জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাঁচ খুনির ফাঁসি গতকাল বুধবার রাত ১২টা ১ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কার্যকর করা হয়েছে। জাতির পিতার খুনিদের শাস্তি দেয়ায় দেশ আজ কলংকমুক্ত হল। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমান ও স্বজনদের কাপুরুষোচিত নির্মম হত্যাকাণ্ডের নায়কদের বিচার করতে জাতিকে প্রায় ৩৫ বছর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে হয়েছে। গতকাল রাত ১১টা থেকে চাঁনখারপুল থেকে নাজিমুদ্দিন রোড পর্যন্ত সড়ক বন্ধ করে দেয়া হয়। রাস্তার আশে পাশে আওয়ামী লীগের কর্মীরা ভিড় জমিয়ে বিভিন্ন ে াগান দেয়। আশেপাশের এলাকায় নেয়া হয় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
গতকাল সন্ধ্যার পর থেকেই কারা কর্তৃপক্ষ প্রস্তুতি নেয়। এগারটায় ঢাকার ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. মুশফিকুর রহমান ও ঢাকার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অমিতাভ সরকার কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রবেশ করেন। এর পরই স্বরাষ্ট্র সচিব আবদুল সোবহান সিকদার, ডিএমপি কমিশনার শহীদুল হক, আইজি প্রিজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশরাফুল ইসলাম কারাগারে যান। ১১টা ২০ মিনিটে পাঁচটি কফিন বক্স কারাগারের ভেতরে ঢোকানো হয়। সেই সাথে লাশ গোসলের জন্য দুটি চৌকিও রাখা হয়। ফাঁসি কার্যকর করার সময় সিনিয়র জেল সুপার তৌহিদুল ইসলাম ও মোখলেসুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
গতকাল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিশেষ বেঞ্চ পাঁচ খুনির রিভিউ পিটিশন খারিজ করে দেন এবং এই আদেশ অপরাহ্ণে কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছে। নিয়মানুযায়ী কারা কর্তৃপক্ষ খুনিদের উচ্চ আদালতের রায় অবহিত করেন। তাদের আত্মীয়-স্বজনকে শেষবারের মতো দেখা করার সংবাদ দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর অন্যতম খুনি লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে রাষ্ট্রপতি বরাবর আবেদন করেন এবং লে. কর্নেল (অব.) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান প্রাণ ভিক্ষার আবেদন করবে না বলে কারা কর্তৃপক্ষকে জানান। দুটি আবেদনই কারা কর্তৃপক্ষ সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠান। সেখান থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং পরে রাষ্ট্রপতির দফতরে পাঠানো হয়। রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান রাত ৮টায় লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমানের প্রাণ ভিক্ষার আবেদন নাকচ করে দেন। এই আদেশ রাত ৯টায় কারা কর্তৃপক্ষ পেয়ে যায়। এর আগে তিন খুনি লে. কর্নেল (অব.) মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি), মেজর (অব.) এ কে এম মহিউদ্দিন (ল্যান্সার) ও মেজর (অব.) বজলুল হুদা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষার আবেদন করলে তা নাকচ করা হয়।
রাতে পাঁচ খুনির আত্মীয়-স্বজন কেন্দ্রীয় কারাগারে তাদের সঙ্গে দেখা করেছেন। রাত ১২টা ১ মিনিটে ফাঁসি কার্যকর করার আগে কারাগার মসজিদের ইমাম তাদের তওবা করান। তাদের মুখে কালো রংয়ের যমটুপি পরানো হয়। এরপর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। সিভিল সার্জন ডা. মুশফিকুর রহমান মৃত্যু নিশ্চিত করেন। ইংরেজি বর্ণমালার আদ্যক্ষর অনুযায়ী পাঁচ খুনির ফাঁসি পর্যায়ক্রমে কার্যকর করা হয়। প্রথমে বজলুল হুদার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে মহিউদ্দিন আহমেদ, এম মহিউদ্দিন, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও সৈয়দ ফারুক রহমানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
ফাঁসি হওয়ার সংবাদে কারাগারের গেটে আত্মীয়-স্বজন ছাড়াও দর্শনার্থীদের ভিড় জমে যায়। সন্ধ্যার পর থেকে কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান গেট ও আশপাশে বিপুলসংখ্যক র্যাব ও পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকার বাইরে কাশিমপুর-২ কারাগার, ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগার, কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার ও রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারও প্রস্তুত রাখা হয়েছিল, প্রস্তুত রাখা হয়েছিল ৩৫ জন জল্লাদকে।
ফাঁসি কার্যক্রমে ৬ জল্লাদ অংশ নেয়। গোপালগঞ্জের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সানোয়ার, ফারুক, এরশাদ শিকদারের ফাঁসির জল্লাদ শাহজাহান, কালু এবং গাজীপুরের হাফিজ ও ঢাকার রাজু ঢাকা কেন্দ্রীয় কারগারে ফাঁসির মঞ্চে ফাঁসি কার্যকর করে।
রাত ১০টায় ফাঁসির মঞ্চ আলোকিত করা হয়। জল্লাদরা সবাই খুনের মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত। ফাঁসি কার্যকর করতে নতুন কোন ফাঁসির মঞ্চ নির্মাণ করা হয়নি। পুরনো মঞ্চেই ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এ ব্যাপারে একজন কারা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, একটি নতুন মঞ্চ তৈরি করতে ২ মাস থেকে ৩ মাস সময় লাগতে পারে। এ জন্য পুরানো মঞ্চেই ফাঁসি কার্যকর করা হলো। ফাঁসি কার্যকর করতে যে রশি ব্যবহার করা হয় তা ম্যানিলা রোপ নামে পরিচিত। ব্রিটিশ আমলে দেশের কারাগারগুলোতে ফাঁসি কার্যকর করতে এই রশি আমদানি করা হত। ম্যানিলা থেকে এ রশি আনা হয় বলে একে বলে ‘ম্যানিলা রোপ’। একজন সাবেক কারা কর্মকর্তা জানান, ফাঁসি কার্যকর করতে ফাঁসির ৩ গজ ম্যানিলা রোপ দরকার হয়।
গতকাল দেশের সকল কারাগারে সতর্ক অবস্থা জারি করা হয়েছিল। কারাগারগুলোতে অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা হিসাবে কারারক্ষীর পাশাপাশি র্যাবও মোতায়েন করা হয়েছিল।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক
আবুল খায়ের
ইত্তেফাক রিপোর্ট
বৃহস্পতিবার, ২৮ জানুয়ারি ২০১০