই অত্যন্ত চমৎকার কোরআন শরীফ পড়তে পারতেন। সাজাদপুরেই হযরত শাহ মখদুমের প্রাচীন মাজারের সংলগ্ন মসজিদে ওস্তাদের কাছে কোরআন শরীফ পড়তেন। তিনি একা নন। আরও অনেক ছেলেমেয়ে। তারা যখন কোরআন শরীফ পড়তাে সেই সঙ্গে আরও দু'একটি ফুটফুটে ছেলেমেয়ে তাদের সাথে পড়তাে।
একদিন শীতের সকাল সবাই বসে পড়ছে, হঠাৎ আমাদের নায়ক দেখলেন সবারই ছায়া পড়ে দেয়ালে। কিন্তু একটি ছেলে আর একটি ফুটফুটে মেয়ের ছায়া পড়ে না।
কি ব্যাপার? আমাদের নায়ক তাদের জিজ্ঞেস করলেন, কী-হে, তােমাদের ছায়া কই? ভারী ত মজা! তােমরা জ্বিন-পরী নাকী?
সে শুনেছিল জ্বিন-পরীদের ছায়া নেই। সে কিন্তু এমনিই জিজ্ঞেস করেছিল- কোন কিছু ভেবে চিন্তে বলেনি। ওস্তাদজী তার কথা শুনে কেমন গম্ভীর হয়ে গেলেন, গােপনে ডেকে নিয়ে বললেন, সে যেন এমন কথা আর কোনদিন জিজ্ঞেস না করে। দুনিয়াতে এমন অনেক কিছুই আছে, জিজ্ঞেস করা যায় না।
সে অবশ্য তার বাবার কাছে শুনেছিল ওস্তাদজী ছিল খুব কামেল লােক এবং জ্বিন ছিল তার ‘তাবে'। তিনি জ্বিন হাজির করে নাকি বহু লােকের চিকিৎসা করাতেন - কিন্তু টাকা-পয়সা নিতেন না। রাতদিন ঐ মাজারে পড়ে থাকতেন। কারাে বাড়ি যেতেনও না-খেতেনও না। তবে সকলেই খুব ভক্তিশ্রদ্ধা করতাে। আর এক মসজিদে দীর্ঘদিন কাটাতেন না। চলে যেতেন রাজশাহী। দিনাজপুর। শ্রীহট্ট। ঢাকা। কলিকাতা। আমজীর। এইভাবে দিন যায় ।...
নায়কের কোরআন পড়া ছিল অপূর্ব। মেয়েটি অবাক হয়ে তার পড়া শুনতাে।
তারপরই শুরু হল ঘটনা আর দুর্ঘটনা। নায়ক হয়তাে বাড়িতে ঘুমিয়ে আছেন। জেগে দেখেন মেয়েটি তার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে।
নায়ক বাড়িতে কোরআন পড়ছেন। দেখেন মেয়েটি এক মনে মাথায় ওড়না দিয়ে শুনছে। এই ছিল- এ-ই নেই। এ-ই বসেছিল- এ-ই উধাও।
এ-তাে ভারী তেলেসমাতী কাণ্ড।
নায়ক বড় হচ্ছেন। যুবক হলেন।
মেয়েটি তার শিয়রে এসে দাঁড়ায়। সােনালী পাখা দিয়ে বাতাস করে। অদ্ভুত অদ্ভুত সব উপহার রেখে যায়। বালিশের নিচে। অদিনের আঙ্গুর। খুরমা। ছেব। ইত্যাদি।
নায়কের একবার জ্বর হল। থাকেন একা বাংলােঘরে - গভীর রাতে দেখলেন দুনিয়া রুশনি করে সেই মেয়েটি শিয়রের কাছে এসে দাঁড়ালাে। হাতে টিনের একটি কৌটা। বললাে, খাও- মক্কার আবে-জমজমের পানি। খাও-জ্বর ছেড়ে যাবে।
সত্যি ত আবে-জমজমের কৌটা। যা নাকি মক্কা হজ করতে গিয়ে অনেক হাজী সাহেবই নিয়ে আসেন। বাড়িতে বালা-মুসিবৎ হলে বিশ্বাস করে খাওয়ায়। কেউ মরে গেলে মুরদার কাফনের উপর ছিটিয়ে দেয়। হ্যা সেই কৌটাই বটে!
নায়ক শুনেছিলেন আদম সন্তানের উপর জ্বিন-পরীর ‘আসর হয়ে থাকে। তাছাড়া এরূপ গল্পও ত এখানে সেখানে শােনা যায়। পুঁথি সাহিত্যেও আছে। খুলনার শেখ হবিবর রহমান সাহিত্যরত্নও দীর্ঘদিন পূর্বে একটি বই লিখেছেন- নাম ‘পরী-কাহিনী... বইটি আমিও পড়েছিলাম ছেলেবেলায়।
ব্যাপারটা কী?
নায়ক একদিন নামাজ পড়ে শুয়ে আছেন। হঠাৎ তার আবির্ভাব।
কি চাও তুমি?
- তােমাকে চাই।
- কি হবে আমাকে দিয়ে?
- তােমাকে শাদী করবাে। পরী-রাজ্যে নিয়ে যাব। 'এজেন' দাও।
- কিন্তু আমার বাপ-মা আছেন, আত্মীয়-স্বজন আছেন।
- তােমাকে চাই। আমার বাবা একটা খারাপ বদকার জ্বিনের সঙ্গে আমার শাদী দিতে চাচ্ছেন। আমার ‘এজেন’ নাই। আমার মা-কে তােমার কথা বলেছি, তার মত আছে।
- তুমি যদি পরী হও, তবে ত আগুন দিয়ে তৈরি। আমি মাটির আদম। কিভাবে সম্ভব! এই বলে পরীক্ষা করার জন্য - আসলে পরী না কোন দুষ্টাপ্রেতাত্মা - কোরআন পড়লেন নায়ক। তারপর মেয়েটিকে পড়তে দিলেন। চমৎকার সুর করে কোরআন পড়লাে সে। এইবার-এ ত আর কোন সন্দেহ থাকে না।
- আচ্ছা, আমি যাই। ভেবে দেখাে। আর তােমার আব্বা-আম্মাকে দিও। এই বলে বালিসের নিচে সে দশটি চকচকে মােহর রেখে গেল।
হ্যাঁ - খাঁটি সােনার মােহর।
বাবাকে সবকিছু খুলে বলা হল। দিলেন মােহরগুলি। বাবা চিন্তিত হলেন। ছুটলেন তিনি সেই ওস্তাদজীর কাছে। তিনি তখন সাজাদপুরেই আছেন। সব শুনে বললেন, বুঝলাম - সবই বুঝলাম। মেয়েটি আমার ছাত্রী - আমার কাছেও এসেছিল। এই দেখুন, আমাকেও ঠিক দশটি মােহর সালাম দিয়ে গেছে।
তাই ত, সেই একই মােহর!
- মেয়েটি বড় ভালাে। ওর মাও বড় ভালাে। জ্বিনের বাদশার আত্মীয়া-ভগ্নি। পাঞ্জেগানা নামাজী কিন্তু এ বিবাহ ত হতে পারে না। মেয়েটি ভাবাবেগের স্রোতে ঠিক বুঝতে পারছে না। ওস্তাদজী একটি তাবিজ দিলেন। ডান হাতে বেঁধে রাখতে হবে। দেখা যাক।
নায়ক বেড়াতে গেছেন নদীর ধারে। হঠাৎ দেখেন দূরে মেয়েটি করুণ-চোখে তাকিয়ে আছে।
- আমি ত কাছে আসতে পারছি না। হাতের ঐ তাবিজটি খােল না। একটু ক্ষণের জন্য। খুলে পাশে রাখাে মাটিতে। আবার মিনতি। করুণ মিনতি- একটু খােল না আমার একটা কথা আছে।
অগত্যা তাবিজটি খুলে নায়ক হাতে নিলেন। বললেন, বেশ খুলবাে, কিন্তু তার আগে - কোরআনের সূরা-এ ইয়াছিন পড়াে।
তুমি কে, কেমন করে বুঝি?
চমৎকার সুললিত ভাষায় পড়লাে সে। নদীর পানি যেন সে সুরে হিল্লোহিত হল। দাঁড়াও - এই বলে তাবিজটি খুলে দূরে রাখলেন।
মেয়েটি অত্যন্ত তমিজের সঙ্গে কাছে আসলাে। বললাে, মা-কে বলেছি, তােমাকে নিতে এসেছি। বাবা আমার অন্যত্র বিয়ে দিতে চান। তার চোখে পানি। বললাে, মা আমার মামাদের বলেছেন, কেউ তােমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
তারপরের ঘটনা দেখা-অদেখা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের পরীরাজ্য। কেমন একটা তন্দ্রাচ্ছন্নের মত আবেশ। বিরাট প্রাসাদ। চমৎকার খাট-পালং। অপূর্ব সব আসবাবপত্র। কত রকমের যে ফল-আঙ্গুর, ছেব, কিসমিশ, খুরমা, খেজুর। আর মেয়েটি শিয়রে দাঁড়িয়ে রেশমি পাখায় বাতাস করছে। একটু পরে কিসের যেন শরবত দিল । খেয়ে অনেকটা যেন স্বাভাবিক হলেন। বললেন, আমি কোথায়? আমার বাবা-মা? ভাই বােন? আবার তন্দ্রাচ্ছন্ন।
হঠাৎ শুনলেন - দুমদাম দুমদাম - কাদের মধ্যে যেন ভয়ানক বিবাদ লেগেছে - কিছুটা সেই বােম্বের হিন্দি ফিল্মের মত চড়-চাপট-কিল-ঘুষি....।
তন্দ্রার ভাব টুটলে মেয়েটির কাছে শুনলেন, সেই দুষ্ট জ্বিনটা এসেছিল। সেই যে তাকে বিয়ে করতে চায়। আমার ভাইয়েরা খু-উ-ব উত্তম-মধ্যম দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ও যা পাজী, তােমাকে সাবধান থাকতে হবে। আমি একটা তাবিজ দেব - সব সময় গলায় রাখবে - ও কিছু করতে পারবে না - আল্লাহ সহায়।
নায়ক বললেন, আমাকে এবারে দেশে পৌছে দাও। আমি আমার বাবা-মার মত নিয়ে 'এজেন' দেব- ভেবাে না। এই বলে তিনি নামাজে দাঁড়ালেন। আশ্চর্য, তাঁর পাশে আকামত বলছে অন্যজন, সেই ছেলেটি, সেই মেয়েটির ভাই, যে ওস্তাদের কাছে মেয়েটির সাথেই পড়তে যেত। যাদের ছায়া পড়তাে না।
দেখলেন শুয়ে আছেন তিনি তার বাড়ির বিছানায়।
সকলেই চিন্তিত।
বাবা আবার ছুটলেন ওস্তাদজীর কাছে। ওস্তাদজী এবারে রেগে গেলেন, তাবিজ কেন সে খুললাে। ওস্তাদের কথা শােনে না। বেয়াদব ছেলে!!
নায়কের অবস্থা’ত উভয় সংকট। মেয়েটির ছলছল করুণ চোখ দেখে তারও যে কেমন মনের বনে ঝড় উঠেছে। কি উপায়? ভুলতে চাইলেও যে ভােলা যায় না। এরই কি নাম প্রেম? মহব্বত? - ওস্তাদজী আবার তাবিজ দিলেন।
নায়ক একদিন গােসল করতে গিয়েছেন পুকুরে। গায়ে দিয়েছেন সাবান। হাতের এবং গলার তাবিজটি একটু ক্ষণের জন্য খুলেছেন। অমনিই কে যেন পেছন থেকে এসে গালে এমন এক বিরাশী সিক্কা থাপ্পড় লাগালাে যে, তিনি উল্টে পড়ে গেলেন পুকুরে। হয়তাে মরেই যেতেন যদি কাছের লােকজন এসে না তুলতাে। তারপরই ভয়ানক জ্বর আর প্রলাপ। ডাকা হল ওস্তাদজীকে। সব শুনলেন তার কাছে, সব বুঝলেন। রাতে মেয়েটি স্বপ্নে দেখালাে, তােমাকে বলিনি, গলার তাবিজ খুলবে না, শয়তানটা তােমার পিছু নিয়েছে - হিংসায় জ্বলে মরছে। আমি কি করবাে - হাতের তাবিজ না খুললে’ত কাছে আসতে পারি না। আমি ওস্তাদজির পায়ে পড়ে কত কাঁদলাম - কত অনুরােধ করলাম আমার মা-ও এসেছিলেন, কিন্তু তিনি এ বিয়েতে ‘এজিন’ দেন না। আমি এখন কি করি! আমি- কি-করি!!
পরের ঘটনা হল নায়ক আমারই নানার বাড়ি চলে এলেন - নানার সহায়-সম্পত্তি দেখেন, কিন্তু তাবিজ খােলেন না - ওস্তাদের নিষেধ। সে যুগে ওস্তাদের সম্মান ছিল। কিন্তু প্রেম বড় না ওস্তাদ বড়?
একদিন আমাদের নায়ক নামাজ পড়ে মাঠে বেড়াতে গেছেন। দেখেন হাত পঞ্চাশেক দূরে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে করুণ চোখে।
-তাবিজটা একটু খােল না! একটি বার! আমার একটা কথা আছে।
-এক শর্তে খুলতে পারি, তুমি আমার কাছে এসে বসবে কিন্তু কোথাও নিয়ে যেতে পারবে না।
-হ্যাঁ - তাই। রাজি।
তাবিজ খুললেন। মেয়েটি কাছে এসে অঝাের ধারায় কাঁদতে লাগলাে।
-কিন্তু আমি কি করতে পারি। আমি ত আদম।
-তুমি এখানেই নামাজ-কালাম নিয়ে থাকবে। মধ্যে মধ্যে পরীরাজ্যে যাবে - জামাই যেমন শ্বশুর বাড়ি যায়। তােমার কোন অভাব থাকবে না। আমিই সদা-সর্বদা তােমার কাছে আসবাে। তােমার খানা আসবে পরীরাজ্য থেকে। কেবল একটি ওয়াদা- তুমি বিয়ে করবে না অন্য কাউকে। তােমার যে সন্তান হবে আমাকে দিয়ে তারাও পরীরাজ্যে থাকবে। রাজি?
-কিন্তু তুমি ত আগুন- কোরআনই বলে- ঐ যে সেই সূরাটি মনে নাই। আমি ত মাটি।
-না- তােমার কোন ক্ষতি হবে না। আমাদের এক শরবৎ আছে, তা সর্বদা খেলেই তােমার কোন ক্ষতি হবে না।
এইভাবে চললাে। মেয়েটির নাম নার্গিস সুলতানা। নায়ক নাম ধরেই ডাকেন। মেয়েটি প্রতি রাতেই আসে। কথা বলে। বাতাস করে কিন্তু দেহ স্পর্শ করে না। নায়কও দেহ স্পর্শ করেন না কারণ তখনাে তিনি ‘এজেন’ দেননি।
এর মধ্যে তড়িঘড়ি করে একদিন নায়কের বাবা চলে এলেন নানা বাড়ি। বললেন, ছেলেকে আজই দেশে যেতে হবে। ওস্তাদজির আদেশ।
দেশে পৌঁছেই সােজা এক মওলানা সাহেবের বাড়ি। কি ব্যাপার? তার বিবাহ ঠিক করেছেন ওস্তাদজি।
-না - কোন কিন্তু নাই। আমি তােমার ওস্তাদ। তােমার ভালাে চাই আমি। ওসব বদ খেয়াল ছাড়াে। যা হবার নয় - বেহুদা চিন্তা করে লাভ নেই। মেয়েটি কালও আমার পায়ের কাছে পড়ে কেঁদেছে। আমি বলে দিয়েছি, এটি হবার নয়। দুলহিন তৈরি - কলমা পড়াে।
-পড়াে -আলহামদুলিল্লাহ...।
নায়ক তাকিয়ে দেখেন বিবাহ মজলিসের অদূরে জানলা ধরে কাঁদছে নার্গিস। বড় করুণ তার মুখ । সে-ই সম্ভবত দেখছে নার্গিসকে আর কেউ নয়। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে এলাে ওস্তাদজির আহ্বানে।
- কলেমা পড়াে- বিসমিল্লাহির রাহমানুর রাহীম। যন্ত্রচালিতের মত অন্দরে গেলেন। দুলহিনের হাত দুলার হাতের সাথে মিললাে - নায়ক চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন নার্গিস - সেই মেয়েটি আর নেই।
এরপর দীর্ঘদিন কেটে গেছে। আমাদের নায়কের সংসার হয়েছে - সন্তান এসেছে। কিন্তু এর মধ্যে একদিনের জন্যও সেই মেয়েটি আর এসে বিরক্ত করেনি। তাকে ক্ষণিকের জন্য দেখেছিলেন একবার মাত্র জীবনে।
সে কাহিনীও চমকপ্রদ।
একবার কি এক প্রয়ােজনে সিরাজগঞ্জ যাবেন। যমুনা পাড়ি দিতে হবে। যাচ্ছেন নৌকায়, আরও অনেক যাত্রী। হঠাৎ মধ্য যমুনায় উঠলাে ঝড়। ঢেউয়ের বাড়ি খেয়ে খেয়ে নৌকা ডুবে গেল। এই ঘাের বিপদে বিদ্যুতের মত তার মনে পড়লাে মেয়েটির নাম, নার্গিস-নার্গিস বাঁচাও-বাচাও। আর সেই সময় ঠিক সেই সময় কে যেন একটি রেশমী চাদরের প্রান্ত বাড়িয়ে দিল - তাই ধরে তিনি তীরে উঠলেন। তিনি তার হাত ধরতে চাইলেন। কিন্তু মেয়েটি বললাে, আমি ত কুমারী, বেগানা, পর পুরুষের হাত ধরা গােনাহ। তােমার স্ত্রীতাে আমার বােনেরই মত। সে-ই শেষ। আর দেখা হয়নি।
আমাদের নায়কের দাম্পত্য জীবন কেমন ছিল?
শুনেছি, তার স্ত্রীর মেজাজ নাকি খুব কড়া ছিল। কিন্তু তিনি তার সাথে ঝগড়া-বিবাদ করতেন না। তিনি নামাজ-রােজা, কোরআন পাঠ, রমজান মাসে নিয়মিত এহতেকাফ এই নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। আমাদের অঞ্চলের অনেকেই এই কাহিনী জানতেন। আমার বৃদ্ধা মা-নানী অথবা অন্যান্য মুরুব্বীদের কাছে জিজ্ঞাসা করলে তারাও বলেছেন - হ্যাঁ - এ ঘটনা তারাও শুনেছেন। এ কাহিনীর নায়কের সঙ্গে আমার যখন প্রথম দেখা হয়েছে তখন আমি স্কুলে পড়ি এবং তখন নায়কেরও যথেষ্ট বয়স হয়েছিল। তাকে আমরা ঠাট্টা করে বলতাম, নানা- (নানা করেই ডাকতাম) আমাদের পরীরাজ্য দেখতে ইচ্ছে করে।
নানা হাসতেন।
একদিন গল্পচ্ছলে অবশ্য আমার নানীর বারংবার অনুরােধে তিনি গল্পটি আদ্যন্ত বলেছিলেন। আমি তখন কলেজে পড়ি। তখনও নানা বেঁচে ছিলেন। চমৎকার স্বাস্থ্য ছিল বৃদ্ধ বয়সেও। তিনি গল্পটা আরেকবার আমাদেরও বলেছিলেন পরপর। আমি জানি তিনি পাকা নামাজী ছিলেন, রােজা রাখতেন, নিয়মিত কোরআন পড়তেন। কাজেই তিনি মিথ্যা বলবেন বিশ্বাস করতে মন উঠতাে না।
ব্যাপারটা তাহলে কি? হ্যালুসিনেশন?
কিন্তু মােহর পাওয়ার ব্যাপারটা ও পুকুরে পড়ে যাওয়ার ব্যাপারটা?
ইসলাম ধর্মশাস্ত্রে পরীদের উল্লেখ আছে। হিন্দু শাস্ত্রে ও অপ্সরী-কিন্নরীদের উল্লেখ আছে। উর্বশী ত মর্তমানব পুরুর প্রেমেই পড়েছিল। বাইবেলেও ‘কেইরী’দের উল্লেখ আছে। আর বিশ্বের লােক-সাহিত্য আর কিংবদন্তি ত পরীদের অজস্র গল্পে পরিপূর্ণ। এ কাহিনীতে সেসব মটিফ-ই ত দেখতে পেলাম। আর এ কাহিনী এখন ত রীতিমত কিংবদন্তি।
এর সত্যতা বা বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ, দোহাই আপনাদের, আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার উদ্দেশ্য কিংবদন্তি সংগ্রহ। আপনাদের মধ্যে কেউ যদি থাকেন, তবে কাহিনীটির একটি বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ দিতে পারেন। অথবা গাল-গল্প বলে একে উড়িয়েও দিতে পারেন। কাহিনীটি আমাদের অঞ্চলে বেশ ছড়িয়েছে। এরূপ কাহিনী আপনাদের অঞ্চলেও সম্ভবত আছে। কাজেই কিংবদন্তি নিয়েই আমি খুশি। সব কিংবদন্তিরই এক লক্ষ্য। কাহিনী। আর কাহিনী ত এতে পেলাম। একটু নতুন ধরনের কাহিনী। বৈচিত্র্যপূর্ণ।
ড. আশরাফ সিদ্দিকী
— অনলাইন থেকে সংগৃহীত