বিকেলে ভোরের গল্প - পর্ব ৬

Submitted by WatchDog on Saturday, March 13, 2021

ইউরোপ তুলনামূলক ছোট মহাদেশ। দেশ অনেক, কিন্তু একদেশ হতে অন্যদেশ আকাশ পথে রওয়না দিলে ভ্রমণ খুব একটা দীর্ঘ হয়না। ট্রেন জার্নির অবস্থাও একই রকম। ঘাটে ঘাটে সীমান্ত অতিক্রম করার ঝামেলা না থাকলে এক কোনা হতে অন্য কোনায় যেতে খুব একটা সময় লাগার কথা না। প্রতিবারের মত এ যাত্রায় আমি রওয়ান দিয়েছি পূর্ব ইউরোপের সেই সেন্ট পিটার্সবার্গ হতে। পোল্যান্ড হয়ে পূর্ব জার্মানীর রাজধানী পূর্ব বার্লিন পর্যন্ত আসতে সময় লেগেছে গোটা একটা দিন ও দুটো রাত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যায় হয়েছে বিভিন্ন সীমান্তে। একদিকে ইমিগ্রেশন অন্যদিকে কাস্টমস। তার উপর পোলিশ সীমান্তে ট্রেনের চাকা বদল। এসব বাধা না থাকলে দ্রুত গতির ট্রেনে সময় নিশ্চয় কমে আসতো। তবে এ নিয়ে আমার কোন অভিযোগ ছিলনা। গ্রীষ্মের এ সময়টা গোটা ইউরোপ নতুন সাজে সজ্জিত হয়। কেবল প্রকৃতিই নয়, মানুষগুলোও শীতের খোলস হতে বেরিয়ে নিজেদের তুলে ধরতে ব্যস্ত হয়ে পরে। বিশেষকরে মেয়েরা। পরিবর্তনটা প্রথম চোখ লাগে তাদের পোশাকে। উপভোগ করতে অভ্যস্ত হয়েগেছি এসব দৃশ্য।

এ পথে অনেকবার ট্রেন ধরে ইংল্যান্ড গেছি। কখনো হল্যান্ড হয়ে, কখনো আবার বেলজিয়াম হয়ে। প্রতিটা জার্নি ছিল ইউনিক। হরেক রকম মানুষের সাথে দেখা হয় লম্বা এ পথে। ভাষার বৈচিত্র এতটাই বেশী মাঝে মধ্যে খেই হারিয়ে ফেলতে হয় ট্রেনের কোঅর্ডিনেশন নিয়ে। বার্লিন হতে একবার নেদারল্যান্ডের হোক ভ্যান হলান্ড গামী ট্রেনে চেপে বসেছি। বরাবরের মত সীটে বসে বাইরের পৃথবী দেখছি। লম্বা এসব জার্নিতে জানালার পাশে বসলে এমনিতেই তন্দ্রা এসে যায়। পশ্চিম জার্মান শহর হ্যানোভারে ট্রেন ভাগ হয়ে যায়। কিছু বগি আলাদা করে জোরা লাগানো হয় বেলজিয়ামগামী ট্রেনের সাথে। আমি ভুল ওয়াগনে বসে আছি তা বুঝতে পারিনি। বেলজিয়াম সীমান্তে ইমিগ্রেশন পার হয়েছি বিনা বাধায়, কারণ আমার ট্রানজিট ভিসা ছিল BENELUX এর। যা বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড সহ লুক্সেওবার্গকেও কভার করছিল। ট্রেন ব্রাসেলস আসার পরও সন্দেহ হয়নি। ভেবেছিলাম হয়ত ব্রাসেলস হয়ে রটোরড্রামের দিকে যাবে। নতুন সীমান্তে ফ্রেঞ্চ ভাষা শুনতেই ভয়টা চেপে ধরলো। আমি ভুল পথে রওয়ানা দিয়েছি।

আমি নিজকে আবিস্কার করলাম ফ্রান্সের সীমান্তে। দেশটার ইমিগ্রশনের হাতে পাসপোর্ট তুলে দিতেই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। ফ্রান্স যাওয়ার ভিসা নেই আমার। ট্রেন হতে নেমে বর্ডার পোস্টে যেতে বাধ্য করলো আমাকে। সবকিছু খুলে বললাম ওখানে। নতুন করে বেলজিয়াম হয়ে নেদারল্যান্ড যাওয়ার অর্থ ছিলনা আমার পকেটে। হাতের টিকেট উলটে পালটে দেখে ফ্রেঞ্চ ভাষায় কি যেন একটা লিখে দিল ওরা। সান্তনা দিল, হাতের টিকেট দিয়েই নাকি শেষ গন্তব্যে যাওয়া যাবে। এবং উৎকন্ঠার চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত পৌছে ছিলাম হোক ভ্যান হল্যান্ড বন্দরে।

পূর্ব বার্লিনের কফি শপটায় বসে অলস কিছু সময় কাটাতে বাধ্য হলাম। প্রতিবারই তাই করি। এ শহরে দেখার মত তেমন কিছু নেই। যা দেখার তা দেখতে গেলে মন খারাপ হয়ে যায়। শহরের সবকিছুতে যুদ্ধের স্মৃতি। শহরের প্রতিটা দেয়াল, রাস্তা-ঘাটের নিজস্ব কিছু কথা আছে। আছে ধ্বংস ও মৃত্যুর কাহিনী। দেশটার কম্যুনিষ্ট সরকার সযত্নে লালন করে চলছে এসব কথা। নতুন প্রজন্মের জন্যে সৃষ্টি করে রেখেছে মগজ ধোলাই কারখানা। এসব কথা বাইরে আসেনা। রাস্তায় হাঁটলে বুঝা যাবেনা। কিন্তু বাতাসে কান পাতলে এখনো শোনা যাবে ১৯৪৫ সালের মে মাসের তান্ডব। শোনা যাবে পূব দিক হতে আসা সোভিয়েত ট্যাংক বহরের ভারী আওয়াজ। পূর্ব বার্লিনে প্রথম বার পা রেখেই এর অলিগলি হেটে নিয়েছি। Brandenburg Gate, Reichstag Building'র মত ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও অনুভব করার চেষ্টা করেছি ইতিহাসের স্পন্দন।

সকাল সাড়ে নয়টায় বৃটিশ এম্বেসি তার ভিসা কার্যক্রম শুরু করে। হাতের ঘড়ির দিকে তাকাতেই ওদিকটায় রওয়ানা দেয়ার তাগাদা অনুভব করলাম। খোলার সাথে সাথে ঢুকতে পারলে তালিকায় প্রথম হওয়া যায়। এবং ঘণ্টা খানেকের ভেতর ভিসা প্রক্রিয়া শেষ করে বাকি কাজ করার যথেষ্ট সময় হাতে থাকে। অবশ্য আমার মত পূর্ব ইউরোপের অন্য দেশ হতে ভিসা প্রার্থীর সংখ্যা এখানে একেবারে হাতে গোনা। মূলত যারা আসে তারা বয়স্ক পূর্ব জার্মান। নির্দিষ্ট একটা বয়সের পর পূর্ব জার্মানদের পশ্চিম ইউরোপের যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়। তাও এক লম্বা প্রক্রিয়ার পর। বাইরের জানালা গলে ভেতরে চোখ বুলাতে মন হালকা হয়ে গেল। ভিসা সেকশনে তেমন কেউ নেই।

এম্বসেরি মূল ফটকে চুল হতে মাথা পর্যন্ত পরখ করার পর পাসপোর্ট পরীক্ষা করলো। এর আগেও এখান হতে ভিসা সংগ্রহ করেছি। ওটাই ছিল আমার ক্লিয়ারেন্স। ভেতরে ঢুকে চেনা পথ গলে হাজির হলাম ভিসা সেকশনে। যান্ত্রিক একটা হাসি দিয়ে এক সেট ফর্ম চাইলাম। পালটা কোন হাসি না পেলেও ফর্ম পেতে দেরী হলোনা। লম্বা ফর্ম। প্রশ্ন অনেক। তবে এসবের উত্তর আমার মুখস্ত হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। অনেকটা যান্ত্রিক কায়দায় পূরণ করে দ্রুত জমা দিলাম কাউন্টারে। সাথে ফী। মিনিট দশেক পর কাউন্টারে ডাক পরলো। তাদের প্রশ্ন একটাই; মস্কো হতে ভিসা না নিয়ে কেন এখানে এসেছি? উত্তর আমার মুখস্ত ছিল। সেন্ট পিটার্সবার্গ হতে মস্কো প্রায় ৮/৯ ঘণ্টার ট্রেন জার্নি, এবং তা উলটো দিকে। তাছাড়া মস্কো যেতে আমার মত বিদেশীদের ভিসা লাগে। ওখানে হোটেলে থাকতে গেলে ইন্টারনাল ভিসা দেখানো বাধ্যতামূলক। মস্কোস্থ বৃটিশ দূতাবাসে ভিসার জন্যে লম্বা লাইন দিতে হয়। এবং তার জন্যে সকাল ৭টার ভেতর ওখানে হাজির হতে হয়। বৃটিশদের কনভিন্স করার জন্যে আমার কারণ গুলো যথেষ্ট ছিল। প্রথম বার ভিসা নেয়ার সময়ই তা বুঝে নিয়েছিলাম। নিশ্চিত না হয়ে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এখানে ভিসা নিতে আসতাম না।

বৃটিশ দূতাবাস হতে ভিসা নিয়ে বের হতে ১১টা বেজে গেল। ইতিমধ্যে পূর্ব বার্লিন শহর জেগে উঠেছে। চারদিকের ব্যস্ততা চোখে পরতে বাধ্য। তবে এসব ব্যস্ততা কোন অর্থেই পশ্চিম ইউরোপের ব্যস্ত কোন শহরের মত না। শ্রীহীন সোভিয়তে গাড়ি, চাকচিক্যহীন ধীরগতির ট্রাম্প, লম্বা ট্রলিবাস ও সাথে বিক্ষিপ্ত জনমানুষের চলাচল কোনভাবেই পাশের পশ্চিম বার্লিনের চেহারার সাথে মেলানো যাবেনা। একই মহাদেশে যেন ভিন্ন দুই পৃথিবী। রাস্তায় দেখা মানুষের চেহারা ও পোশাকেও পার্থক্য ধরা পরতে বাধ্য। এখানের সবকিছুই কেমন মলিন এবং অনেকটা স্থবির।

ইতিহাস ভুগোল ভেবে নষ্ট করার মত সময় ছিলনা আমার হাতে। বেশকিছুটা হাঁটতে হবে শহরের রাস্তা ধরে। তারপর উঁচু একটা দালানের লিফট ধরে উঠতে হবে বেশকিছুটা উপরে। গন্তব্য, নেদারল্যান্ড দূতাবাস। ওখানেও ভিসা নিতে হবে।

-চলবে


ভালো লাগলে শেয়ার করুন