Sat, Jun 6th, 2009 9:27 pm BdST
এহেছান লেনিন
সহ-সম্পাদক, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
ঢাকা, জুন ০৬ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)--একটি বড় নগরীতে কার্বনের সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য মাত্রা ২৯০ থেকে ৩০০ পিপিএম বলে ধরা হয়। জনসংখ্যার হিসেবে বিশ্বের প্রধান দশটি মহানগরীর মধ্যে থাকলেও তৃতীয় বিশ্বের এক রাজধানী ঢাকাতে গাড়ির সংখ্যা নিঃসন্দেহে এ তালিকার ওপরের দিকে থাকা নগরীগুলোর চেয়ে কম। কিন্তু এখনই এ নগরীর বাতাসে কার্বনের মাত্রা ৩৫০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন)। এবং উঠতি মধ্যবিত্তের সংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাজপথে বাড়ছে গাড়ির সংখ্যা।
আর গাড়ির সংখ্যা বাড়া মানেই রাজধানীর দেড় কোটি বাসিন্দার নিঃশ্বাসে যাওয়া নানাধরণের বিষাক্ত উপাদানের মাত্রার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি। সেই সঙ্গে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে চলা ধুলার দৌরাত্ম্যসহ অন্যান্য পরিবেশগত আপদ তো আছেই।
খোদ সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তরের এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্টের তথ্য অনুযায়ী, নগরীতে প্রতিবছর বায়ু দূষণজনিত বিভিন্ন রোগে ১৫ হাজারের বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। অসুস্থ হচ্ছেন লাখো নাগরিক। আর এসব রোগের চিকিৎসায় ঢাকায় প্রতিবছর ১৩২ থেকে ৫৮৩ মিলিয়ন ডলার এবং চারটি বৃহত্তম নগরীতে ২০০ থেকে ৮০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হচ্ছে যা দেশের জিডিপি'র প্রায় শূন্য দশমিক ৭ থেকে ৩ শতাংশ।
ঢাকা শহরে শুধু গাড়ির ধোঁয়া থেকে বছরে প্রায় ৩ হাজার ৭০০ টন সূক্ষ্ম বস্তুকণা (এসপিএম) বাতাসে ছড়াচ্ছে। এসব ভাসমান কণার আকার ১০ মাইক্রনের কম।
পরিবেশ অধিদপ্তরের গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার বাণিজ্যিক এলাকার বাতাসে এ ধরনের উপাদান প্রতি ঘনমিটারে ৬৬৫ থেকে ২ হাজার ৪৫৬ মাইক্রোগ্রাম। সরকারি খোড়াখুড়ি ছাড়াও অরক্ষিত নির্মাণ কাজের মহোৎসব ঢাকাকে পরিণত করেছে ধুলার রাজ্যে।
বাতাসে ধূলিকণার মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ২০০ মাইক্রোগ্রামকে সহনীয় পর্যায়ে বলে ধরা হয়।
পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, ঢাকায় সচল গাড়ির ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ত্র"টিপূর্ণ ইঞ্জিনের কারণে বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়াচ্ছে। ধারণা করা হয়, সিএনজি চালিত অটো রিকশা ও অন্য গাড়ি পরিবেশ বান্ধব। তবে এসব গাড়ির ধোঁয়ার সঙ্গেও বাতাসে মিশছে ক্ষতিকারক কার্বন মনোক্সাইড ও বেনজিন। মূলত মেয়াদ উত্তীর্ণ ও ত্র"টিপূর্ণ ইঞ্জিনের কারণে গ্যাস সম্পূর্ণ না পোড়ায় মিথেন থেকে বিষাক্ত কার্বন মনোক্সাইড সৃষ্টি হচ্ছে। নগরবাসীদের ক্যান্সারের প্রকোপ বাড়ার জন্য একে অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এছাড়া সালফার ও সীসাযুক্ত পেট্রল ব্যবহার, জ্বালানি তেলে ভেজাল ও গাড়ির ধোঁয়ার সঙ্গে কার্বন-ডাই অক্সাইড, কার্বন-মনোক্সাইড, নাইট্রোজেনের অক্সাইড, সালফার-ডাই অক্সাইড, অ্যালিহাইডসহ বিভিন্ন বস্তুকণা ও সীসা নিঃসৃত হয়ে বাতাসকে দূষিত করছে। বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য, উড়ন্ত ছাই, ধোঁয়া, অ্যারোসল ও বিভিন্ন ধরনের ফোমের কারণেও বায়ু দূষণ হচ্ছে।
সরাসরি বিষাক্ত উপাদানের প্রতিক্রিয়া ছাড়াও দূষণের কারণে বাতাসে প্রকৃত উপাদানের পরিমাণে তারতম্য ঘটে যা মানব দেহে ফুসফুসের কাজ ও রক্ত সঞ্চালনে ব্যাঘাত ঘটায়। রাজপথে চলাচলকারী লাখ লাখ পথচারী, পথপাশের অফিস, দোকানপাটের কর্মী, হাজারো গাড়িচালক ও ট্রাফিক পুলিশের মতো মানুষ প্রতিদিন শিকার হচ্ছেন এই দূষণের।
শিশু চিকিৎসক ডা. মাহবুবুল হাসান বলেন, "বায়ুদূষণে সবচেয়ে ক্ষতির শিকার শিশু ও গর্ভবতী মা। জন্ম হচ্ছে ত্র"টিপূর্ণ শিশুর। এছাড়া বয়স্কদের ব্রঙ্কাইটিস, ব্রঙ্কিউলাস, নিউমোনিয়া, হৃদরোগ, ফুসফুসের অকার্যকারিতা, চোখের প্রদাহসহ নানা ধরনের রোগ বাড়ছে।"
পরিবেশ অধিদপ্তর ঢাকার এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার গাড়ি থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০০ কিলোগ্রাম সীসা, সাড়ে ৩ টন অন্যান্য বস্তুকণা, দেড় টন সালফার-ডাই অক্সাইড, ১৬ টন নাইট্রোজেনের অক্সাইড, ১ টন হাইড্রো কার্বন এবং ৬০ টন কার্বন মনোঅক্সাইড নির্গত হচ্ছে।
এ কারণে গত কয়েক বছরে রাজধানীর বাতাসে কার্বনের পরিমাণ ৪ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক বিল্লাল হোসাইন বলেন, "ঢাকার বায়ু দূষণের সবচেয়ে বড় কারণ আশেপাশে গড়ে উঠা ইটের ভাটার কালো ধোঁয়া। এছাড়া গাড়ির ধোঁয়া, ধূলিকণা, অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ কর্মকাণ্ড ও খোলা জায়গায় বর্জ্য ফেলায়ও দূষণ হচ্ছে।"
এছাড়া উন্মুক্ত স্থানে সিটি করপোরেশনের বর্জ্য মজুদ এবং তা উন্মুক্তভাবে পরিবহণের ফলেও দূষণ হচ্ছে বলে জানান বিল্লাল হোসাইন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. শাহনাজ হক হুসেন বলেন, শুধু কার্বনের কারণে বায়ু দূষণ হচ্ছে এমনটি ঠিক নয়। ময়লা-আবর্জনা যত্রতত্র ফেলার কারণেও দূষণ হচ্ছে।"
সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে দূষণ প্রতিরোধে রুটিন মাফিক মনিটরিং করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক আখতারুল ইসলাম বলেন, "দূষণ শুধু বায়ুতেই সীমাবদ্ধ থাকে না। এটি বায়ু থেকে পানি এবং মাটি উভয়েই সঞ্চারিত হতে পারে। যার প্রত্যক্ষ ক্ষতির শিকার আমরা সবাই।"
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল অ্যান্ড অ্যানভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান ড. জহির আলম বায়ু দূষণের একটি নতুন উৎসের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তার মতে, বড় বড় বিপণীবিতান ও বাড়ির বিশেষ ধরণের কাঁচ থেকে নিঃসৃত
কার্বন বায়ু দূষণ করছে।
তিনি বলেন, "কাঁচ থেকেও যে কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে তা অনেকেরই অজানা। এ কারণে এখন ভিন্নমাত্রায় বায়ু দূষণ হচ্ছে।"
ড. জহির জানান, উন্নত বিশ্বে ভবনে এ ধরণের কাঁচের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এ থেকে তাপ বিকিরিত হয়ে উষ্ণতাও বাড়ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বাতাসে ক্রমবর্ধমান কার্বন এবং ধূলিকণা জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি ছাড়াও ঢাকার বার্ষিক গড় উষ্ণতাও বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ব্যত্যয় ঘটছে বৃষ্টিপাত ও উষ্ণতার স্বাভাবিক নিয়মে।
ক্রমশঃ ইটকাঠের স্তুপে পরিণত হওয়া প্রায় সবুজহীন ঢাকায় গাছের বৃদ্ধিতেও বিঘ� ঘটাচ্ছে দূষণ। অধ্যাপক জহির জানান, দীর্ঘদিন পাতায় ধূলিকণা জমায় গাছের খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়া সালোক সংশ্লেষণ ঠিকমত ঘটে না। আর এ কারণে বৃদ্ধি হ্রাস পাচ্ছে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞ পাভেল পার্থ উদ্ভিদের বৃদ্ধিতে বায়ু দূষণের প্রভাব সম্পর্কে বলেন, "উদ্ভিদের স্বাভাবিক সালোক সংশ্লেষণে এর প্রভাব বিরূপ। এছাড়া ধূলিকণার কারণে সূর্যের আলো উদ্ভিদের পাতায় প্রতিফলিত হয়ে তাপমাত্রা বাড়ছে।"
ইউক্যালিপটাসের মতো কিছু গাছের বায়ুবাহিত পরাগরেণুও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বলে মত দেন তিনি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্টের পরিচালক ড. নাসির উদ্দিনের মতে, রাজধানীতে পেট্রলচালিত দুই স্ট্রোক ইঞ্জিনের অটোরিক্সা বন্ধের পর দূষণ প্রায় এক তৃতীয়াংশ কমেছিল। এখন অবস্থা প্রায় আগের পর্যায়ে।
বিশ্বব্যাংকের এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়, দুই স্ট্রোক অটোরিক্সা নিষিদ্ধ করায় চিকিৎসা বাবদ প্রায় আড়াই কোটি ডলার সাশ্রয় হয়েছে। দূষণ আরো কমানো গেলে আট কোটি অসুস্থতার ঘটনা এড়ানো যাবে। মাতৃগর্ভে শিশু মৃত্যুর হার লাখে ১৫শ' থেকে ১২শ'তে নেমে আসবে।
পরিবেশ আইন অনুযায়ী, ২০০৭ সাল থেকে গাড়ির ধোঁয়ার ঘনত্ব ৭০ হার্টরিজ স্মোক ইউনিট (এইচএসইউ) হওয়ার কথা ছিল। আর ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে শুধু ৬৫ এইচএসইউ মাত্রার গাড়িই চলাচলের অনুমতি পাওয়ার কথা। তবে ঢাকার গাড়ির ধোঁয়ার ঘনত্ব এইচএসইউ একশ'র বেশি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/এএল/এজে/এসকে/২১৩৩ঘ.