ভারত সফর শতভাগ সফল নয়া দিগন্ত উন্মোচন হয়েছে

Hasina's return from India trip

ভারত সফর শেষে বুধবার দেশে ফিরলে বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জানান সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী এবং স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম

ভারত সফর শতভাগ সফল নয়া দিগন্ত উন্মোচন হয়েছে
দেশে ফিরে বিমান বন্দরে শেখ হাসিনা পথে পথে প্রাণঢালা সংবর্ধনা : ফুলেল শুভেচ্ছা
যাযাদি রিপোর্ট

ভারত সফর শতভাগ সফল হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এ সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্কে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। এ সফর এবং সমঝোতা স্মারক শুধু বাংলাদেশ ও ভারতের জন্যই নয়, নেপাল-ভুটানসহ এ উপমহাদেশের মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে। চারদিনের রাষ্ট্রীয় সফর শেষে বুধবার ভারত থেকে দেশে ফিরে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিভিআইপি লাউঞ্জে মন্ত্রিসভার সদস্য, দলের নেতা, এমপি এবং সাংবাদিকদের কাছে অভিজ্ঞতা বর্ণনাকালে তিনি এ কথা বলেন।

সন্ধ্যা পৌনে ৬টায় শেখ হাসিনা ও তার সফর-সঙ্গীদের নিয়ে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইট রানওয়েতে অবতরণ করে। সন্ধ্যা ৬টায় প্রধানমন্ত্রী ভিভিআইপি লাউঞ্জে প্রবেশ করেন হাসিমুখে। লাউঞ্জে ঢুকেই তিনি প্রথমে জড়িয়ে ধরেন জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে। এরপর তিনি একে একে মন্ত্রিসভার উপস্থিত সদস্যদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। পরে ভিভিআইপি লাউঞ্জের একটি কক্ষে তিনি প্রবেশ করেন। সেখানে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, বিভিন্ন বাহিনীর প্রধান, গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সচিবরাসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার সমমনা খ্যাতিমান ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। এখানে প্রধানমন্ত্রীকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ফুলের তোড়া দিয়ে শুভেচ্ছা জানান দলের কেন্দ্রীয় নেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও মাহবুব-উল আলম হানিফ। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, শেখ রেহানার ছেলে রিজওয়ান সিদ্দীক ববি ও তার স্ত্রী পেপপি ছিলেন।

এদিকে সফর সফল হওয়ায় পূর্ব সিদ্ধান্ত ও প্রস্তুতি অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে তার দল ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা বিমানবন্দর থেকে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন যমুনা পর্যন্ত এলাকায় প্রধান প্রধান পয়েন্টে সড়কের দুইপাশে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানায়। নেতাকর্মীদের সঙ্গে এ সময় হাজার হাজার সাধারণ মানুষও যোগ দেন। তবে এ কর্মসূচিতে শৃঙ্খলা না থাকার কারণে রাজধানীতে দীর্ঘমেয়াদি যানজটের সৃষ্টি হয়। প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে বিমানবন্দর ও আশপাশের এলাকায় কড়া নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়। এসএসএফের পাশাপাশি পুলিশ, র‌্যাব, আর্মড পুলিশ, ডিবি, এসবি, মহিলা পুলিশ ও সোয়াত বাহিনীর নিরাপত্তা তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে কয়েক ঘণ্টাব্যাপী। মন্ত্রী-এমপি ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাসহ দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের গাড়ি ব্যাপকভাবে তল্লাশি করা হয় এবং বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

নেতাকর্মীরা পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুুন, প্ল্যাকার্র্ড, ফুল প্রভৃতি হাতে নিয়ে রাস্তার দুইধারে দাঁড়িয়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে। ব্যান্ড পার্টি, মাইক, ঢোলসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র নিয়ে খোলা ট্রাকে করে নেচে-গেয়ে দলীয়প্রধান শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানায়। দলের শিল্পীরা এ সময় গেয়ে ওঠেন ‘জননেত্রীর আগমনে আইলো দেশে খুশির বান...’ শীর্ষক গান। শুভেচ্ছা জানাতে সবচেয়ে বেশি নেতাকর্মীর সমবেত হতে দেখা গেছে বিমানবন্দর ও প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন যমুনা এলাকায়। শীতের তীব্রতা উপেক্ষা করে এসব নেতাকর্মী বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজপথে দাঁড়িয়ে ছিল তাদের প্রিয় নেত্রীকে একনজর দেখতে ও অভিবাদন জানাতে। নেতাকর্মীরা শেখ হাসিনাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানায়। তারা প্রধানমন্ত্রীর গাড়িতে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে দেয়।

শেখ হাসিনা জানান, ভারতে তার চারদিন ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে কেটেছে। এ সফর দক্ষিণ এশিয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে দুই দেশের ভেতরে অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো।

ভারত সফরে পাঁচটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকলে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চুক্তি সমঝোতা সহজ হয় এ সফর তা প্রমাণ করেছে। সফরে অনেক সমঝোতা হয়েছে যা এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় অবদান রাখবে। তিনি বলেন, তারা যে সমঝোতায় এসেছেন তা এ অঞ্চলের সব দেশের মানুষের দারিদ্র্য থেকে মুক্তি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক সম্প্রীতি বাড়াবে। তারা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। এ অঞ্চলের ড্রাগ, নারী ও শিশু পাচার, অস্ত্র পাচার, চোরাচালান বন্ধ হওয়া দরকার। সেজন্য দুই দেশের মধ্যে আরো কিছু বিষয়ে সমঝোতার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান অত্যন্ত দৃঢ়। তারা চান শান্তি। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখতে চান। যে কোনো সমস্যা হলে সেটা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে চান। এ অঞ্চলের মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তাদের লক্ষ্য।

শেখ হাসিনা জানান, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫০তম জন্মদিন ভারত ও বাংলাদেশ একসঙ্গে উদযাপন করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধী শান্তি পদকের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভারতের রাষ্ট্রপতির হাত থেকে এ পুরস্কার তিনি গ্রহণ করেছেন। এ সময় সে দেশের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ও কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী উপস্থিত ছিলেন। দেশের জনগণকে এ পদক উৎসর্গ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এ পদক তার নয়, এটা বাংলাদেশের জনগণের। পদকের প্রাপ্ত অর্থ জনকল্যাণে ব্যয় করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের মাধ্যমে গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তির জন্য ও চিকিৎসাসেবায় এ টাকা ব্যয় করা হবে।

দিল্লিতে সংবাদ সম্মেলন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।

ভারতে চারদিনের সফর শেষে বুধবার জয়পুরের উদ্দেশে নয়াদিল্লি ত্যাগের আগে হোটেল মৌর্য শেরাটনে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ছোট-বড় নির্বিশেষে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে এ অঞ্চলের সব দেশকে একযোগে কাজ করতে হবে।

ভারত সফরকে খুবই সফল বর্ণনা করে শেখ হাসিনা বলেন, তিনি বন্ধুত্ব, সহযোগিতা ও পারস্পরিক সমঝোতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ঢাকা ফিরে যাচ্ছেন। তার এ ভারত সফরের মধ্য দিয়ে সহযোগিতা ও অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হওয়ার কথা উলেখ করে তিনি বলেন, এ সফর সম্পর্কে অন্যরা (বিরোধী) কী বলবে আমি জানি না। কিন্তু আমি মনে করি সফর পুরোপুরি সফল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারত ও তার জনগণের সহযোগিতার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, তারা আমাদের জনগণকে আশ্রয় ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। ভারত আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু। বাংলাদেশের ভূমি কখনই সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে ব্যবহার করতে দেয়া হবে নাকি এ কথা পুনর্ব্যক্ত করে ভারতীয় এক সাংবাদিককে তিনি বলেন, সন্ত্রাসীদের দমনে আগের সরকার কী করেছিল আমি তার জবাব দিতে পারবো না। এ ব্যাপারে তারাই ভালো বলতে পারবেন।

শেখ হাসিনা বলেন, আমি নিজেই সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছি। এক জনসমাবেশে আমাকে লক্ষ্য করে ১২টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। এ হামলায় মহিলা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী আইভী রহমানসহ দলের ১২ নেতাকর্মী নিহত হন। তিনি বলেন, এ অঞ্চলের সব দেশে নির্বাচিত সরকার রয়েছে এবং আমরা এ অঞ্চলের কোথাও সন্ত্রাসীদের সমর্থন করি না। শেখ হাসিনা বলেন, সন্ত্রাসীদের কোনো ধর্ম নেই, দেশ নেই এবং সীমান্তও নেই। তারা শুধুই সন্ত্রাসী এবং তাদের শক্ত হাতে দমন করতে হবে।

তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি নাকি এ প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, এ ব্যাপারে টেকনিক্যাল কমিটি বৈঠক করেছে এবং সচিব পর্যায়েও আলোচনা হয়েছে। যৌথ নদী কমিশনের পরবর্তী বৈঠকে এ ব্যাপারে আলোচনা হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান হতে পারে।

টিপাইমুখ বাঁধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বার্থ বিঘ্নি্ত হতে পারেকি এমন কোনো কিছুই করা হবে না বলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। এ ধরনের একজন নেতার অঙ্গীকার সাদরে গ্রহণ করা উচিত। এছাড়া টিপাইমুখ এলাকায় কোনো স্থাপনা না থাকায় এ নিয়ে আলোচনারও কিছু নেই।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ভারতবিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি পেয়েছিল, যা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রশমিত হয়েছে - এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে শেখ হাসিনা বলেন, এ মনোভাব অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, তারা যা করতে চায় তাদের তা করতে দিন। কিন্তু আমাদের সময় এ মনোভাব কাজ করবে না। আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে সবসময়ই বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক সহযোগিতাকেই প্রাধান্য দেবো।

তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি ও রেলওয়েমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে তার ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। পশ্চিম বাংলা সফর বাতিল প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, দেশে ব্যস্ততার কারণে তা সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, কিন্তু জ্যোতি বসুর স্বাস্থ্য নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন। তিনি এ উপমহাদেশের সবচেয়ে বর্ষীয়ান নেতা। আমি তাকে সবসময়ই শ্রদ্ধা করি।

প্রধানমন্ত্রীর ফাতেহা পাঠ

প্রধানমন্ত্রী বুধবার মহান সুফি সাধক হজরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহ.)-এর মাজারে ফাতেহা পাঠ করেন। প্রধানমন্ত্রী জয়পুর থেকে হেলিকপ্টারযোগে সেখানে পৌঁছলে বিভাগীয় কমিশনার ও রাজস্থান সরকারের পদস্থ কর্মকর্তারা তাকে অভ্যর্থনা জানান।

দরবার শরিফে যাওয়ার পথে সর্বস্তরের মানুষ রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের নেতাকে শুভেচ্ছা জানান। শেখ হাসিনা হাত নেড়ে শুভেচ্ছার জবাব দেন। দরবার শরিফের প্রধান খাদেম দরবার চত্বরে শেখ হাসিনা, তার ছোট বোন শেখ রেহানা ও সফরসঙ্গীদলের সদস্যদের অভ্যর্থনা জানান।

শেখ হাসিনা ও তার সফরসঙ্গীরা মাজারে ফাতেহা পাঠ করেন। শেখ হাসিনা এ মহান সুফি সাধকের মাজারে একটি গিলাফ চড়ান। মাজারের প্রধান খাদেম তাকে একটি গিলাফ উপহার দেন। প্রধানমন্ত্রী ওই গিলাফটিও মাজারে বিছিয়ে দেন। ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে শেখ হাসিনা জয়পুরে ফিরে এলে রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক ঘাটল তাকে অভ্যর্থনা জানান।

সূত্র: যায় যায় দিন
ছবি: যায় যায় দিন
তারিখ: ১৪ জানুয়ারি, ২০১০
http://www.jaijaidin.com/details.php?nid=170531