মাত্র কয়েক বছর আগের কথা। আমি তখন প্রথম আলোর সিনিয়র রিপোর্টার। অপরাধ বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। সন্ধ্যার দিকে খবর পেলাম, রাজধানীর কোনো এক এলাকায় পুলিশের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের বন্দুকযুদ্ধ হচ্ছে। সহকর্মী ফটোসাংবাদিক জিয়া ইসলামকে নিয়ে ছুটে চললাম ঘটনাস্থলের দিকে। দুজনেরই বাহন মোটর সাইকেল। ঘটনাস্থলে পেঁৗছতে সময় লাগল আধঘণ্টার মতো। সেখানে হাজারো জনতার ভিড়। পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে রাস্তা। কাউকে সামনে এগোতে দিচ্ছে না। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে আমাদের পথ ছেড়ে দিল। মোটর সাইকেল রেখে হেঁটে এগিয়ে গেলাম বেশ খানিকটা পথ। কানে ভেসে আসছে গুলির শব্দ। থেমে থেমে। আবার কখনো বা টানা। রাস্তার ধারে আশপাশের বাসার জানালা দিয়ে অনেকেই বারণ করলেন আর সামনে না এগোতে। এভাবে দুজন আরো কিছুক্ষণ হাঁটার পর নিজেদের আবিষ্কার করলাম যেন এক যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝে। চারদিকে শুধু অস্ত্র উঁচিয়ে ধাবমান পুলিশ আর পুলিশ। কালো পোশাক পরে অস্ত্র উঁচিয়ে ছুটছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কর্তব্য পালনরত আরো এক দল। চারদিক থেকে ছুটে আসছে গুলি। কখনো কানের পাশ দিয়ে আবার কখনো ঘাড়ে বাতাস লাগিয়ে চলে যাচ্ছে। এক গাছের আড়ালে বসে পড়লাম আমি ও জিয়া। জিয়া কাঁপতে কাঁপতে বলল, 'বস, আপনি আমাকে এ কোথায় নিয়ে এলেন!'
গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে ওপাশের দেয়াল, আবার দেয়াল থেকে বের হয়ে ওপাশের গাছের আড়াল। এভাবেই ছোটাছুটি করছি। গোল্লায় যাক সাংবাদিকতা! জিয়াও ক্যামেরা বের করেনি ব্যাগ থেকে। আগে নিজের জীবন বাঁচানো! পুলিশের হাতে অস্ত্র আছে। তারা না হয় কিছুটা হলেও নিরাপদ। কিন্তু আমরা? আমার হাতে অস্ত্র বলতে কলম আর প্যাড। জিয়ার কাছে ক্যামেরা। কলম নাকি অস্ত্রের চেয়েও ক্ষমতাধর। ক্যামেরাও। গুণীজনরা বলে থাকেন এ কথা। কিন্তু এ মুহূর্তে কি এসব কথা শোভা পায়? বরং বলা চলে, কলম আর ক্যামেরাই আমাদের ঠেলে দিয়েছে বা টেনে এনেছে এই সমর-ময়দানে। সাংবাদিকতার বয়স একেবারে কম নয়। কিন্তু এ ধরনের পরিস্থিতিতে এর আগে পড়েছি বলে মনে পড়ে না।
গুলির ছোটাছুটি তখনো থামেনি। ছোটাছুটি করছে পুলিশ আর কালো পোশাক পরা দলটি। বন্দুকযুদ্ধ চলছে। কিন্তু কাদের সঙ্গে যুদ্ধ? পুলিশ আর কালো বাহিনী ছাড়া অন্য কাউকেই দেখছি না। গুলি ছুড়তে দেখছি শুধু পুলিশকে আর কালো ভাইদের। আমার মতো জিয়া ইসলামেরও একই প্রশ্ন। এরই মধ্যে এক পুলিশের কাছ থেকে জানতে পারলাম এখানে আসলে কী ঘটছে। পুলিশ ভাই যা বললেন তা হচ্ছে, সংঘর্ষ শুরু হয়েছে আরো দেড় ঘণ্টা আগে। এরই মধ্যে এক পুলিশ কনস্টেবল মারা গেছেন। আহত হয়েছেন আরো কয়েকজন। পুলিশ সার্জেন্ট মঞ্জু অল্পের জন্য বেঁচে গেছেন। কিছুক্ষণ পর সার্জেন্ট মঞ্জুকেও দেখতে পেলাম। নাকের পাশে সামান্য আঁচড় কেটে গুলি চলে গেছে। হালকা রক্ত ঝরছে। এ অবস্থায়ও ছোটাছুটি করছেন তিনি। উপস্থিত পুলিশ আর কালো ভাইদের অনেকেই পরিচিত। কারো কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব আর ঘনিষ্ঠতাও রয়েছে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কে কার খবর রাখে! আমি আর জিয়া দাঁড়িয়ে আছি একটা ঘরের আড়ালে। পাশেই রিকশার গ্যারেজ। সেখানে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে এক যুবক। তাকে ঘিরে আছে পুলিশ আর কালো ভাইয়েরা। জিয়া ক্যামেরা বের করে কিছুটা এগিয়ে আবার ফিরে এল আমার কাছে। ওর কানের পাশ দিয়ে ছুটে গেল গুলি। পুলিশ সদস্যদের কয়েকজনের খালি গা প্যান্ট পরা, কারো পরনে লুঙ্গি। তবে অস্ত্র আছে সবারই। এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ছেন। কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু আছে বলে মনে হয় না। চিৎকার আর হুংকার দিয়ে কথা বলছেন একজন আরেকজনের সঙ্গে। কেউ কেউ চিৎকার করে কাঁদছেনও। সহকর্মী হতাহত হয়েছে। ক্ষোভ জন্ম নেওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। কান্নাটাও স্বাভাবিক। পুলিশও রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ। এর বাইরে কিছু নয় সত্য। কিন্তু এখানেই কি শেষ?
যাক, এ প্রসঙ্গে পরে আসব। জিয়া আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। এ সময় এক লোককে টেনেহিঁচড়ে আনা হলো আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি ঠিক সেখানে। বাঁ হাতের বাহুতে গুলির চিহ্ন। রক্ত ঝরছে। মুখেও রক্ত লেগে আছে। ভালো করে খেয়াল না করলে বয়স বোঝার উপায় নেই। আমার আর জিয়ার পায়ের কাছে শুয়ে আছে লোকটি। আমরা তাকিয়ে আছি সামনের দিকে। দেখছি পাশের ঘরের জানালা দিয়ে আমাদের পায়ের দিকে তাকিয়ে আছেন এক মহিলা। কোলে এক শিশু। আমাদের জায়গা থেকে ঘরটির দূরত্ব ১৫ গজের বেশি নয়। সমরক্ষেত্রের মাঝে পড়েছে ঘরটি। আর এ কারণেই ঘরের কেউ পালাতে পারেনি। জানতে পারলাম, যে লোকটি আমাদের পায়ের কাছে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন, ঘরটি তাঁরই। তাকিয়ে থাকা মহিলা তাঁর স্ত্রী, আর স্ত্রীর কোলে তাঁরই সন্তান। আমার প্যান্টের নিচের দিকে ধরে কে যেন টানছে। তাকিয়ে দেখলাম রক্তাক্ত ওই ব্যক্তির এক হাত চেপে ধরে আছে আমার প্যান্ট। প্যান্ট ছেড়ে তিনি পা জাপটে ধরলেন। বললেন, 'বাবা, আপনি আমার ছেলের বয়সী হবেন। আমি মিথ্যা বলছি না। আপনারা আমাকে অহেতুক সন্ত্রাসী বলছেন। বিশ্বাস করেন, আমি কোনো সন্ত্রাসী না। রিকশা-গ্যারেজের মালিক। চারটা রিকশা আছে আমার। মিস্ত্রির কাজও করি। ওই ঘরটা আমার। আমার নাম...। আমাকে মারবেন না, স্যার।'
তাঁর দিকে ভালো করে তাকালাম। বয়স অনুমানের চেষ্টা করলাম। হ্যাঁ, বৃদ্ধই বটে। মুখে লেগে থাকা রক্তের আড়ালে তাঁর চেহারাটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম। চোখের সামনে ভেসে উঠল আমার বাবার চেহারা। বৃদ্ধ আমাকে পুলিশ কর্মকর্র্তা ভেবে জীবনভিক্ষা চাইছেন। দুই পুলিশ কর্মকর্তা এসে দাঁড়ালেন আমার পাশে। তাঁদের বললাম, এ বোধ হয় আসলে কোনো সন্ত্রাসী নয়। আমার কথা শুনে হেসে উঠলেন দুজনই। একজন বললেন, 'আরে পারভেজ ভাই, অন্তত আপনার মুখে এ কথা মানায় না। গলাকাটা...। এর নাম শোনেননি? এই শুয়োরের বাচ্চাই হচ্ছে গলাকাটা...। শালা জীবনে বহু মানুষ খুন করেছে। এখন ন্যাকামো করছে।' কর্মকর্তার কথা শুনে বৃদ্ধ আরো জোরে আমার পা চেপে ধরলেন। বললেন, 'স্যার, বিশ্বাস করেন, আমি গলাকাটা... নই। আমার নাম...।' আমি মনে মনে বললাম, বাবা, আমার বিশ্বাস আর অবিশ্বাসে কিছুই আসে-যায় না। বৃদ্ধের কথা শুনে পাশে দাঁড়ানো দুই পুলিশ কর্মকর্তার একজন রেগে গেলেন। বললেন_
_এখানে কোনো সাংবাদিক নাই তো?
পাশের জুনিয়র কর্মকর্তা আমার আর জিয়ার দিকে তাকালেন। মুচকি হাসলেন বড় কর্মকর্তা_
_আরে দূর! পারভেজ খান তো আমাদের ভাই।
যা বোঝার বুঝে নিলেন ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার জুনিয়র কর্মকর্তা। অপরজন ডিসি পদমর্যাদার। কালো পোশাক পরা দলের বড় কর্তাদের একজন। আমার চোখের সামনেই ঘটে গেল যা ঘটার। ইন্সপেক্টর সাহেব পিস্তল বের করলেন হোল্ডার থেকে। চেপে ধরলেন বৃদ্ধের বাঁ বুক বরাবর। মাত্র একটি গুলি। বৃদ্ধ আমার পা আরো জোরে চেপে ধরলেন। এরপর ডিসি সাহেব শেষ করলেন তাঁর পর্ব। বৃদ্ধের মাথায় রিভলবার ঠেকিয়ে তিনিও একটি মাত্র গুলি করলেন। নীতিমান পুলিশ! অযথা বেশি গুলি করে সরকারের অর্থ অপচয় করলেন না। বৃদ্ধ আমার পা ছেড়ে দিলেন। হতে পারে, তাঁর হাত পা থেকে খসে পড়ে গেল। আমি এবার আর কিছু না বলে থাকতে পারলাম না_
_কাজটা কি ঠিক হলো... ভাই?
_এত নীতির কথা বলবেন না তো! এই শালা জীবনে কত খুন করেছে!
_স্যার, গলাকাটা...পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি করতে করতে পালাচ্ছিল। পুলিশও পাল্টা গুলি করে। এ সময় গলাকাটা.... গুলি খেয়ে মারা গেছে স্যার।
আমি তাকিয়ে আছি ওই ঘরের দিকে। সেখানে চলছে তাণ্ডব। পুলিশ ঘরের মালামাল ভেঙে চুরমার করছে। ভেঙে ফেলেছে টিভি। বাধা দেয়ার কেউ নেই। এই ঘরের মালিক গলাকাটা... খুন করেছে তাদের সহকর্মীকে। এর বাসার কিছুই আস্ত রাখা হবে না। চলছে ভাঙচুর। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই মহিলার। তিনি তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে, যেখানে পড়ে আছে স্বামীর লাশ।
কিছুক্ষণ পর দেখা হলো পূর্বপরিচিত স্থানীয় এক লন্ড্রি ব্যবসায়ীর সঙ্গে। অনেকটা কানের কাছে মুখ এনে বললেন_
_পারভেজ ভাই। আমি গলাকাটা... কে চিনি। যাকে মারা হলো তিনি গলাকাটা... নন। গলাকাটার বয়স এই লোকের বয়সের চেয়ে অর্ধেকেরও কম।
_বলেন কি!
আমার গলা থেকে যেন কোনো শব্দই বের হচ্ছে না। আমার সহকর্মী জিয়া ইসলামের চোখের মণিও যে ছুটে বের হয়ে আসতে চাইছে। ঘটনাটি তৎক্ষণাৎ পুলিশের ওই ডিসি সাহেবকে জানালাম। তিনি বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা। খোঁজখবর নিতে শুরু করলেন। পরে ফিরে এসে জানালেন, ওই ব্যাটা গলাকাটা ... না হলেও শীর্ষ সন্ত্রাসীদের গডফাদার। গলাকাটার বাবা বলা চলে। পরমুহূর্তেই তিনি আবার বেতারবার্তায় ঊর্ধ্বতন কাউকে বলতে শুরু করলেন_
_স্যার, যে মারা গেছে সে গলাকাটা নয়। তবে সন্ত্রাসীদের গডফাদার। তার ঘরেই গলাকাটার গ্রুপ আস্তানা গড়ে থাকত। আরো একজন সন্ত্রাসী মারা গেছে, স্যার। জি স্যার। লিটন নাম।
বুঝতে পারলাম, কিছুক্ষণ আগে যে যুবককে গুলিবিদ্ধ হয়ে রিকশার গ্যারেজের পাশে পড়ে থাকতে দেখেছিলাম, সেও বিদায় নিয়েছে। আর থাকতে ইচ্ছে হচ্ছিল না সেখানে। চলে আসার জন্য আমার চেয়ে বেশি ব্যস্ত জিয়া ইসলাম। ফিরে এলাম অফিসে। নিউজ লিখতে বসলাম। হাত পড়ছে না কিবোর্ডে। মনিটরও চোখে ঝাপসা হয়ে আসছে। আমার আর জিয়া ইসলামের কাছে ঘটনার বর্ণনা শুনে সহকর্মীরাও হতবাক। ডেপুটি এডিটর মঞ্জু ভাইকে বিস্তারিত জানালাম। তিনি শান্ত হতে বললেন। গেলাম সম্পাদক মতি (মতিউর রহমান) ভাইয়ের রুমে। তাঁকেও খুলে বললাম সব। তাঁকে বিন্দুমাত্র বিস্মিত হতে দেখলাম না। ভাবখানা এমন, এদের (পুলিশ) কাছ থেকে এর চেয়ে ভালো কী-ই বা আশা করা যায়। তিনি ঠাণ্ডা মাথায় নিউজটা লিখতে বললেন। বললেন, যা দেখেছি হুবহু তা-ই লিখতে। শেষ পর্যন্ত আমি লিখলাম। কিছুটা রাখঢাক করে হলেও অনেকটা বিস্তারিতই ছাপা হলো পরদিন। তবে ছবি ছাড়া। জিয়া ব্যর্থ হয়েছে ছবি তুলতে। আরেকটি কথা, ওই দিন গলাকাটা... সন্ত্রাসীটাও ক্রসফায়ারে মারা যায়। সম্ভবত রাত ১১টার দিকে। একই নিউজে সেটাও ছাপা হয়।
ওই দিন প্রথম আলোয় যেটা ছাপা হয়েছিল, তা বলা চলে স্মরণীয়। আমার ধারণা ছিল, আরো বেশি সেন্সর হতে পারে। কিন্তু না। তা করেননি বার্তা সম্পাদক।
আজও আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই বৃদ্ধের মুখ। পথ চলতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই মনে হয়, তিনি আমার প্যান্ট টেনে ধরেছেন। টেনে ধরেছেন আমার পা। বলছেন, 'বাবা, আপনি আমার ছেলের মতো। আমি গলাকাটা... বা সন্ত্রাসী নই। আমি রিকশার মিস্ত্রি। আমাকে মারবেন না।' মাঝেমধ্যেই আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়ানো সেই অসহায় মহিলার চেহারা, যার কোলে ফুটফুটে শিশু। এই শিশু একদিন বড় হবে। বড় হযে সে কী হবে_পুলিশ ইন্সপেক্টর? নাকি পুলিশের ডিসি? জিয়া ইসলাম, তোমার কি এসব ঘটনার কথা মনে আছে? তুমিও কি ভাব, বড় হয়ে ওই শিশুটি কী হবে? পুলিশ? নাকি গলাকাটা ...দের কেউ। যদি পরেরটা হয়, তবে এই সমাজ এ জন্য কাকে দায়ী করবে!