এ ধরনের খবর ইদানিং আমাদের খুব একটা বিচলিত করেনা। একই ঘটনা বার বার ঘটলে খবরে সেনশনালিজম থাকেনা, প্রচার মাধ্যমও তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে কর্পোরেট ইন্টারেস্টের কারণে। কিন্তু তাই বলে খবর কারও অপেক্ষায় থাকেনা, বাংলাদেশের শহর-বন্দর, গ্রামে-গঞ্জে নিয়মিতই ঘটে চলছে এমন ঘটনা। অনেক ঘটনা খবরের জন্ম দেয়, অনেকগুলো আবার দুফোঁটা চোখের পানির সাথে মিশে যায় জন্মভূমির মাটিতে। ধন্যবাদ দৈনিক ইত্তেফাক্কে খবরটা প্রকাশের জন্যে। বখাটেদের অত্যচার হতে বাচার জন্যে ১৪ বছরের কিশোরী বিলকিস আক্তার আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। ঘটনার স্থান কিশোরগঞ্জ জেলার মূলসতাল ভট্টাচার্যপাড়া গ্রামে। পাঠকদের কাছে ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরার খুব একটা প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়না। বেশ কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে গঞ্জের স্কুলে যেতে হয় কিশোরীকে। কিশোরী স্কুলে যায় আর তার চলার পথে আঠার মত লেগে থাকে এক বা একাধিক রোমিও। প্রেম নিবেদন দিয়ে শুরু, ব্যর্থ হলে শুরু হয় উত্যক্ত পর্ব এবং ক্ষেত্র বিশেষে এর শেষ হয় ধর্ষণ অথবা হত্যার মধ্য দিয়ে। আধুনিক বাংলাদেশের প্রতিটা গ্রাম আক্রান্ত এ ধরনের রোমিও রোগে।
পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থায় শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে ব্যাপকভাবে, এবং চাহিদার সাথে তাল মেলাতে মা-বাবা পুত্র সন্তানদের পাশাপাশি তাদের কন্যা সন্তানদেরও স্কুলে কলেজে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন। বিলকিসের মৃত্যু বিচ্ছিন্ন কোন মৃত্যু নয়। এ ধরনের মৃত্যু হতে বাংলাদেশের কোন বিলকিসই নিরাপদ নয়। এমনটা জেনেই মা-বাবা তাদের সন্তানদের ঘরের বাইরে পাঠাচ্ছেন। অতীতেও অনেক বিলকিস প্রাণ দিয়েছে এবং সামনে আরও বিলকিসকে দিতে হবে অনেকটা অসহায় হয়ে। কারা এই বখাটে? বখাটেদের ট্রেইল ধরে কিছুটা সামনে গেলেই বেরিয়ে আসবে শক্তিশালী এ চক্রের অনেক অজানা তথ্য। আজ পর্যন্ত বিলকিসদের মৃত্যুর জন্যে দায়ী রোমিওকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হয়েছে এমন কোন রেকর্ড নেই। এর পেছনে কাজ করে বহুমুখী কারণ। প্রথমত, আমরা যাদের বখাটে আখ্যায়িত করে বিলকিস খুনের সব দায় দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করি তাদের থাকে শক্তিশালী রাজনৈতিক কানেকশন। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় এই বখাটেদের অনেকেই স্থানীয় মেম্বার চেয়ারম্যানদের সন্তান যাদের জন্যে আইনী ব্যাপার কোন ব্যাপার নয়। মেম্বার-চেয়ারম্যানদের ধরা হয় রাজনৈতিক পাওয়ার হাউজের মূল হাতিয়ার এবং এদের হাত ধরেই নির্বাচনী বৈতরনি পার হতে হয় উপরতলার রাজনৈতিক গডফাদারদের। বিলকিস হত্যা দায়ে মেম্বার-চেয়ারম্যানদের সন্তানকে রক্ষা করা রাজনীতিবিদ্দের জন্যে হয়ে দাড়ায় নির্বাচনী রাস্তা নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ হিসাবে। দ্বিতীয়ত, বিশ্ব ইতিহাসের সব চাইতে নিকৃষ্টতম আইন রক্ষাকারী বাহিনীর অন্যতম অংশ আমাদের পুলিশ চক্র, তাদের জন্যে একজন বিলকিসের মৃত্যু খুলে দেয় ভাগ্য গড়ার নতুন দিগন্ত। একজন বিলকিস আত্মহত্যা করে এবং সাথে ভাগ্য ফেরে থানার ওসি-দারোগাদের। রাজনীতির ঘোলা পানিতে বিলকিসদের লাশ হয়ে যায় লাভজনক পণ্য এবং দায়ী রোমিওরা হয়ে যায় দাবার ঘুঁটি। শত শত কিশোরীর হত্যা, খুন অথবা আত্মহত্যা এভাবেই রাজনৈতিক সাংস্কৃতির বলি হয়ে ঠাঁই নেয় কোলড্ কেস স্টোরে।
একটা সময় ছিল যখন যে কোন ঘটনার জন্যে দায়ী করা হত বঞ্চিত নারী অধিকারকে। বিশ্বের অন্য যে কোন দেশের তুলনায় বাংলাদেশে নারী অধিকার প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে স্বীকৃত। এ দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদ সহ সরকারী অনেক পদ নারীদের দখলে। যুদ্বাপরাধীর বিচার ও নাম পরিবর্তনের মত বিশাল বিশাল কর্মসূচীর ফাঁকে একজন গ্রাম্য কিশোরী বিলকিসের মৃত্যু খবর ক্ষমতাসীন নারী রাজনীতিবিদ্দের জন্যে কোন খবর কিনা তা ওনারাই ভাল বলতে পারবেন। একটা সুস্থ ও স্বাভাবিক সমাজে বিলকিস হত্যার যথাযত বিচার নিশ্চিত পূর্বক এ জাতীয় অপরাধ চিরদিনের জন্যে বন্ধ করার অপর নামই নামই আইনের শাসন। এমন শাসন হতে আমরা কত লক্ষ মাইল দূরে?