প্রথম পর্বঃ মার্ডার অন্ দ্যা ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস। আগাথা কৃষ্টি।
সিরিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ মিশন শেষে ইস্তাম্বুল হতে লন্ডনগামী ’ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসে’ চেপে বসলেন Hercule Poirot। বছরের এ সময়টায় ট্রেনের অস্বাভাবিক ভীড় বেশ অবাক করল এই ডিটেকটিভ্কে। টিকেট পেতেও সাহায্য নিতে হল বন্ধু মিঃ বৌক্’এর। যৌথ বার্থে প্রথম রাতটা কষ্ট করে কাটালেও দ্বিতীয় রাতে নিজের জন্যে আলাদা কম্পার্টমেন্ট পাওয়ায় ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলেন মনে মনে।
সে রাতে, বেলগ্রেডের কাছাকাছি কোথাও হবে, ১টা বাজার তেইশ মিনিট আগে বিকট শব্দে ঘুম ভেংগে গেল Hercule Poirot’র। শব্দটা পাশের কম্পার্টমেন্টের মিঃ রসেট’এর গলার মত শোনাল। দরজা খুলে বেরিয়ে আসতেই চোখে পরল ট্রেন কন্ডাক্টর টোকা দিচ্ছে রসেটের দরজা। ভেতর হতে ফ্রেঞ্চ ভাষায় কেউ একজন উত্তর দিল, ’সব ঠিক আছে, একটা ভুলের কারণে এ শব্দ’। কন্ডাক্টর আশ্বস্ত হয়ে ফিরে গেল নিজ কামরায়। Poirot ঘুমোনোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু ট্রেনটা থেমে থাকায় কৌতূহলী হয়ে উঠল তার সন্ধানী মন। কলিং বেল টিপে এক বোতল পানি চাইলেন কন্ডাক্টরের কাছে। হঠাৎ করে ট্রেনের জরুরী বেলটা বেজে উঠল কোথাও। পানি দিতে এসে কন্ডাক্টর জানাল মিসেস হুবার্ড সন্দেহ করছেন তার কামড়ায় অনাহুত কেউ একজন ঢুকে পরেছে। কন্ডাক্টরকে বিদায় দিয়ে আবারও ঘুমোনোর চেষ্টা করলেন Poirot। বাইরে প্রচন্ড তুষার ঝড়, থেমে গেছে ট্রেনের যাত্রা। দরজায় কেউ একজন হাত রাখছে এমনটা মনে হতে বিছানা ছেড়ে উঠে পরলেন আবারও। আলো আধারীর রহস্যময় করিডোরে কিমানো পরিহিত কারও পীঠ দেখে অবাক হলেন তিনি।
সকালে ঘুম ভাংগল মিঃ রসেটের মৃত্যু সংবাদে। বেচারার শরীরে ১২টা আঘাতের চিহ্ন। ছুরির আঘাত গুলো বেশ রহস্যময় মনে হল Poirot’র কাছে। কোনটা বেশ গভীর, কোনটা আবার একেবারেই কাঁচা হাতের। ডান হাত আর বা হাতের আঘাত লক্ষ্য করে Poirot বুঝে নিলেন খুনী একজন নয়, একাধিক। মৃতের কামরায় আরও কিছু আলামত জব্দ করলেন তিনি, যার মধ্যে অন্যতম ছিল সিল্কের রুমালের উপর "H" অক্ষর সেলাই করা রুমাল, তামাক পাইপ পরিষ্কার করার হাতল ও গার্ড ইউনিফর্মের একটা বোতাম। প্রতিটা আলামত ই ভিন্ন জনের ইঙ্গিত বহন করছিল। Poirot বুঝতে অসুবিধা হলনা বিভ্রান্ত করার জন্যেই আলামতগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে সাজানো হয়েছে। লাশের পাশে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে পরে থাকা একটা চিঠি পুনঃ গঠনের মাধ্যমে Poirot উদ্ধার করতে সক্ষম হল রসেটের আসল পরিচয়। যুক্তরাষ্ট্রের নটরিয়াস ফিউজেটিভ রসেটের আসল নাম কাসেট্টি। এই কাসেট্টি ৩ বছর বয়েসী ডেইজী আর্মষ্ট্রংকে কিডন্যাপ করে বিপুল অংকের পন আদায় করে নেয় আর্মষ্ট্রং পরিবার হতে। কিন্তু তাও সে খুন করে শিশু ডেইজীকে এবং পালিয়ে যায় আমেরিকা হতে। ডেইজীর মা ছিল পোয়াতী, খবর সইতে না পেরে প্রি-ম্যচুরড্ প্রসবে মারা যান তিনি। মনের দুঃখে ডেইজীর বাবা মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন। রাতে দেখা রহস্যময়ী নারীর পরনের কিমানোটা রসেটের লাগেজে দেখে Poirot বুঝে নেন কোন একটা মাষ্টার প্লানে খুন করা হয়েছে রসেটকে। Hercule Poirot’র সুচতুর জেরার মুখে বেরিয়ে আসে কামরার ১১জন যাত্রীর রসেটের জীবনের সাথে জড়িত থাকার কাহিনী। ১২ জনের কামরায় একজনের নাম ইচ্ছাকৃতভাবেই ভুল বসানো হয়েছিল যাতে করে বিভ্রান্ত করা যায় ১২টা আঘাত। এই ১২তম ব্যক্তি আদৌ ট্রেনে উঠেনি, এবং এ কারণেই Poirot’র টিকেট পেতে সুবিধা হয়েছিল। একে একে এগার জনের পরিচয় এভাবে সাজাল তিনি:
১) মাষ্টারম্যান - কর্নেল আর্মষ্ট্রং’এর যুদ্বকালীন সময়ের পরিচর্যাকারী
২) কর্নেল আরাবাটনট - কর্নেল আর্মষ্ট্রং’এর অতি ঘনিষ্ট বন্ধু
৩) মিসেস হুবার্ড - অভিনেত্রী। আসল নাম লিন্ডা গোলডেন্বার্গ, নিহত ডেইজীর নানী
৪) কাউন্টেস আদ্রেনী - ডেইজীর খালা
৫) প্রিন্সেস ড্রাগমিরফ - ডেইজীর গডমাদার
এবং অন্যান্য।
সমস্ত আলামত বিশ্লেষণ পূর্বক খুনের দুটি মোটিভ উপস্থাপন করেন Poirot; প্রথমতঃ রসেটের গ্যাংষ্টার শত্রুদের কেউ একজন পুরানো শত্রুতার প্রতিশোধ নিতে গভীর রাতে ট্রেনে প্রবেশ করে খুন করে মিলিয়ে যায় তুষার ঝড়ে। দ্বিতীয় মোটিভ টা খুবই চমকপ্রদ ও লোমহর্ষক। Poirot মতে, কামড়ার ১১জন যাত্রীর সবাই মিলে খুন করেছে রসেটকে। এই ১১ জনের সবাই আর্মষ্ট্রং পরিবারের আত্মীয় অথবা শুভাকাঙ্ক্ষী। ৩ বছর বয়সী ডেইজীর খুন ও তার পিতা-মাতার অপমৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে বছরের পর বছর ধরে এরা পরিকল্পনা করেছে এবং অপেক্ষায় থেকেছে মোক্ষম সময়ের। ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসে যৌথ মার্ডারের সবকিছুই পরিকল্পনা মাফিক এগোচ্ছিল, শুধু বাধ সাধে Poirot’র উপস্থিতি। ১১জনের সবাই কান্নায় ভেংগে পরে Poirot’র সামনে এবং স্বীকার করে নিজেদের দোষ। Poirot এবং তার বন্ধু মিঃ বৌউক্ মিলে সিদ্ধান্ত নেয় পুলিশের কাছে খুনের প্রথম মোটিভটা তুলে ধরার।
২য় পর্ব। মার্ডার অন দ্যা বিডিআর ফ্রন্ট। পিলখানা, ঢাকা।
২৪শে ফেব্রুয়ারীর, ২০০৯ সাল। বাংলাদেশ রাইফেলস্’এর হেডকোয়ার্টার পিলখানার দরবার হলে বসতে যাচ্ছে সেনা-জওয়ানদের বার্ষিক যৌথসভা। সভার শুরুতেই গর্জে উঠল জওয়ানদের অস্ত্র। ৫৭ জন সেনা অফিসারের রক্তে রঞ্জিত হল পিলখানার মাটি।
পূর্ব কথাঃ
১৫ই আগষ্ট, ১৯৭৫ সাল। সেনা অফিসারদের অস্ত্রের গর্জনে লুটিয়ে পরল বাংলাদেশের স্থপতি ও তার পরিবারের প্রায় সবাই। একই সেনাদল জাতীয় নেতাদের কাপুরুষের মত হত্যা করল জেলখানায়। ক্ষমতা দখলের দৌড়ে নিজেরা প্রাণ হারাল, সাথে নিল আরও শত শত প্রাণ।
৩০শে মে, ১৯৮১ সাল। জেনারেল জিয়া সেনাপতির উর্দি ফেলে সিভিলিয়ান তকমা লাগানোর আয়োজন সমাধা করে ফেলেছেন প্রায়। এমনি এক প্রেক্ষাপটে সেনাছাউনির অফিসারদের অস্ত্রের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল তার লাশ।
১লা জানুয়ারী, ২০০৭ সাল। গণতন্ত্র উত্তোরণের পথে বাংলাদেশ থমকে গেছে। রাজনৈতিক অরাজকতার সূযোগ সেনাছাউনির জেনারেলরা ব্যারাক হতে বেরিয়ে চেপে বসল রাষ্ট্রযন্ত্রে। উদ্দেশ্য, পথচ্যুত ট্রেনকে পথে ফিরিয়ে আনা। এমন পথের বলি হয়ে একে একে জেলে গেল দেশের নেতা নেত্রীর দল। মাসের পর মাস জেল খাটলেন ওনারা। জাতি অবাক হয়ে শুনল তাদের নৈতিক স্খলনের কাহিনী।
২৪শে ফেব্রুয়ারী পৈশাচিক হত্যাকান্ডের সন্ধিক্ষণে খুনিদের নেতা তৌহদকে তলব করা হল সেনা অফিসারদের নির্মম খুনে স্বজনহারা প্রধানমন্ত্রীর দরবারে। খুনী তৌহিদকে বিডিআর প্রধান বানিয়ে বাকি সবার জন্যে সাধারণ ক্ষমার ঘোষনার মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আপদকালীন ঝামেলা মোকাবেলায় নিজের ’চৌকষতা’ প্রমান করলেন। পাশাপাশি শত শত অপরাধীদের জন্যে খুলে দেয়া হল পালানোর রাস্তা। ক্রাইসিস মোকাবেলায় নেত্রীর এই ’পটুতায়’ মুগ্ব হয়ে জাতি প্রধানমন্ত্রীকে উপহার দিল ’শান্তিকন্যা‘ উপাধি। ৫৭ অফিসারের রক্ত না শুকাতেই ’শান্তিকন্যার’ পুরস্কার গ্রহন করে নেত্রী ধন্য করলেন জাতিকে।
যে সেনা অফিসারদের অস্ত্রের কাছে বলি দিতে হয়েছে মা-বাবা, ভাই সহ গোটা পরিবার, যাদের পৈশাচিকতায় ছিন্নভিন্ন হয়েছিল স্বামীর লাশ, সেই সেনা অফিসারদের প্রাণ রক্ষার্থে এগিয়ে আসবেন দুই নেত্রী, এমনটা যারা ভেবেছিলেন তাদের হয়ত আগাথা কৃষ্টির ’মার্ডার অন দ্যা ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস’ উপন্যাসটা পড়া ছিলনা।
-ধন্যবাদ।