পীর হাবিবুর রহমান, বিশেষ প্রতিনিধি, দৈনিক যুগান্তর:
একসময় সারা দেশে শীত নামলেই যাত্রা, বাউল গান, কবিয়াল লড়াইয়ের আসর বসতো। গ্রাম-গঞ্জে। গ্রামীণ জ্যোতস্নার শহর, হাওরের রাজধানী সুনামগঞ্জেও হতো। যাত্রায় ট্রাজেডি, সংলাপ প্রক্ষেপণ যেমন ভিন্ন স্বাদের, তেমনি একজন সূত্রধর বা বিবেক গানে গানে হাজির হলে দর্শকদের হূদয় দোলা দিয়ে উঠত। যাত্রার সূত্রধর গল্পের সূত্র ধরিয়ে সত্য উদঘাটন করতেন। অর্থাত যাত্রার কাহিনীর সূত্র ধরিয়ে দিতেন। সবার বিবেক জাগাতে সূত্রধরের ভূমিকা ছিল অসাধারণ। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে শেরেবাংলা নগরে যাত্রার আসর বসিয়ে প্রিন্সেস লাকী খানকে হার্টথ্রব করা হয়। তাকে ঘিরে তারুণ্যের উম্মাদনা সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। এসএসসি পরীক্ষা চলাকালে আমাদের শহরের যাত্রা-পালায় প্রিন্সেস রত্নার নাচ দেখতে ঘরের দরজা খুলে মধ্যরাতে চলে গিয়েছিলাম। প্রিন্সেসের নাচের তালে তালে সামনের সারির দর্শকদের টাকা ছুড়তে দেখেছি। সারারাতের যাত্রা-পালায় বিবেকের গানে অনেক দর্শক অশ্রুসজল হতেন। তাদের বিবেক জাগ্রত হতো। শহরের অনেক বয়স্কদেরও প্রিন্সেসের নাচ দেখে পুলকিত হতে দেখেছি। এখন দেশে তেমন যাত্রা-পালা হয় না। তবু মাঝে-মধ্যে শীত নামলে যাত্রা-পালা হয়, আর বিবেক হাজির হতে দেখা যায়। বর্তমানে গাবতলী ও মিরপুরের যাত্রা-পালায় সূত্রধর বা বিবেককে পাওয়া যায়। মানে বিবেক আমাদের যাত্রায় আছে, রাজনীতিতে নেই। তাই এই রুগ্ন রাজনীতিতে কর্মীদের কোনো সমাদর নেই। স্বৈরশাসক যেমন দেশ চালায় তেমনি প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নেত্রীর হুকুমে চলে তাদের দলীয় রাজনীতি। এখানে সূত্রধরের ভূমিকা নিতে গিয়ে একবার আওয়ামী লীগ ছাড়তে হয়েছিল ড. কামাল হোসেনকে। বিএনপিতে সূত্রধরের ভূমিকা নিতে গিয়ে বহিষ্কার হয়েছেন আবদুল মান্নান ভূঁইয়া। আওয়ামী লীগে গঠনতন্ত্র ও আয়োজন গণতান্ত্রিক হলেও নেত্রীর ইচ্ছাই সিদ্ধানত্দে পরিণত হয়। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভার নামে যে সাজানো কর্মিসভার আয়োজন করা হয়েছিল সেখানে একজন বিবেক পাওয়া গেলো না যে দাঁড়িয়ে বলবে, দলের অভ্যনত্দরে গণতন্ত্র চালু করুন, মনোনয়ন বাণিজ্য দমন করুন। ২৭ বছরের ব্যর্থ নেতৃত্বকে দলীয় দায়িত্ব থেকে বিদায় দিন। কার কথায় খেলাফত মজলিসের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল? আইএসআই'র কাছ থেকে নির্বাচনি অর্থ সংগ্রহের অভিযোগ তদনত্দ করুন। সংলাপে যোগদিন। আদালত অবমাননা না করে নেত্রীর মুক্তির জন্য আইনি লড়াইয়ের মুখোমুখি হোন। বিএনপির সঙ্গে আঁতাত করে 'চোরে চোরে মাসতুতো ভাই' সম্পর্ক গড়ে পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতির দায় কাঁধে নিবেন না।
এ সভায় ৭৪ জেলার মধ্যে ৭২ জেলাই তোতা পাখির মতো শেখানো বুলি আউড়েছে, 'নো হাসিনা, নো ডায়ালগ, নো ইলেকশন'। বর্ধিত সভার বক্তৃতা দেখে ওয়ার্কিং কমিটিও আত্দসমর্পণ করেছে। তারাও একই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, আওয়ামী লীগ সংলাপ শুরুর আহ্বান জানিয়েছিল সেই আওয়ামী লীগ হাসিনা ছাড়া সংলাপ নয় বলে সংলাপকে 'ডেড-লক' করেছে। সুযোগ নিয়েছে বিএনপি-জামাত। আওয়ামী লীগকে তাদের পাল্লায় নিতে পারলেই ষোলকলা পূর্ণ। আত্দবিস্মৃত জাতি যেন একে একে সব ভুলে যাচ্ছে। 'হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী মেনেছিলেন খালেদা' এবং 'যদি রাজদণ্ড দাও, আষাঢ়ে পূর্ণিমা রাতে দিও - দুই নেত্রী অবসর নিলে হাওর দেখাতে নিব' শিরোনামে আমাদের সময়ে লেখা দুটি সাড়া জাগিয়েছে। প্রচুর প্রশংসা, বেশকিছু দলকানাদের আক্রোশ, সমালোচনা উপলব্ধি করেছি। তবুও গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরে রাজনীতির সাফল্যের শিখরের উঠে আসা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শের সনত্দান হিসেবে বিতর্ক স্বাগত জানাই। আমার লেখার উন্মাদনায় রাজনীতির আলোকিত মানুষ, সৃজনশীল, মেধাবী, পণ্ডিত মাহমুদুর রহমান মান্না যখন কলম ধরলেন তখন আমি তাকে রাজনীতির কঠিন সময়ে পিচ্ছিল পথে উঠে আসা সেই বিবেক বা সূত্রধরের সাহসী ভূমিকায় দেখলাম। আমি তার মার্জিত, পরিশীলিত সাহিত্যের রসবোধ দিয়ে অসাধারণ লেখাটি পড়ে অভিভূত ও মুগ্ধ হয়েছি। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের নায়ক তোফায়েল আহমদের পর আমাদের কৈশোর ও প্রথম তারুণ্যের নায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। ডাকসুর দু'বারের ভিপি মান্না যখন আমার লেখার প্রশংসা করে প্রায় কাছাকাছি ইতিবাচক ক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তখন তার অনুজ হিসেবে কেবল মান্নার প্রতিই আমার মাথানত হয়নি, হয়েছে সেই সব বিবেকবান ছাত্র সমাজের প্রতি ও যারা সুদর্শন, রোমান্টিক মান্নাকে ডাকসুতে বিজয়ী করেছিলেন। মাহমুদুর রহমান মান্নার বিবেক এখনো অন্ধ হয়নি। মেরুদণ্ড হয়নি নূ্যব্জ। তাই তিনিও আমার মতো একজন মাহাথির মোহাম্মদের স্বপ্ন দেখেন। যিনি দৃঢ়তার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়ে জাতিকে দুর্নীতির কলঙ্ক থেকে মুক্ত করে নিজে সমসত্দ স্বজনপ্রীতির ঊধের্্ব থেকে বাংলাদেশকে মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুরের কাছাকাছি নিয়ে যাবেন। মান্না অসংখ্যবার দলীয় ফোরামে সত্য উচ্চারণ করেছেন সাহসের সঙ্গে। আমি তাকে আবারো অভিবাদন জানাই। আমি গৌরববোধ করি মান্না আমার অগ্রজ, আমার দেশের রাজনীতির সূত্রধর। মান্না তখন আমাদের কবিতা ও গানের শহরের জামাই হননি। রাজনৈতিক সফরে গেলে আমার স্কুলজীবনের বন্ধু দেওয়ান ইমদাদ রেজার বাসায় উঠতেন। ছোটদের রাজনীতি, ছোটদের অর্থনীতি ছাড়া তেমন রাজনৈতিক বই পড়া হয়নি। নির্মলেন্দু গুণের অসমাপ্ত কবিতা ও হুলিয়া তখন মুখসত্দ ছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কেউ কথা রাখেনিও অনর্গল বলতে পারতাম। ওই সময়ে ছাত্র রাজনীতির নায়ক এসেছেন জেনে ইমদাদের বাসায় গিয়ে মান্নাকে নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতাম। কাবু করার প্রশ্নই ওঠে না।
ডাকসুর আরেক নায়ক আখতারুজ্জামান আমার ওই অভ্যাসের কারণে এখনও মনে করেন আমি তাদের রাজনীতির কর্মী ছিলাম। জাসদের রাজনীতিতে সৃজনশীল নেতাকর্মীদের পাশাপাশি একধরনের বেয়াদবের আচরণে হলো ক্যান্টিনে যেতে বিব্রতবোধ করতাম। তাদের উন্নাসিক আচরণ দেখে বিস্মিত হতাম মান্নার মতো ভদ্র বিনয়ী মানুষ জাসদ করেন। নিজেকে প্রশ্ন করেছি, মাহমুদুর রহমান কেন রবীন্দ্রনাথের শানত্দি নিকেতন বেছে না নিয়ে বটতলা বেছে নিয়েছিলেন। আমি মাহমুদুর রহমান মান্নার জাসদ-বাসদ রাজনীতির সমালোচক হলেও তার প্রতি যে মোহ কৈশোরে লালন করেছিলাম পরিণত বয়সে সেটি গভীর শ্রদ্ধায় রূপ নেয়। তাকে আওয়ামী লীগে দেখলেই বলি_ রাজনীতি ছাড়-ন লেখালেখি করুন। আপনার লেখক সত্তা পাঠককে কিছু দিতে পারবে। বঙ্গবন্ধুর সাদাকালো যুগের আদর্শ থেকে সরে যাওয়া আওয়ামী লীগ করে নায়ক হওয়া যাবে না, খলনায়ক হওয়া যাবে। মানুষ এখন রাজনীতিতে নায়ক দেখে না। একেক দলে একেকজন দাস দেখে। রাজনীতির নায়ক হতে হলে চ্যালেঞ্জ নিয়ে সমমনাদের সঙ্গে করে নতুন দল করুন। ডাকসুতে মান্নার কাছে ওবায়দুল কাদের দুইবার ও আখতারুজ্জামানের কাছে একবার পরাজিত হয়েছেন। সেই কাদেরের ওপরে দূরে থাক সাবের চৌধুরীর নিচে তাদের নাম স্থান পেয়েছে দলীয় কমিটিতে। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের কারো গ্লানি আছে বলে মনে হয় না। এখানে যোগ্য লোকের কদর নেই। উপমহাদেশের বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের পর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের সভাপতি মরহুম স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী আওয়ামী লীগে এসে মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে মৃতু্যবরণ করেছেন। ভদ্র বিনয়ী সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) নুরুদ্দীন খান এবং সত ও যোগ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তমের পতাকা খুলে নিতে আওয়ামী লীগ সরকার প্রধান দ্বিধা করেননি। মান্না জানতে চেয়েছেন, মাহাথির মোহাম্মদ কোথায়? এরশাদকে কাছাকাছি আনা হলেও তাকে বলা হয়নি। তবে মান্না বলেছেন, একজন মাহাথির না পাওয়া পর্যনত্দ আমরা যেন দুই নেত্রী ও তাদের দুইটি ধারা মেনে নিই। ওয়ান-ইলেভেনের আবির্ভাব কেউ আশা করেননি তবু দেশ রক্ষায় ওয়ান-ইলেভেন এসেছে। তেমনি জাতির নেতৃত্ব সংকট পূরণে একজন মাহাথির ১৫ কোটি মানুষের মাঝ থেকে বেরিয়ে আসবেন না এমনটি আমি বিশ্বাস করি না। মান্না বলছেন, হাসিনার শাসনামল খালেদার আমলের চেয়ে ভালো। তবে স্বর্ণযুগে প্রবেশ করেনি। কথা অনেকটা সত্য। তবে তাদের আমলে চুরি হয়েছে। আর বিএনপির আমলে ডাকাতির মহোতসব হয়েছে। চোর আর ডাকাতের সংসারে কেন ফিরে যাব? এই প্রশ্ন করে মান্নার কাছ জানতে চাই, সাংবাদিক টিপু সুলতান যখন মৃতু্যমুখে তখন সরকার প্রধান কেন তার চিকিৎসার সব দায় না নিয়ে জয়নাল হাজারির মতো গডফাদারের সাফাই গাইলেন সংসদে? 'দুই নেত্রী রাজনীতি থেকে অবসর নিলে হাওর দেখাতে নিয়ে যাবো'_ এ কথা লেখায় দুই দলের দুই নেত্রীর অন্ধ সমর্থকরা আমার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছেন। এমনকি শুনেছি আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেছেন, 'দুই নেত্রী কি পীরের বান্ধবী যে হাওর দেখাতে নিয়ে যাবে?' আমি বিনয়ের সঙ্গে বলছি, বঙ্গবন্ধু ছাড়া কেউ জনগণের বন্ধু হয়নি। আমার খাতায় শাসকের তালিকায় দুই নেত্রীর নাম। জনরায়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় তাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা রয়েছে। আমি রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের আত্দমর্যাদা আর গণতন্ত্রকে শাসকের আসন থেকে মুক্ত করার জন্য কবি নজরুলের চেতনায় বিদ্রোহের সুরে তাদের ব্যর্থতার খতিয়ান তুলে ধরে অবসর নিতে বলেছি। যারা কষ্ট পাচ্ছেন তাদের কাছে আমি দুঃখিত। কিন' আমার বিশ্বাসে আমি অনড়। অবসর নিলে বিসত্দীর্ণ হাওরের অথৈ জলরাশির সঙ্গে আষাঢ়ে পূর্ণিমার খেলা দেখে তারা মুগ্ধ হবেন। পৃথিবীতে এমন সুন্দর রয়েছে যা শাসকের চেয়ারের চেয়েও নয়ন-মনকে মুগ্ধ করে। তাই আমার প্রসত্দাব। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিমানে চড়ে গুজরাট ও আসামের বন্যা দেখতে যখন বেরিয়েছিলেন তখন কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন- 'প্রিয় ইন্দিরা তুমি বিমানের জানালায় বসে গুজরাটের বন্যা দেখতে যেয়ো নাঃ মেঘের প্রাসাদে বসে তোমার করুণ কণ্ঠস্বরেও কোনো সার্বজনীন দুঃখ ধ্বনিত হবে না, তোমার শুকনো ঠোঁট, কতদিন সেখানে চুম্বনের দাগ পড়েনিঃ মাঝে মাঝে দ্বীপের মতন বাড়ি, কাণ্ডহীন গাছের পল্লবিত মাথা ইন্দিরা, তখন সেই বন্যার দৃশ্য দেখেও একদিন তোমার মুখ ফসকে বেরিয়ে যেতে পারে, বাঃ কী সুন্দর! সুনীলের কবিতা অনুবাদ করে ইন্দিরাকে দেখানো হলে শুধু বলেছিলেন, 'ভেরি নেস্টি'। কোনো কংগ্রেস কর্মী তাড়া করেনি সুনীলকে। টনি ব্লেয়ার জনরায় থাকার পরও যদি অবসরে যেতে পারেন আমার দুই নেত্রী ক্লানত্দি নিয়ে কেন অবসরে যেতে চান না? আকিদুল ইসলাম লিখেছেন, মান্নাকে অবসর নিয়ে হাওর, জ্যোৎস্না ও জোনাকি দেখতে। আমি বলবো, মেধাবী মাহমুদুর রহমান মান্না, ডাকসু বিজয়ী আখতারুজ্জামান ও সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের জাতীয় রাজনীতিতে হাল ধরার অভিষেকই তো ঘটেনি। অবসরের প্রশ্ন কেন? মানুষ মনে করে বিএনপি উড়োজাহাজ কিনে কমিশন খায়, আওয়ামী লীগ মিগ কিনে কমিশন খায়।
রোমান্টিক মান্না যখন আমার লেখা নিয়ে বলেন, জ্যোৎস্না রাতে অবারিত শস্য ক্ষেতে শরীরের সব কাপড় খুলে দেঁৗড়াতে ইচ্ছা করে আমাকে তখন নস্টালজিয়া শৈশব-কৈশোরে নিয়ে যায়। মাহমুদুর রহমান মান্না সাহসের সঙ্গে আরো বলেছেন, যখন শিবগঞ্জের ঘরে জোনাকি প্রবেশ করে তখন লাইট নিভিয়ে দিয়ে ঢাকায় এক সুন্দরী বিদূষী রমণীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। সেই সুন্দরী মহিলাটিকে জানতে আমার কৌতূহল জাগলেও ঈর্ষা জাগে না। কারণ আমার শহরে আষাঢ়ে পূর্ণিমা রাতে দেখার হাওরে থাকে অথৈই জলরাশি। মরমী কবি হাসন রাজা নারী, সাকী-সুরা, গানের দল নিয়ে এই হাওরে ভেসে বেড়াতেন। ওই রাতে জ্যোৎস্নার রূপ নবযৌবনা সুন্দরী রূপসীর রূপকেও হার মানায়। সুনামগঞ্জ গেলে এখনো রাতের হাওরে বন্ধু-বান্ধব ও গানের দল নিয়ে ভেসে বেড়াই। তবে কোনো সুন্দরী রমণীর সঙ্গলাভ হয় না। তখন মনে হয়, প্রিয়দর্শিনী ঊর্মিলা মুখার্জি সঙ্গে থাকলে হাওরে রূপ দেখার আনন্দ পূর্ণতা পেতো। ঊর্মিলা মুখার্জির সঙ্গে হৃদয় জড়াজড়ি করে আমি জ্যোৎস্নার রূপ উপভোগ করি, শানত্দিনিকেতনে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ উপভোগ করি। জ্যোৎম্না রাতে হাওরে ঘুরে বেড়ানোর সময় টেলিফোনে ওই রূপসী নারীকে হাওরের গল্প বলি, লন্ডনে টেমস তীরে বসে আমি তার সঙ্গে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার দৃশ্য উপভোগ করি, হাত ধরাধরি করে দিগনত্দ বিসত্দৃত ঘাসের ওপর বসে গল্পে গল্পে জ্যোতস্না রাত কাটিয়ে দিই। তখন ভিতর থেকে জেগে ওঠে, পৃথিবীর তাবত সুন্দরী রমণীর উদ্দেশে বলি, 'এই মন জ্যোতস্নায় অঙ্গ ভিজিয়ে এসো না গল্প করি।' মাহমুদুর রহমান মান্নাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, যে বিদূষী রমণীর সঙ্গে তিনি জোনাকি পোকার আনন্দ উপভোগ করেন সেই ভাগ্যবতী কে? মিত হেসে তিনি বলেছেন, এটা বানানো গল্প। আমি বিশ্বাস করি, মাহমুদুর রহমান মান্না লিখেছেন সত্য, বলেছেন মিথ্যা। কারণ আমার মতো অনেকেই আল্লাহর পরে বউকে ভয় পায়। আমার কৈশোরের প্রথম ভালো লাগা ও ঈর্ষার পুরুষ রবীন্দ্রনাথ। তার ছুটি গল্পের ফটিক চরিত্র ঐ সময় মনে হতো আমার একার। রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন, 'তেরো চৌদ্দ বছরের মতো বালাই পৃথিবীতে আর কোথাও নাই' তখন মনে হয় একি আমার জন্যই তিনি লিখেছিলেন? রবীন্দ্রনাথের প্রেমের ভাগ্য আমার কপালে জোটেনি। মাহমুদুর রহমান মান্নার রোমান্টিক জীবন স্বার্থক। সুন্দরী মহিলার সঙ্গে জোনাকি পোকার আনন্দ ভাগাভাগি করলেও তার স্ত্রী ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, 'রমণীর ধমনীতে ত্যাগের যত প্রকার উদাহরণই থাকুক তাহারা স্বামী ও স্বর্ণালঙ্কার ত্যাগে ততই কৃপণ'। মাহমুদুর রহমান মান্নার বেলায় এটা কতটা সত্য জানি না। তবে আমাদের দুই নেত্রীর বেলায় যোগ করলে বলা যায় ২৭ ও ২৪ বছর ক্ষমতা ভোগ করলেও রাজনীতি ত্যাগ করতে তারা ভীষণ কৃপণ। আমার বেলায় বলবো রবীন্দ্রনাথের মর্মবাণী অর্ধসত্য। স্বর্ণালঙ্কার ত্যাগ করলেও আমার স্ত্রী স্বামী ত্যাগ করতে পারবে না। সুন্দরী রমণীর সঙ্গে জ্যোৎস্না রাতে যদি অঙ্গ ভিজিয়ে গল্প করি তাহলে তার চিবুক জুড়ে অমাবস্যার অাঁধারই নেমে আসবে না, ঘরে ক্যাটরিনার মতো ঝড়ও বয়ে যাবে। দুই দল দুই নেত্রীর মুক্তি দাবি করছেন। বিনা কারণে জেল খাটা মানুষের সংখ্যা কারাগারে কম নয়। দুই নেত্রী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে বলতেন, আইনের ঊধের্্ব কেউ নয়। তাহলে দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত দুই নেত্রীর মুক্তির দাবি আসে কেন? এক নেত্রী আরেক নেত্রীর বিরুদ্ধে পল্টন ময়দানে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ এনেছেন। আজ ন্যায়বিচারের পথে, আইনি লড়াইয়ের পথে বের হয়ে আসার সাহস তারা হারিয়েছেন কোথায়। এক নেত্রী যখন আদালতে বলেন, 'রায় লেখা হয়ে গেছে, ঘোষণা করুন' আর তার দলকানা আইনজীবীরা আদালতে স্লোগান তুলে তখন আদালত অবমাননা হয় না? ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, গোলাম আরিফ টিপু, ইউসুফ হোসেন হুমায়ুনের মতো প্রবীণ আইনজীবীরা এর উত্তরে কী বলবেন। একদিকে ন্যায়বিচারের জন্য লড়বেন, অন্যদিকে আদালত অবমাননা চলবে এমনটি তো কাজীর বিচারের আমলেও হয়নি। শেখ হাসিনা বলেছেন, ১৬ টাকা সের চাল খাওয়াবেন। মতিয়া চৌধুরী বিশ্বাস করলেও আনত্দর্জাতিক বাজারের মূল্য দেখে সায়েসত্দা খাঁ কবর থেকে উঠে বাজার পরিদর্শন করতে চাইবেন। খালেদা জিয়ার বক্তব্য শুনে মনে হয় না তার শাসন আমলের পাপের গ্লানিতে তিনি ভুগছেন। হাওয়া ভবনের দুর্নীতির মহোৎসব, মন্ত্রী-এমপিদের লুটপাট, তার সহকর্মী ফালুর রাতারাতি গড়ে ওঠা মিডিয়া সাম্রাজ্য, হারিছ চৌধুরীর সম্পদ আর দুই সনত্দানের মামুনকে নিয়ে কমিশন বাণিজ্য, সম্পদের পাহাড় গড়ার জন্য অপরাধবোধ তাকে তাড়া করলে নিশ্চয় জাতির কাছে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে করজোড়ে ক্ষমা চাইতেন। মান্না আরো বলেছেন, গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় সংখ্যাগরিষ্ঠই বড় কথা। যা দুই নেত্রীর সঙ্গে রয়েছে। বলেছেন, দুটি দল গণতন্ত্রের যাত্রা পথে স্বাক্ষর রেখেছিল।
এরশাদ পতন পর্যনত্দ ঐক্যবদ্ধ ছিল। তিন জোটের রূপরেখা ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা দিয়েছিল। নির্বাচনের পর সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় ফিরেছিল। মাহমুদুর রহমান মান্নাকে যদি বলি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এরশাদের কাছে পরাজয়ের ভয়ে '৯০-র পর দুই নেত্রী মাত্র একবার এই ইসুতে এক হয়েছিলেন। '৯১-এর নির্বাচনে এরশাদকে সুযোগ দিয়ে কেন যাচাই করা হলো না কে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। কূটনৈতিক মধ্যস্থতার সব শর্ত ভঙ্গ হয়েছিল এরশাদ ও তার দলের প্রশ্নে। ভোটে তাদের সমান সুযোগ দেয়া হয়নি। তিন জোটের রূপরেখার ওয়াদা দুই নেত্রীই ভঙ্গ করেছেন। বেতার-টিভির স্বায়ত্তশাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কিছুই দেননি তারা। খালেদা '৯১-র নির্বাচনে এরশাদের দালালদের বরণ করে নিয়েছিলেন। ভোটে হেরে গিয়ে শেখ হাসিনা সেই অসুস্থ ধারা অনুসরণ করে দলকে আদর্শচু্যত করেন। আমি বিনয়ের সঙ্গে মাহমুদুর রহমান মান্নার কাছ থেকে এসবের জবাব চাই। সূত্রধরের ভূমিকায় তিনি কি স্বীকার করবেন_ শেখ হাসিনার রোমান্টিক মন আটপৌঢ়ে জীবন যেমন আমাদের জনগণের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা করেনি, সংসদ কার্যকর করেনি তেমনি খালেদা জিয়ার বাহারি শাড়ি, মহারাণীর অবয়ব তার সরকারকে ডাকাতি থেকে নিবৃত্ত করতে পারেনি এবং সংসদ ও জনগণকে আমলে নেয়নি। র্যাব আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করলেও জঙ্গিবাদকে খালেদার সরকার লালন করেছিল। ওয়ান-ইলেভেন ওদের ফাঁসি দিয়েছে। মান্নাদের সময় ছাত্র রাজনীতির যৌবনকাল ছিল। সুলতান মনসুরের পর ছাত্র রাজনীতি যৌবন হারিয়েছে। '৯০-এ ইতিহাস নির্মাণ হলেও রাজনীতিবিদ জন্ম দিতে পারেনি। ঐ সময় আমার প্রিয় ছাত্রনেতাদের মধ্যে ছিলেন মাহমুদুর রহমান মান্না, আখতারুজ্জামান, ফজলুর রহমান, বাহালুল মজনুন চুন্ন-, ডা. মোসত্দফা জালাল মহিউদ্দিন, মাহবুবুল মোকাদ্দেস আকাশ, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ, ফজলে হোসেন বাদশা, বজলুর রহমান ছানা, জাহাঙ্গীর কবির রানা, আবদুল মান্নান, প্রদীপ কর, জমির চৌধুরী প্রমুখ। কেউ কেন্দ্রে কেউবা রাকসু, চাকসু, বাকসুতে ছিলেন। জাতীয় ছাত্রলীগ নামের সংগঠনটি একমাত্র আদর্শবান ছাত্রনেতার জন্ম দিয়েছিল। তার নাম ইনায়েতুর রহীম। দুই নেত্রীর শাসনামলে ছাত্র রাজনীতি বলতে কি কিছু ছিল? তাদের আমলে কি ডাকসু বা কলেজ সংসদ নির্বাচন হয়েছে। প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিনকে ৬ মাসের জন্য রাষ্ট্রপতি করে আবার প্রধান বিচারপতির চাকরি ফিরিয়ে দেয়ার অসাংবিধানিক সিদ্ধানত্দের মাধ্যমে এরশাদের ক্ষমতা হসত্দানত্দর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। সেদিন যদি ঐকমত্যের ভিত্তিতে তাই হয় তাহলে আজ কেন সংলাপ ব্যর্থ করে জেলের তালা খুলে দেয়ার দাবি ওঠে? তাই বলি, দিন বদলের চুক্তিনামা চূড়ানত্দ না করে যেন-তেন নির্বাচন চাই না। সাহাবুদ্দিনকে এনে পরে যদি সংবিধান সংশোধন করা যায় তাহলে আজ কেন পারা যাবে না? ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিভিল সোসাইটি হোক আর সামরিক বাহিনী হোক যেখান থেকেই হোক জাতির ক্রান্তিলগ্নে নেতৃত্ব দেয়ার মতো দক্ষ একজনকে বের করে আনা হোক যিনি হবেন আমাদের একালের মাহাথির মোহাম্মদ। দেশ মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুরের সঙ্গে পাল্লা দেবে। সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ আমার শেষ লেখা পড়ে অভিনন্দন জানিয়ে দ্বিতীয় চিঠি লিখেছেন। বলেছেন, জ্ঞানীর সঙ্গে পত্রবিনিময় কিংবা একতরফা লেখা উভয় ক্ষেত্রেই নির্মল আনন্দ উপভোগ করা যায়। তোমার ভুবনে তুমি যথেষ্ট পাণ্ডিত্যের পরিচয় দিতে পেরেছো। এজন্য মন উজার করা প্রশংসা তোমার একানত্দ প্রাপ্য। এ বিষয় নিয়ে এবং তথাকথিত আপসহীন নেত্রী খালেদা জিয়ার রাতের আঁধারে এরশাদের সঙ্গে আপস-রফা করার চেষ্টার কথা আগামীতে লিখবো। যায়যায়দিনে সাবেক ধর্মপ্রতিমন্ত্রী মোশারেফ হোসেন শাহজাহানের 'জোনাক জ্বলে' কলামটি নিয়মিত পড়তাম। নস্টালজিক ওই সব লেখা পড়ে বলতাম, মানুষটা কেন বিএনপি করে। আমার লেখা পড়ে তিনি টেলিফোনে বলেছেন, 'আপনার লেখা পড়ে আমি ও আমার স্ত্রী মুগ্ধ হয়েছি। এমন সুন্দর সাহসী লেখার পর দেশে একটা ভালো সরকার আসা উচিত'। তার সঙ্গে আগে কখনো দেখা হয়নি, কথা হয়নি। তিনি আমাকে আনত্দরিকতার সঙ্গে চায়ের নিমন্ত্রণ জানালে বিনয়ের সঙ্গে তা কবুল করলেও এখনো যাওয়া হয়নি। একদিন মাহমুদুর রহমান মান্নাকে নিয়েই তার সঙ্গে আড্ডা দিতে যাবো। আওয়ামী লীগ, বিএনপির অনেকে অভিনন্দন জানালেও তাদের নাম প্রকাশ করে বিব্রত করতে চাই না।