জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে এখনো ছয়জন পলাতক রয়েছেন। নিম্ন আদালত থেকে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া এই মামলায় কারাবন্দি ৫ খুনির ফাঁসির রায় এখন কার্যকরের অপেক্ষায়। কিন্তু পলাতক ছয়জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রক্রিয়া কিভাবে সম্পন্ন হবে? এ ব্যাপারে আইন বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, পলাতক থাকায় বঙ্গবন্ধুর খুনিরা আপিল করার সুযোগ হারিয়েছেন। কারণ পলাতক থাকা অবস্থায় আপিল করা যায় না। ফৌজদারি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে আপিল করতে হলে আটক বা আত্মসমর্পণের পর তাকে কারাগারে থাকা অবস্থায় আপিল দাখিল করতে হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ছয় খুনি লে.কর্নেল (অব.) এসএইচএমবি নূর চৌধুরী, লে. কর্নেল (অব.) শরীফুল হক ডালিম, লে. কর্নেল (অব.) খন্দকার আব্দুর রশিদ, লে.কর্নেল (অব.) এম এ রাশেদ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন (অব.) আব্দুল মাজেদ, রিসালদার মোসলেম উদ্দিন পলাতক রয়েছেন। তবে জানা যায়, খুনি আজিজ পাশা ২০০২ সালে জিম্বাবুয়েতে মারা গেছেন। এর ফলে তারা নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে তাদের আপিল তামাদি হয়ে গেছে। কারণ তামাদি আইনের (লিমিটেশন এ্যাক্ট) ৫ ধারা মোতাবেক ফৌজদারি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ৬০ দিনের মধ্যে নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে হয়। এই সুযোগ হারানোয় তাদের আপিল তামাদি হয়ে গেছে। আইনানুযায়ী এখন আটক বা আত্মসমর্পণের পর পলাতক খুনিদেরকে কারাগারে গিয়ে আপিল করতে হবে। একইসঙ্গে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের আপিলের সঙ্গে বিলম্ব মার্জনার দরখাস্ত দাখিল করতে হবে। কি কারণে এবং কেন এতদিন আপিল করতে বিলম্ব হয়েছে তার প্রতিটি দিনের অর্থাৎ ১৩ বছরের প্রত্যেকটি ঘন্টা ও দিবসের যথাযথ কারণ দর্শাতে হবে। এই কারণ বা ব্যাখ্যা সন্তোষজনক হলে আদালত বিলম্ব মার্জনার দরখাস্ত মঞ্জুর করতে পারেন। এরপর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা আপিল করার সুযোগ পাবেন। যদি আদালত বিলম্ব মার্জনার দরখাস্ত নাকচ করে দেন তাহলে দণ্ড কার্যকর করতে কোন আইনগত বাধা থাকবে না।
উল্লেখ্য, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালের ১৮ জুন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার কারাবন্দী খুনি মেজর (অব:) একে মহিউদ্দিনকে (ল্যান্সার) দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। কারাগার থেকে ঐ বছরের ২৪ জুন তিনি হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। আপিলের সঙ্গে তাকে বিলম্ব মার্জনার দরখাস্ত দাখিল করেন। দরখাস্তে তাকে প্রায় ৯ বছরের বিলম্বের কারণ উল্লেখ করতে হয়েছিল। আদালত উক্ত দরখাস্ত মঞ্জুর করায় তিনি ঐ বছর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ পেয়েছিলেন।
এ বিষয়ে প্রখ্যাত ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র কৌঁসুলি এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন ইত্তেফাককে বলেন, যেহেতু বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার দণ্ডপ্রাপ্তরা পলাতক এবং আপিল করে নাই সেহেতু তাদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রয়েছে। আটক বা আত্মসমর্পণের পর কারাগার থেকে দণ্ডপ্রাপ্তদের বিলম্ব মার্জনার দরখাস্ত দাখিল করতে হবে। তিনি বলেন, যেহেতু আপিল বিভাগ তাদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছে তাই তাদের শুরুটা হাইকোর্ট থেকে করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ল এর পরিচালক ড. শাহদীন মালিক ইত্তেফাককে বলেন, যেহেতু মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা পলাতক রয়েছে সেহেতু তাদেরকে কারাগার থেকে আপিল করতে হবে। আপিলের সঙ্গে বিলম্ব মার্জনার দরখাস্ত দাখিল করতে হবে। এই দরখাস্তে কেন আপিল দায়ের করতে বিলম্ব হয়েছে তার যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা দিতে হবে। তখন রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি হবে এই ঐতিহাসিক রায় না জানার কারণ নেই। বিলম্ব মার্জনার দরখাস্ত যেন মঞ্জুর না হয়। তবে তা মঞ্জুর করা বা না করার এখতিয়ার আদালতের। তিনি বলেন, দরখাস্ত করলে তার ওপর শুনানি হতে হবে। দরখাস্তের ওপর হাইকোর্ট থেকে একটি সিদ্ধান্ত আসবে। তবে আদালত বিলম্ব মার্জনার দরখাস্ত প্রত্যাখ্যান করলে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের ফাঁসি কার্যকর করতে আইনগত কোন বাধা থাকবে না। কারণ তাদের ওপর আদালতের দেয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রয়েছে।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক
দিদারুল আলম
দৈনিক ইত্তেফাক
বৃহস্পতিবার, ২৮ জানুয়ারি ২০১০