নববর্ষের প্রত্যাশা - মইন উ আহমেদ
বাংলা নববর্ষ। বাঙালির নববর্ষ। এই দিনে আমরা নতুন কিছু আশা করি। নতুন কিছু কামনা করি। আনন্দ-উৎসবে ধনী-গরিব, শহরবাসী-গ্রামবাসী সবাই আনন্দিত হতে চাই। জাতি হিসেবে আমরা ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য সংগ্রাম করে সফল হয়েছি, ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, ১৯৯০ সালে আন্দোলনের মাধ্যমে পটপরিবর্তন পেয়েছি, ২০০৬ সালে সময়ের সঙ্গে আপস করে ঘুরে দাঁড়িয়েছি। তারপরও সব কিছু মিলে হিসাব করতে গেলে খুব সহজেই আমাদের চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে অসামঞ্জস্যতা খুব প্রকটভাবে চোখে পড়ে। এমন কেন হলো? এই প্রশ্ন যেমন সবাই করে, তেমনি এই প্রশ্ন আমারও, আমাদের কী নেই? সোনার একটি দেশ আছে। সোনা ফলানো মাটি আছে। সহজ-সরল পরিশ্রমী মানুষ আছে। নেই শুধু সৎ পরিকল্পনা, সৎ বাস্তবায়ন ও সৎ মানসিকতা। এই নেই এর প্রতিকার কী? দীর্ঘ ৩৬ বছর আমরা পার করে এলাম, এখনো কেন আমাদের হিসাবের খাতা প্রায় শুন্য, পহেলা বৈশাখে ব্যবসায়ীরা ব্যবসার লাভ-লোকসান নিয়ে হালখাতা খোলেন। সেই হালখাতায় হিসাব লেখা থাকে কড়ায়-গন্ডায়। কতটা সে এগোলো, কতটা পেছালো, এই হিসাব আমরা যদি আমাদের দেশ নিয়ে করতে চাই তাহলে আমরা কী দেখি। যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম সেখান থেকে কতটুকু এগোলাম? এমন কেন হলো? আমাদের চোখের সামনে কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া যাদেরই দেখি, সবাই উঠছে আকাশে আর আমরা ডুবেছি হতাশায়। আকন্ঠ হতাশা কোনো দেশকে, কোনো জাতিকে, কোনো সমাজকে, কোনো সংসারকে আলোর মুখ দেখাতে পারে না। কেন এ হতাশা? আমাদের অনেক বড় বড় রাজনৈতিক দল আছে, যাদের প্রতি দেশের মানুষের অনেক আস্থা, অনেক বিশ্বাস, অনেক প্রত্যাশা। তাদের পাশাপাশি অন্য যারা সমাজ-সংস্কার নিয়ে ভাবেন, দেশের বরেণ্য ব্যক্তি হিসেবে যাঁদের পরিচিতি, তাঁদের সবারই এই দেশ। আমরা যারা বিভিন্ন বাহিনীতে আছি, বিভিন্ন পেশায় আছি, সরকারি-বেসরকারি কাজে জড়িত আছি, কৃষক, শ্রমিক, জেলে তাঁতি, সবারই এই বাংলাদেশ। এই দেশের কথা যাঁরা ভাবেন, এই দেশের জন্য যাঁরা কাজ করেন, বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে যাঁরা আছেন, সবাই এই দেশের সমান অংশীদার, সবারই দায়িত্ব এই দেশকে ভালোবাসা। অমিত সম্ভাবনার এই দেশে প্রত্যাশার আলো বার বার চারিদিকে দ্যুতি ছড়িয়ে নিভে গেছে। অধরা সাফল্য দুর থেকে হাতছানি দিয়ে শুধু স্বপ্নই দেখিয়েছে। স্বপ্ন আর বাস্তবে ধরা দেয়নি। তার পরও আমরা স্বপ্ন দেখি এক সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের। দেশের মানুষের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আর আত্মত্যাগের গৌরবময় ইতিহাস এ স্বপ্ন দেখার সাহস জোগায়। এ সাহস অলঙ্ঘনীয় সীমাবদ্ধতাকে শক্তিতে রূপান্তর করে এক আলোকিত পথে যাত্রার সুচনা করতে উদ্বুদ্ধ করে। বাংলা নববর্ষের এই সুন্দর দিনে, সুন্দর সময়ে আমি তেমনি কয়েকটি বিষয় এখানে তুলে ধলতে চাই-
দেশপ্রেম
আমরা সবাই এ দেশকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। এ ভালোবাসায় কোনো স্বার্থ নেই। এ ভালোবাসার প্রমাণ আমরা দিয়েছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়। যে যেখানে যেভাবে পেরেছেন দেশের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছেন এবং সত্যি সত্যি দেশকে একদিন শত্রুমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। সেই মানুষগুলো এখনো আছেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও সমপরিমাণ মানুষ। এতে আমাদের ক্ষমতাশক্তি সব কিছু দ্বিগুণ হওয়ার কথা। আমরা কেন পরাজিত হব! যদি একাত্তরে পেরে থাকি এখনো পারব। দেশের স্বার্থকে সবার উপরে স্থান দিয়ে সততার সঙ্গে যদি আমরা একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করতে পারি, তবে আমরা আবার সফল হব। সুখী এক বাংলাদেশ গড়তে পারব!
মানবসম্পদ
আমাদের দেশে যে পরিমাণ মানুষ, একে অনেকে মনে করেন এটা আমাদের বোঝা। আমি মনে করি এটাই আমাদের বড় সম্পদ। আমরা যদি এই সব মানুষদের একটা বিরাট অংশকে শিক্ষিত করে, প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগাতে পারি তাহলে তারা কখনোই আমাদের বোঝা হবে না। তারাই হবে আমাদের বড় সম্পদ, বড় শক্তি, বড় অবলম্বন। আমি একটা কথা সব সময় বলি, আমাদের ১৫ কোটি মানুষের ৩০ কোটি হাত। এ হাতগুলোকে প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। এই হাতগুলোকে অলস অথবা অকর্মণ্য হতে দেওয়া যায় না। যে শিশু তার হয়তো ক্ষমতা নেই, যে বৃদ্ধ তারও হয়তো শক্তি নেই, কিন্তু যারা কাজ করতে পারে, যে যতটুকু পারে, তাকে, তাদের সেই কাজই করতে দেওয়া উচিত। আমি সাহায্যের নামে কর্মের হাতকে ভিক্ষুকের হাত বানানোর পক্ষপাতী নই। দুর্যোগের সময় যার যা কিছু আছে তা নিয়েই দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু সে সাহায্য কোনোভাবেই যেন সাহসী মানুষগুলোকে অকর্মণ্য করে না তোলে। সাহায্যের বিনিময়ে যে মানুষ যে কাজ করতে পারে, যতটুকুই করতে পারে, তার বিনিময়েই তাকে সাহায্য দিতে হবে। আর এভাবেই মানুষকে সম্পদে পরিণত করলেই জাতি হিসেবে আমাদের মুক্তি নিশ্চিত।
কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি
আমরা অনেক সময় ভুলে যাই আমাদের দেশে মাটি এক ইঞ্চিও বাড়ছে না। বাড়ছে মানুষ। প্রতিবছর প্রতিমাসে শুধু নয় প্রতি ঘণ্টায় মানুষ বাড়ছে। এই সব নতুন অতিথিকে আমাদের স্বাগত জানাতে হচ্ছে। তাদের মুখের খাবার জোগান দিতে হচ্ছে। তাই চাষের জমিকে সুপরিকল্পিতভাবে কাজে লাগাতে হবে। যেখানে বছরে একবার ফসল হয় সেখানে বছরে দুবার-তিনবার যেন ফসল ফলানো যায় সে ব্যবস্থা করতে হবে। আমি সিলেটে গিয়ে দেখেছি হাজার হাজার একর জায়গা পড়ে আছে, পানির অভাবে চাষ হয় না অথচ মাত্র দুই কিলোমিটার দুরে নদী। ইচ্ছে করলেই তারা ওই নদী থেকে পানি এনে জমিগুলোকে চাষযোগ্য করতে পারে। এইভাবে শুধু সিলেট নয়-বাংলাদেশের সব জেলায়, সব উপজেলায়, সব ইউনিয়নে, সব গ্রামে ও শহরে খুঁজলে দেখা যাবে অনেক জায়গা অনাবাদি। এ ব্যাপারে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উদ্যোগ, নিবিড় তত্ত্বাবধান, ভালো বীজ, ভালো সার, পানি ও শ্রমের ব্যাপারে উৎসাহ আমাদের খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্ণ হতে সহায়তা করবে। তাহলে খাদ্যের জন্য আমাদের কখনোই বিদেশমুখী হয়ে অপেক্ষা করে থাকতে হবে না।
মৎস্য চাষ
আমাদের দেশ মাছের দেশ। নদীর ইলিশ থেকে পুকুরের পুঁটিমাছ পর্যন্ত যেমন পুষ্টিকর তেমনি উপাদেয় ও স্বাস্থ্যকর। কিন্তু আমরা সেই মাছের ঐতিহ্য আজ হারাতে বসেছি। অথচ আমাদের দেশে অনেক জলাশয়, হাওর-বাঁওড়, খাল-বিল মাছ চাষের জন্য উপযোগী। শুধু উদ্যোগ আর আগ্রহের অভাব। অথবা সহযোগিতার-পৃষ্ঠপোষকতার। আমি পরিদর্শনে গিয়ে তিস্তা ব্যারেজসহ বিভিন্ন জায়গায় যেখানে খালি জলাশয় দেখেছি সেখানে সেনা সদস্যদের মাধ্যমে স্থানীয় লোকজনকে মৎস্য চাষে উৎসাহ দিয়েছি এবং ফলাফল আশ্চর্যজনকভাবে আশাতীত। আমি বিশ্বাস করি, দেশের প্রত্যেকটি এলাকায় যেখানে মৎস্য চাষ সম্ভব সেখানে যদি স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি, নেতা-কর্মী, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাবৃন্দ, ছাত্র-শিক্ষক, সবাই মিলে মৎস্য চাষে এগিয়ে আসেন তাহলে থাইল্যান্ডের মতো আমরাও নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে মাছ রপ্তানি করতে পারব।
পাম অয়েল
ভোজ্য তেল নিয়ে আমাদের নানাবিধ সমস্যা। তেলের দাম হু হু করে বাড়ছে। নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলে, কিন্তু সফলতা আসে না। অথচ একসময় আমাদের দেশের মানুষ সরিষার তেল খেত। এখন সরিষার চাষ তেমন হয় না। কেন হয় না, সে বিষয়টি দেখার পাশাপাশি অন্যান্য সম্ভাবনাও যাচাই করে দেখা যেতে পারে। যেমন পাম চাষ। আমার জানা মতে, একজন উৎসাহী দেশপ্রেমিক গবেষক পাম চাষ করে আশাতীত ফলন লাভ করেছেন। কাজেই যদি সঠিক উদ্যোগ নেওয়া যায় তবে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই আমাদের দেশ পাম অয়েলে সমৃদ্ধ হবে এবং বিদেশেও এই তেল রপ্তানি করা যাবে। কাজেই অর্থকরী এরূপ কৃষিজাত পণ্যের সীমাহীন সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে হবে।
সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার
আমাদের সীমিত সম্পদের বিপরীতে রয়েছে বিশাল জনগোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান চাহিদা। এ চাহিদা মোকাবিলায় শুধু সীমিত সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারই যথেষ্ট নয়। এ সম্পদ থেকে সর্বোচ্চ ক্ষমতা নিংড়ে নেওয়ার জন্য আমাদের সুবিবেচনাপ্রসুত উদ্ভাবনী পন্থা নিয়ে এগোতে হবে। যেমন বর্তমানে গভীর সংকটে নিমজ্জিত বিদ্যুৎ ও সারের ক্ষেত্রে আমাদের একটি ক্ষুদ্র উদ্যোগ বড় একটি সম্ভাবনার দ্বার উন্নুক্ত করেছে। ১১ পদাতিক ডিভিশনে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে অ্যানার্জি বাল্ব আংশিকভাবে প্রচলন করে শুধু বগুড়া অঞ্চল (দশটি জেলা) প্রায় ৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাঁচানো গেছে, যা বর্তমানে ওই এলাকায় সেচ কাজে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ প্রদানে ব্যবহূত হচ্ছে। অথচ ৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে প্রায় ৩০০-৪০০ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী বগুড়া এলাকায় অ্যানার্জি বাল্ব প্রচলন প্রকল্প সম্পন্ন করা গেলে এ বছরের শেষ ভাগে প্রায় ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাঁচানো সম্ভব হবে। এভাবে আমরা পুরো দেশে প্রায় ৬০০ থেকে ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাঁচাতে পারি। তেমনি আর একটি উদাহরণ হলো নবম পদাতিক ডিভিশনের তত্ত্বাবধানে নরসিংদী জেলায় প্রচলিত ইউরিয়া সারের পরিবর্তে গুটি ইউরিয়া সারের প্রবর্তন। প্রচলিত ইউরিয়া সারের তুলনায় প্রায় ৩০ ভাগ পর্যন্ত কম গুটি ইউরিয়া সার প্রয়োগ করে ২০ ভাগ পর্যন্ত অধিক ফসল উৎপাদন আশা করা হচ্ছে। অর্থাৎ ৭০ ভাগ সারে ১২০ ভাগ ধান উৎপাদন করা সম্ভব। আমাদের সীমিত সম্পদের দেশে এ রকম উদ্ভাবনী পন্থা একদিকে যেমন মূল্যবান সম্পদ বাঁচাবে, অন্যদিকে অধিক উৎপাদনে মানুষ বাঁচবে। এভাবে আমাদের সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
প্রাকৃতিক সম্পদ
আমাদের দেশে অনেক ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম গ্যাস, কয়লা, পাথর। এই প্রাকৃতিক সম্পদ যথাযথভাবে আহরণ করে আমরা নিজেরা যেমন উপকৃত হতে পারি, তেমনি এই সম্পদ ক্ষেত্রবিশেষে বিদেশে রপ্তানি করেও আমরা বিদেশি মুদ্রায় আমাদের সমৃদ্ধ করতে পারি। গ্যাসের কথা যদি বাদও দেই, তাহলেও বলা যায়, আমাদের কয়লা আছে, পাথর আছে, যা অত্যন্ত উন্নতমানের। বিদেশে রপ্তানি না করেও আমরা আমাদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য এই সব খাতে বিদেশ থেকে আমদানি কমিয়ে দিতে পারি। তাহলেও অনেক বিদেশি মুদ্রার সাশ্রয় হবে।
কারিগরি শিক্ষা
সেই মানুষ উপযুক্ত যে শিক্ষিত। শিক্ষা বলতে, লেখাপড়া যেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে কারিগরি শিক্ষাকে। কারিগরি শিক্ষায় যত আমরা নিজেদের শিক্ষিত করতে পারব, ততই দেশ-বিদেশে আমাদের চাহিদা বাড়বে। আর যত চাহিদা বাড়বে তত উপার্জন বাড়বে। উপার্জন বাড়লেই আমাদের অর্থনৈতিক দৈন্যতা কাটবে। যেমন দেশের মাদ্রাসাগুলোতে যদি আমরা ইসলামিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে কোনো কারিগরি শিক্ষা কিংবা আরবি (কথোপকথন) ভাষার ওপর প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের প্রশিক্ষিত করে তুলতে পারি তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে তাদের প্রারম্ভিক বেতন বর্তমানের চেয়ে তিনগুণ বেশি হবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে কারিগরি শিক্ষার এ উন্নুক্ত সম্ভাবনাকে আমাদের দেশের জন্যই এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
তথ্যপ্রযুক্তি
তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতার এ যুগে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আর তথ্য পাচারের খোঁড়া যুক্তিতে এ থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখলে চলবে না। আলোকিত আগামীর জন্য তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সমাজব্যবস্থা প্রবর্তনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা আগামী প্রজন্েনর জন্য আমাদের অঙ্গীকার হওয়া উচিত। গতানুগতিকতা ছেড়ে তথ্যপ্রযুক্তির আলো ঝলমলে ক্ষেত্র আমাদের জন্য অনেক সম্ভাবনাময়। কারণ আমাদের রয়েছে বিশাল এক মানবসম্পদ। সঠিক সিদ্ধান্ত, উন্নত প্রশিক্ষণ ও পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে ৬৫০ বিলিয়ন ডলারের এ বিশাল ব্যবসার কিয়দংশও যদি আমরা দখল করতে পারি তবে আমাদের মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে বেশি সময় লাগার কথা নয়। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত ইতিমধ্যে বছরে এ ক্ষেত্র থেকে বার্ষিক ৬০ বিলিয়ন ডলার আয় করার পরিকল্পনা করেছে। তারা যদি পারে আমরাও পারব।
জাহাজ নির্মাণ
এ খাতটির সাম্প্রতিক সম্ভাবনা আমাদের সবাইকে আলোড়িত করেছে। বড় রকমের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই নীরবে বিস্তার লাভ করা এ শিল্পটির সাফল্য একান্তই নিজস্ব বলে দাবি করতে পারেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে এ শিল্পটির প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনা একে নতুন মাত্রা দিয়েছে। আমার বিশ্বাস, আমাদের দেশে জাহাজ নির্মাণের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের যদি আমরা প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিতে পারি তাহলে এ শিল্প বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের জন্য মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিদেশি মুদ্রা অর্জনের বিরাট সম্ভাবনার সুযোগ সৃষ্টি করবে।
হোটেল ম্যানেজমেন্ট
এই খাতটি সমগ্র বিশ্বময় সমানভাবে সমাদৃত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ খাতে অভিজ্ঞ ও দক্ষ লোকের চাহিদাও অনেক। আমাদের (সেনাবাহিনীর) একটি হোটেল রয়েছে রেডিসন। এই হোটেলের জন্য বিভিন্ন বিভাগে বিদেশ থেকে লোক আনতে গিয়ে দেখেছি অনেক টাকা খরচ হয়। অথচ আমাদের দেশ থেকে যদি ছেলেমেয়েদের আমরা প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে পারি, তাহলে দেশের হোটেলের চাহিদা মিটিয়ে শত শত দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী আমরা বিদেশে পাঠাতে পারব। এই খাতে আমাদের দেশের কর্মজীবী, কর্মপ্রত্যাশী মানুষের সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল। বিশাল এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে আমার বিশেষ অনুরোধে ‘রেডিসন’ হোটেল পরিচালনা কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশে এ রকম একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলতে রাজি হয়েছে। যেখান থেকে প্রতিবছর প্রশিক্ষিত তরুণ-তরুণী বিশ্ববাজারে নিজেদের দক্ষতা যাচাইয়ের সুযোগ পাবে। দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও যদি এভাবে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসে তবে দেশের যুবসমাজ দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে নিজেদের বলিষ্ঠভাবে শামিল করতে পারবে বলে আমি মনে করি।
পর্যটন
আমাদের দেশ প্রকৃতিগতভাবে অত্যন্ত সুন্দর। আমাদের রয়েছে পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, প্রকৃতির সৃষ্টি সুন্দরবন, মনোমুগ্ধকর পার্বত্য এলাকা চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, বান্দরবান, নদী, সমুদ্র, দর্শনীয় ও ঐতিহাসিক স্থানসমূহ। আমরা যদি নিখাদ নিরাপত্তা, আন্তরিক আতিথেয়তা ও পরিপূর্ণ পথপরিক্রমার নিশ্চয়তা দিতে পারি তাহলে পর্যটকেরা আমাদের দেশে আসবেই। দেশ বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা অর্জন করবে। সরকারি-বেসরকারি উভয়ভাবেই আমরা পর্যটনের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারি। পৃথিবীর অনেক দেশ শুধু পর্যটনের আয়ের ওপর নির্ভর করে উন্নত আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। তারা যদি পারে আমরা কেন পারব না?
ডেইরি ফার্ম
আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষই বিভিন্ন নাগরিক সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত যেমন বিদ্যুৎ, গ্যাস ইত্যাদি। সরকারের পক্ষে সবার জন্য এসব সুবিধা নিশ্চিত করা অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু আমি দেখেছি ছোট একটি পরিকল্পনা করে কীভাবে এসব মানুষগুলোকে বদলে দেওয়া যায়। যেমন ২৫টি গরু নিয়ে ছোট একটি ডেইরি ফার্ম স্থাপন করলে একদিকে এটি যেমন নির্দিষ্ট একটি দলের প্রোটিন চাহিদা মেটাবে, অন্যদিকে তেমনি বায়োগ্যাসের মাধ্যমে বিদ্যুৎ, রান্নার গ্যাস ও জমির সার উৎপাদন সম্ভব হবে। এরূপ ডেইরি ফার্ম স্থাপনে যে অর্থের প্রয়োজন তা দেওয়ার ক্ষমতা দেশের অর্থবান নাগরিকদের রয়েছে। তারা যদি এ ব্যাপারে উদ্যোগী হয়, তবে অতি অল্প সময়ে প্রকল্পটি দেশের দারিদ্র্য দুরীকরণে বলিষ্ঠ ভুমিকা রাখতে সমর্থ হবে।
গার্মেন্টস
গার্মেন্টস শিল্প আমাদের অর্থনীতির জীবনীশক্তি। এ শিল্পটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া মানে দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়া। এ শিল্পটি বাঁচানোর দায়িত্ব আমাদের সবার। শুধু ক্ষমতায় আরোহণের ঘুঁটি হিসেবে এ শিল্পকে নিয়ে খেলা হবে আত্মহত্যার শামিল। আমাদের কষ্টে অর্জিত সুনাম এবং নির্ভরযোগ্যতা বিঘ্নিত হলে প্রবল প্রতিযোগিতামূলক বাজার থেকে আমরা ছিটকে পড়ব। তাতে লাভ হবে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর। ক্ষতি হবে আমাদের অর্থনীতির। ক্ষতি আমাদের খেটে খাওয়া মানুষগুলোর। কাজেই এ শিল্পকে বাঁচাতে হবে। এ শিল্পকে বাঁচাতে সরকার, গার্মেন্টস মালিক ও শ্রমিক সবাইকে ঐক্যবদ্ধ ও সচেতনভাবে কাজ করতে হবে। আমাদের প্রয়োজনে, আমাদের অর্থনীতির প্রয়োজনে এ শিল্পকে আরও অনেক বিস্তৃত করতে হবে।
নেতৃত্ব
স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের সমগোত্রীয় অনেক দেশ এখন উন্নত বিশ্বের দেশ হিসেবে পরিচিত। যেমন সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও কোরিয়া। প্রাকৃতিক ও মানবসম্পদে বাংলাদেশ থেকে অনেক পিছিয়ে থেকেও তারা অতি দ্রুত নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করতে পেরেছে। তাদের এ সাফল্যের মূলে ছিল সৎ ও নিবেদিতপ্রাণ নেতৃত্ব। আমাদের এ দেশ সুর্যসন্তানদের দেশ। এ দেশে সৎ নেতৃত্বের অভাব আছে বলে আমি মনে করি না। দেশের প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধ থেকে সঠিক ও যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচন আমাদের অবশ্যই করণীয় কর্তব্য। এ বছর সে নেতৃত্ব নির্বাচনের বছর। আমাদের অবশ্যই এমন নেতৃত্বের পেছনে একতাবদ্ধ হতে হবে, যে হবে সৎ, নির্ভীক, বিবেকবান ও নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমিক।
পরিশেষে আমরা ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছি, দুর্নীতি আমাদের অগ্রগতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা। দুর্নীতি থেকে সবাইকে মুক্ত করে আনতে হবে। যাঁরা ইতিমধ্যে চিহ্নিত হয়েছেন-যাঁরা হননি, যে যেই স্থানে, যেই কর্মে, যেই দায়িত্বে, যেই পরিচয়েই থাকুন না কেন তাঁকে দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে। দুর্নীতি শুধু অর্থে নয়, বিত্তে নয়, কথায়, কাজে, নীতিতে, আদর্শে, সর্বক্ষেত্রে আমাদের দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে। মালদ্বীপ ১৯৭১ সালে আমাদের চেয়েও খারাপ অবস্থায় ছিল। বর্তমানে তাদের মাথাপিছু আয় ৩৯০০ মার্কিন ডলার। ওখানেও ঝড় হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়। তার পরও তারা এগিয়ে গেল কেমন করে। শুধু সততা আর আন্তরিকতা দিয়েই দেশ ও মানুষকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। আমাদের কাজ করতে হবে পরিকল্পনা করে। ঘর তুলতে হবে পরিকল্পনা করে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, চিকিৎসাব্যবস্থা, এখানেও পরিকল্পনার প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখতে হবে-দেশের জন্য সবাইকে নিবেদিত হতে হবে। নিজেকে নিবেদন করতে হবে। দেশকে যদি আমি কিছু না দিই তাহলে দেশ আমাকে কেন কিছু দেবে। এটা প্রকৃতগত সত্য। এই সত্যকে অস্বীকার করার যোগ্যতা বা ক্ষমতা কারোরই নেই। তাই বাংলা নববর্ষের এই শুভক্ষণে আমরা যেন মনে রাখি-১. আমাদের লোভ সংবরণ করতে হবে। ২. হিংসা পরিহার করতে হবে। ৩. জ্ঞান অর্জন করতে হবে। সবার জন্য রইল নববর্ষের নন্দিত শুভ কামনা।
জেনারেল মইন উ আহমেদ: বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান।