সোনালী ব্যাংকের কয়েক হাজার নথি হলমার্কের দপ্তরে
সোনালী ব্যাংকের নিরীক্ষা বিভাগ ব্যাংকটির পাঁচ হাজার ৬০০ নথি উদ্ধার করেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দপ্তর থেকে। এর মধ্যে বেশির ভাগ নথিই উদ্ধার হয়েছে হলমার্ক গ্রুপের দপ্তর থেকে।
নথিপত্রে দেখা যায়, নয় হাজার ১৭১টি স্থানীয় ব্যাক-টু-ব্যাক ঋণপত্রের (এলসি) মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা (সাবেক শেরাটন হোটেল) শাখা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ‘ঋণসুবিধা’ দিয়েছে। অথচ এ-সংক্রান্ত অনেক নথিই এখন ব্যাংকে পাওয়া যাচ্ছে না।
সোনালী ব্যাংকের করা নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আরও একটি তথ্য দেওয়া হয়েছে। যেমন, রূপসী বাংলা শাখায় সোনালী ব্যাংকেরই একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ‘আউটসোর্সিং’ জনবল হিসেবে কাজ করেন। এই লোকটির বেতন দেয় ওই শাখা থেকে ঋণসুবিধা নেওয়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে হলমার্ক গ্রুপও রয়েছে। ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈদেশিক বাণিজ্যসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজে ওই লোকের ওপর শাখার ছিল অতিশয় নির্ভরতা। অথচ তিনি রমনা শাখায় থাকাকালীন বিভিন্ন অনিয়মের জন্য অভিযুক্ত ছিলেন।
এ রকম অনেক চমকপ্রদ ঘটনা ঘটেছে সোনালী ব্যাংকে। এসব ঘটনায় খোদ সোনালী ব্যাংকই বিস্মিত। ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এ ধরনের কিছু ঘটনার বিবরণ দিয়ে মন্তব্য করা হয়েছে, ‘ব্যাংকিং জগতে এসব বিস্ময়কর ঘটনা বলে প্রতীয়মান হয়েছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, হলমার্ক নিয়ে সোনালী ব্যাংকে এত সব বিস্ময়কর ঘটনা ঘটল অথচ কেউ জানতে পারল না, এটাও তো বিস্ময়কর ঘটনা।
কাকতালীয় কিছু ঘটনাও আছে সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি নিয়ে। রূপসী বাংলা শাখার ওপর তদন্ত করতে গত মে মাসে পরিদর্শক দল পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক। তদন্ত চলাকালে উপস্থিত হন প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য উপদেষ্টা সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী। তিনি তদন্ত দলের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন, নিজের একটি ভিজিটিং কার্ডও দেন।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গতকাল বুধবার সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখার পাঁচজন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। সে সময় একাধিক কর্মকর্তা হলমার্ক কেলেঙ্কারির সঙ্গে বাইরের প্রভাবশালী এবং ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জড়িত ছিলেন বলে জানিয়েছেন। সে সময় সাংবাদিকদের কাছে সাইদুর রহমান নামের একজন কর্মকর্তা সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীর নাম উচ্চারণ করে বলেন, ‘তিনি নিয়মিত রূপসী বাংলা শাখায় যেতেন।’ বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, নিরীক্ষা চলাকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরীক্ষা দলকে হলমার্ক নিয়ে বেশি কিছু না করার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল।
সব মিলিয়ে রূপসী বাংলা শাখা থেকে আত্মসাৎ করা অর্থের মোট পরিমাণ তিন হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে হলমার্ক গ্রুপ একাই নিয়েছে দুই হাজার ৬৮৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একটি ব্যাংকে একটি শাখায় এবং একটি প্রতিষ্ঠানের এত বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ব্যাংকিং জগতে বিরল। এ রকম কোনো উদাহরণ কেউ-ই দিতে পারেননি।
মূলত সোনালী ব্যাংকের এই শাখা ছিল হলমার্ক গ্রুপের জন্য অভয়ারণ্য। অর্থ আত্মসাতের সব ধরনের সুযোগই করে দেন ব্যাংকের কর্মকর্তারা। ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের কয়েকজন সদস্যও জড়িত ছিলেন এর সঙ্গে। বর্তমান সরকারদলীয় একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তিরও সংশ্লিষ্টতা আছে এই ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুরোধে হলমার্ক কেলেঙ্কারি এখন তদন্ত করছে দুদক। বাংলাদেশ ব্যাংক দুদককে লেখা এক চিঠিতে এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে সোনালী ব্যাংকের পর্ষদের ভূমিকা খতিয়ে দেখতেও অনুরোধ করেছে। সোনালী ব্যাংকের অন্যতম পরিচালক, আওয়ামী লীগের নেত্রী জান্নাত আরা হেনরির বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। আরও কয়েকজন পরিচালকের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে। সোনালী ব্যাংকের পরিচালক হয়েই কেউ কেউ বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক হয়েছেন বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।
সোনালী ব্যাংক গতকাল হলমার্ক কেলেঙ্কারি নিয়ে একটি ব্যাখ্যা পাঠিয়েছে। ব্যাখ্যায় সবকিছুর জন্য ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দায়ী করা হয়েছে। ব্যাংকটি ব্যাখ্যায় বলেছে, ‘পরিচালনা পর্ষদ মনে করে, ব্যাংকের কিছু অসাধু ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার যোগসাজশে ভুয়া ঋণপত্রসহ (এলসি) নানা জালিয়াতির মাধ্যমে কয়েকটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এই বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করেছে।’
ব্যাখ্যায় আরও বলা হয়েছে, নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের প্রতিটি শাখা বছরে দুবার নিরীক্ষা হওয়ার কথা থাকলেও অজ্ঞাত কারণে সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা নিরীক্ষা করা হয়নি। নিরীক্ষা পরিচালনার দায়িত্ব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের। নিয়মিত নিরীক্ষা করা হলে অনিয়ম বেরিয়ে আসত। আবার নিয়মানুযায়ী, কোনো কর্মকর্তার এক শাখায় তিন বছরের বেশি থাকার কথা নয়। রূপসী বাংলা শাখার উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) এ কে এম আজিজুর রহমানকে পদোন্নতি দেওয়ার পরও ওই শাখায় রাখা হয়। প্রায় পাঁচ বছর তিনি কর্মরত ছিলেন। তাঁকে বদলির দায়িত্ব ছিল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি)। তৎকালীন এমডি কেন এই কর্মকর্তাকে বদলি করেননি, তা পর্ষদের বোধগম্য নয়। অথচ পরিচালনা পর্ষদের নির্দেশনা ছিল, তিন বছরের মধ্যে যেকোনো কর্মকর্তাকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বদলি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে এই নির্দেশ পরিপালন করা হয়নি।
আবার এ কে এম আজিজুর রহমানের প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান গত মঙ্গলবার অর্থমন্ত্রীর কাছে পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলেছেন, ‘বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে অনিয়মের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সোনালী ব্যাংকের নিরীক্ষা বিভাগের প্রতিবেদনে তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করা হয় এবং পরবর্তীতে তাঁকে পদোন্নতি দেওয়া হয়।’
সূত্র জানায়, সাবেক এমডি হুমায়ুন কবিরের মেয়াদ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন পর্ষদের একাধিক সদস্য। বাইরের প্রভাবশালীরাও একই ধরনের প্রতিশ্রুতি দেন। এই সময়ের মধ্যেই নানা ধরনের অনিয়ম আর দুর্নীতি ঘটে হলমার্ক নিয়ে। সোনালী ব্যাংকসংশ্লিষ্ট অনেকেই এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে একজন উপব্যবস্থাপনা পরিচালকের (ডিএমডি) সংশ্লিষ্টতা বেশি বলে মনে করেন। ওই ডিএমডি সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ট্রুথ কমিশনে গিয়ে দুর্নীতির বিবরণ দিয়েছিলেন বলে জানা যায়।
সূত্র আরও জানায়, ডিএমডিকে প্রথমে আরেকটি ব্যাংকে বদলি করা হয়েছিল। কিন্তু সেই ব্যাংক অতীত ইতিহাসের জন্য তাঁকে রাখতে চায়নি। পরে তাঁকে সোনালী ব্যাংকে বদলি করা হয়।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, পর্ষদের সুপারিশে ব্যাংকের এমডি ও ডিএমডি নিয়োগ দেয় সরকার। এখন সেই এমডি বা ডিএমডি যদি ব্যর্থ হন, তাহলে এর দায়দায়িত্ব নিয়োগকর্তার। সুতরাং, নিয়োগপদ্ধতির সংস্কার করাও এখন প্রয়োজন।
পর্ষদ সবকিছুর দায় ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওপর চাপিয়ে দিলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে, ‘সোনালী ব্যাংকের সংঘবিধি অনুযায়ী, যাবতীয় ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড দেখভালসহ ব্যাংকের পরিচালনার দায়িত্ব সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের। ফলে সোনালী ব্যাংকের সংঘটিত অনিয়মাদির সামগ্রিক দায়দায়িত্ব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ওপরই বর্তায়।’
সূত্র জানায়, রূপসী বাংলা শাখা থেকে যে ছয়টি প্রতিষ্ঠান অর্থ আত্মসাৎ করেছে, তার একটি পর্ষদের একজন সদস্যের আত্মীয়।
হলমার্ক কেলেঙ্কারির দায় এখন একে অন্যের ওপর চাপানোর চেষ্টা চলছে। একটি মহল হলমার্ক গ্রুপকে ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়ার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। হলমার্ক গ্রুপের শীর্ষস্থানীয় লোকজনও সরকারের বিভিন্ন মহলে যোগাযোগ করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংককে ‘ধীরে চলো নীতি’ নেওয়ারও পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তবে ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এটি কেবল অনিয়ম নয়, বরং জালিয়াতির ঘটনা। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদও মনে করেন, এই ঘটনার অবশ্যই বিচার হওয়া উচিত।
তারিখ: ৩০-০৮-২০১২
সূত্র: প্রথম আলো