বিরোধপূর্ণ জমি ইজারা নিয়ে দখল করলেন বনমন্ত্রীর স্ত্রী
বান্দরবান প্রতিনিধি | আপডেট: ০২:১৩, অক্টোবর ০৩, ২০১৩ | প্রিন্ট সংস্করণ
বান্দরবানের চেমি মৌজায় পরিবেশ ও বনমন্ত্রী হাছান মাহমুদের স্ত্রীর নামে ইজারা হস্তান্তরিত বিরোধপূর্ণ জমি প্রশাসন থেকে বুঝিয়ে দেওয়ার আগেই তাঁরা নিজেরা দখল করে নিয়েছেন।
ওই জমিতে মন্ত্রীর ছোট ভাই দুজন সাজাপ্রাপ্ত সন্ত্রাসীকে নিয়ে কাপ্তাই বাঁধে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মালিকানার রাবার, চা ও বাঁশবাগান এবং প্রাকৃতিক বন কেটে ধ্বংস করে দিয়েছেন বলে স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন। সেখানে শান্তিশৃঙ্খলা ও স্থিতাবস্থার জন্য ১৪৫ ধারা জারি করা হয়েছে। এ ছাড়া, জমিটি ইজারা হওয়ার প্রক্রিয়া নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক কে এম তারিকুল ইসলাম গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, বান্দরবান-চন্দ্রঘোনা সড়কের গলাচিপা উত্তর খৈয়াপাড়া এলাকায় হাছান মাহমুদের স্ত্রী নুরান ফাতিমার নামে নাম পরিবর্তন হওয়া ইজারার জমি বুঝিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে কথা হয়েছিল। কিন্তু নির্ধারিত তারিখের দুই দিন আগে মন্ত্রীর লোকজন জায়গাটি দখল করে নেয়।
সাংবাদিকেরা এ বিষয়ে খোঁজখবর করতে গত শুক্র ও সোমবার ঘটনাস্থলে গেলে মন্ত্রীর লোকজন বলে পরিচয়দানকারীরা ধারালো অস্ত্র ও লাঠিসোঁটা নিয়ে তাঁদের ধাওয়া করে। সোমবার পুলিশ ও সেনাবাহিনী ওই জায়গায় ১৪৫ ধারার নোটিশ ঝুলিয়ে দিয়েছে। শান্তিভঙ্গের আশঙ্কায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইশরাত জামান ওই জমিতে এ ধারা জারি করেছেন।
জেলা প্রশাসক বলছেন, জাতীয় পার্টির সাবেক সাংসদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ১৯৯৪-৯৫ সালে চেমি মৌজায় ২৫ একর জমি রাবার বাগান করার জন্য ইজারা নেন। ওই জমিই বন ও পরিবেশমন্ত্রীর স্ত্রীর নামে পরিবর্তন করা হয়েছে। জায়াগাটি প্রাথমিকভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হলেও পরে জানা যায়, ওই জমি কাপ্তাই বাঁধে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে বন্দোবস্ত দেওয়া রয়েছে। তাই বিরোধপূর্ণ জায়গাটি উভয় পক্ষের উপস্থিতিতে আবার মাপজোখ করে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে ২৯ সেপ্টেম্বর তারিখ ধার্য করা হয়। কিন্তু ২৬ তারিখেই তাঁরা জায়গাটি দখল করে বন পরিষ্কার করে ফেলেছেন।
পার্বত্য শান্তি চুক্তি ও জেলা পরিষদ আইন (৬৪ ধারা) অনুযায়ী জেলা পরিষদের পূর্বানুমোদন ছাড়া কোনো জমি ইজারা প্রদান, বন্দোবস্ত, ক্রয়বিক্রয় বা কোনোভাবে হস্তান্তর করা যায় না। কিন্তু জেলা প্রশাসক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর জমি হাছান মাহমুদের স্ত্রীর নামে করে দিয়েছেন জেলা পরিষদের অনুমোদন ছাড়াই। তিনি বলছেন, ১৯০০ সালের পার্বত্য শাসনবিধি অনুযায়ী ইজারা হস্তান্তর জেলা পরিষদের অনুমোদন ছাড়া করা সম্ভব।
তবে চেমি মৌজার হেডম্যান (মৌজাপ্রধান) পুলু প্রু বলছেন, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর রাবার প্লট ২০০৯ সালে বাতিল হয়েছে। জমিতে বাগান না করলে ইজারা বাতিল হয়ে যায়। এর ইজারা কীভাবে পুনর্বহাল হয়েছে তা রহস্যজনক। শুধু তাই নয়, এ সময় জমির চৌহদ্দি পরিবর্তন করে কাপ্তাই বাঁধের ক্ষতিগ্রস্তদের জমি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী অবশ্য দাবি করেছেন, পুনর্বহাল হওয়ার পর ইজারা এখনো তাঁরই রয়েছে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ইজারা চুক্তি অনুযায়ী জমি হস্তান্তর করা সম্ভব নয়। তিনি মন্ত্রীকে জমিটা কেবল উন্নয়নের জন্য দিয়েছেন।
এদিকে পুনর্বাসন সূত্রে জমির মালিকানার দাবিদার ফজল আহমদ (পুলিশের সাবেক সদস্য) ও সৈয়দুর রহমান বলেছেন, কাপ্তাই বাঁধে জমিজমা ডুবে যাওয়ায় তাঁদের বান্দরবান-চন্দ্রঘোনা সড়কের উত্তর খৈয়াপাড়া এলাকায় পুনর্বাসন করা হয়েছিল। তাঁদের সেখানে বি-ফরমের পাঁচ একর জমিসহ (ডুবে যাওয়া জমির পরিবর্তে জমি) ২২ একর বন্দোবস্তির জমি রয়েছে। ওই জমির বিপরীতে তাঁরা চা-বাগান করার জন্য কৃষি ব্যাংক থেকে প্রায় ১৭ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। ঋণের টাকায় করা তাঁদের চা, বাঁশ ও রাবারবাগান কেটে সাফ করে দিয়েছে মন্ত্রীর লোকজন।
সোমবার গিয়ে দেখা যায়, সড়কের পশ্চিম পাশে ৪৫-৫০ জন বাঙালি ও পাহাড়ি শ্রমিক কাজ করছেন। সেখানে হাছান মাহমুদের লোক পরিচয়দানকারী মো. ওসমান ও আবুল মনসুর বলেছেন, মন্ত্রীর ছোট ভাই এরশাদ মাহমুদ ও মুরাদ মাহমুদের তত্ত্বাবধানে তাঁরা কাজ করছেন। ছবি তুলতে গেলে তাঁরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং সাংবাদিকদের ধাওয়া করেন। স্থানীয় লোকজন বলেন, ওসমান ও মনসুর ২০০২ সালে রাজবিলার মারমাপাড়ায় হামলা ও লুটপাটের ঘটনার মামলায় দুই বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি। বান্দরবান সদর থানার উপপরিদর্শক ইকতিয়ার আহমেদ বলেন, মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালত ২০১০ সালে তাঁদের বিরুদ্ধে রায় দেন।
এ ব্যাপারে একাধিকবার যোগাযোগ করেও বনমন্ত্রীকে পাওয়া যায়নি। তাঁর স্ত্রীর মুঠোফোনে যোগাযোগ করেও কথা বলা যায়নি। মন্ত্রীর ভাই এরশাদ মাহমুদকে ফোন করলে তিনি গালিগালাজ করে তাঁকে নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার জন্য বলেন। আরেক ভাই মুরাদ মাহমুদ বলেন, মন্ত্রী কাপ্তাই বাঁধের কারণে পুনর্বাসিত ওই লোকজনের সঙ্গে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁরা দেখা না করায় সমস্যা হয়েছে।
তবে মঙ্গলবার রাতে জেলা প্রশাসক জানান, বিরোধপূর্ণ জমি উভয় পক্ষের উপস্থিতিতে মাপজোখ করার জন্য মন্ত্রী তাঁর লোকজনকে নির্দেশ দিয়েছেন। সিদ্ধান্ত হয়েছে, ৭ অক্টোবর এটা করা হবে।
http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/52497