কর্ম সূত্রেই শহরের পাবলিক স্কুল অথরিটির (APS) সাথে আমার দহরম মহরম। ওদের সবকটা এলেমেন্টারি, মিডল ও হাইস্কুলে আমাদের ভয়েস ও ডাটা সার্ভিস ব্যবহার করে।
APS'এর আইটি ডিরেক্টর ব্রায়ানের সাথ পরিচয় অনেকদিনের। স্কুলের ভয়েস ও ডাটা সার্ভিসে কোন সমস্যা দেখা দিলে আমি তাদের মূল কন্টাক্ট। আমার বাড়ির পাশে নতুন একটা মিডল স্কুল হতে যাচ্ছে এবং সেখানে আমাকে জয়েন্ট সার্ভের জন্য ইনভাইট জানাতে ব্রায়ান আমাকে ফোন করলো।
উপরের ঘটনা ৭ বছর আগের। শহরের পশ্চিম দিকে আমাদের বাড়ি। পূব দিকের তুলনায় বেশ উঁচুতে। নির্ধারিত স্থানে হাজির হয়ে বিস্মিত হয়েছিলাম। চারদিকের দৃশ্য হৃদয় কেড়ে নেয়ার মত। ৩৬০ ডিগ্রীর সবটাই ছবির মত। পূব দিকে পাহাড়। পশ্চিম দিকে দিগন্ত বিস্মৃত মাঠ। মাঠের শেষ প্রান্তে আদিবাসী আমেরিকানদের একটা পুয়বলো।
আমার দুই সন্তানই ঐ স্কুলের ছাত্র। অন্য একটা স্কুল হতে ট্রান্সফার নিয়ে এ বছর তাদের প্রথম যাত্রা। বাসা হতে ৪/৫ মিনিটের ড্রাইভ। একটাও ট্রাফিক লাইট পরে না যাত্রা পথে। সকালে ওদের মা ড্রপ করে আসে আর দুপুর ৩টার দিকে আমি পিক করি।
গেল শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে স্কুল হতে জরুরি একটা ফোন পেলাম। একটিভ শুটারের আশংকা করছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। অর্থাৎ কেউ একজন বন্ধুক দিয়ে স্কুলে ঢুকেছে এবং গুলি চালাচ্ছে।
স্কুল হতে আমার মেয়ে তার স্মার্ট ঘড়ি হতে ফোন করে জানালো তারা ক্লাসরুম অন্ধকার করে গোপন জায়গায় লুকিয়ে আছে। ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর না দেখলেও বুঝতে পারছি থর থর করে কাঁপছে। আমার সমস্ত শরীর মুহূর্তের মধ্যে জমে বরফ হয়ে গেল। যে বর্বরতা এতদিন মিডিয়াতে দেখতে অভ্যস্ত তা-কি শেষ পর্যন্ত নিজ দুয়ারে হাজির হল!
দিশেহারা হয়ে গাড়ি নিয়ে ঝড়ো গতিতে বেরিয়ে গেলাম।
৩ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম।
আশংকা করছিলাম হয়ত গণ্ডায় গণ্ডায় পুলিশের গাড়ির ব্যারিকেড পেরিয়ে পার্কিংলটে যাওয়া সম্ভব হবেনা।
না, তেমন কিছু চোখে পরলনা। চারদিকে একধরণের বিষণ্ণ নীরবতা কেবল। আমার মত আরও কিছু মা-বাবা উৎকণ্ঠার সাথে মূল ফটকের বাইরে অপেক্ষা করছে। একটিভ শুটিং বলতে তেমন কিছু যে ঘটছে না তা নিশ্চিত হয়ে গেলাম। বুকের দাপাদাপি কিছুটা হলেও স্তিমিত হয়ে এলো।
এবার আসল ঘটনা বের করার পালা।
খলনায়ক হিসাবে দৃশ্যপটে হাজির হলো সোশ্যাল মিডিয়া। ফেইসবুকে কেউ একজন হুমকি দিয়েছে শহরের কোন একটা স্কুলে ঢুকে নির্বিচারে গুলি চালানোর। এবং তাতেই শহরজুড়ে রেড-এলার্ট জারি করেছে APS।
প্রথমবারের স্কুলের জন্যে নির্ধারিত জায়গায় দাঁড়িয়ে কিছুটা হলেও অবাক হয়েছিলাম এমন একটা নির্জন জায়গায় নতুন একটা স্কুলের কথা ভেবে। ব্রায়ান বলেছিল এটা হবে আমাদের অঙ্গরাজ্যের অন্যতম নিরাপদ মিডল স্কুল। স্কুলে প্রবেশের জন্যে থাকবে তিন স্তরের নিরাপত্তা। বাইরের দিকে মুখ-করা দরজা ও জানালাগুলো হবে বুলেটপ্রুফ কাঁচের।
এবং বাস্তবেও স্কুলটার নিরাপত্তা নিয়ে সন্দেহ করার অবকাশ নেই। রেগুলার স্কুল-ডে'তে বাইরের কারও ভেতরে ঢুকার অনুমতি নেই। এমনকি পিতা-মাতারও না। প্রবেশের জন্যে কেবল একটা দরজা। আকারে বেশ বড়। ইন্টার-কমে যোগাযোগ করে ক্লিয়ারেন্স পেলেই কেবল অফিসে যাওয়া যায়। ওখান হতে ক্লাসরুমে যেতে চাইলে আরাও একধাপ নিরাপত্তা বলয় পেরোতে করতে হবে।
একজন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে ওদের দুজনকে তুলে দিল আমার হাতে। কয়েক জায়গায় স্বাক্ষর দিতে হলো প্রস্থানের আগে।
মেয়ে তখনো ভয়ে কাঁপছে। ছেলে তার হাইড-আউট এডভেঞ্চারের বর্ণনা দিয়ে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে উঠলো। প্রতিমাসেই তাদের স্কুলে একটিভ শুটারের ড্রিল থাকে। ছাত্রদের হাতে-কলমে শেখানো হয় বাস্তবে এমনকিছু ঘটলে তা কিভাবে মোকাবেলা করতে হবে।
নিরাপত্তার নিশ্ছিদ্র চাদরে আবৃত এ স্কুলের সমস্যা একটাই; সকালে ছাত্ররা যখন স্কুলে প্রবেশ করে তাদের ব্যাক-প্যাক পরখ করার কোন ব্যবস্থা নেই। চাইলে যে কোন ছাত্র ব্যাগে বন্দুক নিয়ে স্কুলে প্রবেশ করতে কোন বাধা পাবেনা।
আমেরিকার প্রায় প্রতি ঘরেই অস্ত্র আছে। অনেক বাড়িতে আছে অস্ত্রের ভাণ্ডার। যেনতেন একটা আইডি থাকলে দোকানে গিয়ে ১০ মিনিটের ভেতর বন্দুক কিনে তা ব্যবহার করতে কোন বাধা পেরোতে হয়না। অনেক মা-বাবা তার ৮/১০ বছরের সন্তানদের জন্মদিনে বন্দুক উপহার দেয়। বন্দুক কালচার আমেরিকানদের রক্তে। এ হতে ফেরানোর কোন রাস্তা নেই। মা-বাবা স্কুল শুটিংয়ে নিজ সন্তান হারালেও নিজের বন্দুকের ভাণ্ডার হারাতে রাজি না। আমরা যারা তৃতীয় বিশ্বের ইমিগ্রেন্ট তাদের জন্যে এ এক বিরাট ধাঁধা।
চাঁদের এ অন্ধকার দিক নিয়েই আমাদের বাস করতে হয়। প্রতিদিন বাচ্চাদের স্কুলে পাঠিয়ে উৎকণ্ঠায় থাকতে হয়। শপিং মল, মুভি থিয়েটার সহ যে কোন পাবলিক গেদারিংয়ে গেলে বন্দুক আতংক পিছু ছাড়ে না।
মাঝে মধ্যে মনে হয় ছেড়ে দেই এ দেশ! চলে যাই তাসমান পারে আমার আরেক দেশ অস্ট্রেলিয়ায়। কিন্তু চাইলেই যে পারবো তা-ও না। জীবনের হিসাব অনেক লম্বা, অনেক জটিল।