আমার খোয়াবনামা...

Submitted by WatchDog on Wednesday, March 31, 2010

Bangladeshi

প্রতীক্ষার অবসান ঘটাইয়া অবশেষে খোয়াব দেখিলাম। একটা মাস খুব চিন্তায় আছিলাম। দোকান হইতে দাওয়াই কিনিলাম, পীর আউলিয়ার দরগায় মানত করিলাম, গোস্বায় অন্দর মহল কারবালা বানাইলাম, কিন্তু সবই বিফলে গেল। একজন নিবিড় খোয়াব ভক্তকে খোয়াব বিবি কেন তালাক দেয় উহার বৈজ্ঞানিক কারণ কোন ভাবেই দাড় করাইতে পারিলাম না। নেট ঘাঁটিলাম, যাহারা আমার খোয়াব প্রীতির সহিত বিশেষ পরিচিত তাহাদেরও পারামর্শ চাহিলাম, কিন্তু কাজ হইল না। খোয়াব বিহীন একটা মাস কত কষ্টের উহা বিবাহিত বিবিকেও বুঝাইতে পারিলাম না। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিলনা।

আমি এবং খোয়াব, এই দুই স্বত্তা আলাদা করিবার ক্ষমতা স্বয়ং খোয়াব দেবতার ও আছে কিনা একসময় বিশ্বাস করিতে কষ্ট হইত। ইচ্ছা করিলেই আমি খোয়াব দেখিতে সক্ষম হইতাম, হোক তা মধ্য দুপুরেও। ফ্রি ষ্টাইল খোয়াব দেখিবার এই অলৌকিক ক্ষমতার অর্জনের জন্য আমার এক প্রাক্তন উপ-প্রেমিকাকে ধন্যবাদ না জানাইলে অন্যায় হইবে। ব্যাপারটা এই রকম; মদের আসরে মদ খাইতে অস্বীকার করিলাম পাপের ভয়ে। প্রেমিকার খণ্ডকালীন অনুপস্থিতিতে আমার নিয়ন্ত্রণ তখন উপ-প্রেমিকার হাতে। মদ না খাওয়ায় তিনি রাগ করিলেন এবং আমাকে নিয়মিত মদ্যপানের অভিযোগে অভিযুক্ত করিলেন। হায় হায় করিয়া উঠিলাম, জানিতে চাহিলাম উহা কি করিয়া সম্ভব। উত্তরে আমার দুই বেলা চার গামলা ভাত খাওয়ার দিকে অঙ্গুলি হেলন করিলেন তিনি। উনার মতে, ভাত পেটের ভেতর গিয়া অ্যালকোহল বনিয়া মগজে নেশা ধরায়। দুপুরে ভাত খাওয়া শেষ হইতে না হইতেই আমার দু’চোখে এত ঘুম কোথা হইতে আছর করে উহার বৈজ্ঞানিক কারণ খুঁজিয়া পাইয়া বিশেষ পুলকিত বোধ করিলাম। সেই হইতে শুরু। খোয়াব দেখিবার খায়েশ হইলেই ভাতের পরিমান বিপজ্জনকভাবে বাড়াইয়া দেই, ভাত পেটে গিয়া মদ বানায়, মদ নেশার ত্যানা পেচায়, নেশা ঘুম আনে, আর ঘুমাইলে খোয়াব বিবির সহিত আমার নিবিড় মহব্বত হয়। এক কথায় উপ-প্রেমিকা আমার চোখ খুলিয়া দিয়াছিল সম্ভাবনার নয়া দিগন্তের। আর এই খোলা চোখে বছরের পর বছর ধরিয়া আমি হাজার রকম রসালো খোয়াব উপভোগ করিলাম। রাস্তায় চোখ ধাঁধানো সুন্দরীর দেখা পাইলে কষ্ট বলিতে আমাকে যাহা করিতে হইত তাহা কেবল দুই নলা অতিরিক্ত ভাত পাকানো। ব্যাস, ভাত খাইসি তো কেল্লা ফতেহ, সুন্দরী আমার বাহুলগ্না, হোক তা খোয়াবে।

একটা মাস বিনা পয়সার এমন নির্ভেজাল আনন্দ হইতে বঞ্চিত হইয়া কতটা কষ্ট পাইয়াছি উহা পাঠকদের বুঝাইতে পারিব না। সব চেষ্টা ব্যর্থ হইবার পর মনে মনে ভাবিলাম হয়ত আমরিকান চাউলের ভাত উহার খোয়াবি পুরুষত্ব হারাইয়া ফেলিয়াছে। এমনটা মনে হইতেই সুদূর নিউ ইয়র্ক হইতে বন্ধু মারফত ১০টাকা কেজির বংগবন্ধুয়ীয় চাউল আনাইয়া ভাত পাকাইলাম। পাকাইতে যত দেরী, কিন্তু খোয়াবি একশ্যানে যাইতে বিশেষ দেরী হইল না। খাইলাম আর সাথে সাথে ঘুমাইয়া পরিলাম। একটা মাস খোয়াবি রোজা শেষে ঈদের আনন্দের মত আনন্দ পাইলাম। অবশেষে আমি খোয়াব দেখিলাম। সে কি খোয়াব!!!

দেশে ফিরিতেছি আমি। ক্রিষ্টিনা এয়ারলাইনসের সুপরিসর বিমান রানওয়েতে হাল্কা ল্যান্ডিং করিতেই মনটাও হালকা হইয়া গেল। আর হইবে না-ই বা কেন? হাজার হোক জন্মভূমিতে ফিরিতেছি তো! কিন্তু গোলমাল শুরু হইল এয়ারপোর্টের নাম পড়িতে গিয়া। এমন অদ্ভুত নাম কোথা হইতে আসিল উহার কোন কুল কিনারা করিতে পারিলাম না। ‘শাহ সূফীয়ানী সৈয়দা আইনুন্‌নাহার (রাঃ) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর‘। অতিরিক্ত চশমার প্রয়োজন হইল নাম পড়িতে। পড়িলাম, কিন্তু নামের উৎস কি উহা ভাবিয়া ভ্যবাচেকা খাইয়া গেলাম। শেখ পরিবারের কাহারও নাম সৈয়দা আইনুন্‌নাহার, তাও আবার রাঃ, না, মগজের হার্ড ডিস্ক তন্ন তন্ন করিয়াও রিট্রিভ করিতে ব্যর্থ হইলাম। শেষ মেশ ধরিয়া নিলাম হয়ত একই পরিবারের কোন মুরব্বীর নামে নাম রাখা হইয়াছে এয়ারপোর্টের। অসুবিধার কোন কারণ দেখিলাম না এই পরিবর্তনে, হাজার হোক এটা তো তাদেরই দেশ! আল্লাহর নাম জপিতে জপিতে বিমান বন্দর পার হইয়া শহরের দিকে রওয়ানা হইলাম।

সংসদ ভবনের অনতিদূরে নতুন একখান আলিশান ইমারত দেখিয়া স্তব্ধ হইয়া গেলাম, তাজমহল! দিল্লীর তাজমহল ঢাকায় কি করিতেছে ভাবিয়া টাসকি খাইলাম, ভাবিলাম দাদারা হয়ত প্রতিদান হিসাবে শেখ হাসিনাকে উপহার দিয়াছে এই ঐতিহাসিক স্থাপনা। কাছে আসিতেই ভূল ভাংগিল। না, এইটা তাজমহল না, জেনারেল জিয়ার মাজার। বিশেষ একটা গানের সূর ভাসিয়া আসিতেছে মাজার হইতে, ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ‘। চাকচিক্য আর জৌলুসে ভরা এমন একটা বাহারী ইমারত আর সাথে আবেগঘন গানের সূর শুনিয়া মনটা জুড়াইয়া গেল। নিজকে ধন্য মনে করিলাম এমন একটা দেশে জন্মাইতে পারিয়া। কিছুদূর আগাইয়া যাহা অবলোকন করিলাম তাহাতে ক্ষণিক আগের ধন্যবোধ বেশ কিছুটা দমিয়া গেল। মাওলানা নিজামী! দেখিলাম গাড়িতে পতাকা উড়াইয়া মাজারে প্রবেশ করিতেছেন এই ধূর্ত শিয়াল। মগজের সকল চেম্বার একসাথে জমিয়া গেল, আমি কি বাংলাদেশে না অন্য কোথাও, এমন একটা চিন্তা মাথায় ঢুকিতেই নিজের গায়ে নিজেই চিমটি কাটিয়া পরখ করিলাম। না, আমি বাংলাদেশেই। কিন্তু আমার জানা ছিল মাওলানা নিজামী যুদ্ধাপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হইয়া জেলখানায় ফাঁসির দিন গুনিতেছেন। একই মাওলানা রাতারাতি কি করিয়া মন্ত্রী হইয়া গেলেন ভাবিতেই আমার ভীষন টয়লেট চাপিল। ড্রাইভারকে সুবিধামতো জায়গায় থামিতে বলিলে সে থামিল। ’কুকু জিয়া’ শৌচাগার! তাজ্জব হইলাম আবারও, যতদূর জানি এই শৌচাগারের সর্বশেষ নাম ছিল বঙ্গবন্ধু শৌচাগার।

ভুলটা ভাঙ্গাইলেন এয়ারপোর্ট হইতে ভাড়া করা ট্যাক্সি ক্যাবের মহামান্য ড্রাইভার সাহেব। শেখ পরিবারের পারিবারিক ক্লাব আওয়ামী লীগ ক্ষমতা না-কি হারাইয়াছে সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে। দেশে এখন জিয়া ও মজুমদার পরিবারের যৌথ শাসন, তাই নাম বদলানো হইয়াছে শৌচাগারের পর্যন্ত। এয়ারপোর্টের নতুন নামের উৎস কি উহা জিজ্ঞাসা করিতে উত্তরে জানাইলেন খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত বুয়ার নামে নামকরণ করা হইয়াছে উহার। শেখ পরিবারকে শিক্ষা দিতেই না-কি এই ব্যবস্থা। একই কারণে মাওলানা নিজামীকেও না-কি বানানো হইয়াছে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী।

ফোনের কর্কশ চিৎকারে ঘুম হইতে বেহুঁশের মত লাফাইয়া উঠিলাম। বন্ধু মোল্লা মিয়া ফোন করিয়াছেন নিউ ইয়র্ক হইতে। উনি আজব একটা তথ্য দিলেন, বর্তমান আওয়ামী সরকার এইমাত্র নতুন এক আইন প্রণয়ন করিয়াছেন যাহাতে বলা হইয়াছে, এখন হইতে ১৫ কোটি বাংলাদেশী কেবল বঙ্গবন্ধু এবং এতদ্‌সংক্রান্ত খোয়াবই দেখিতে পারিবে, উহার অন্যথা হইলে খোয়াবিদের দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হইবে এবং বিশেষ ট্রাইবুনালে বিচার করিয়া চরম শাস্তির ব্যবস্থা করা হইবে। বিদেশে বসবাসরত স্বদেশিদেরও এর আওতায় আনা হইয়াছে।

আমার দেখা খোয়াবের কোন ইষ্টিশান নাই যে উহাকে লাগাম টানিয়া ধরিব। বিদেশী বিবিকে সব বুঝাইয়া বলিতে তিনি ভয়ে মূর্ছা গেলেন। এই যাত্রায় নিউ ইয়র্ক হইতে আমদানি করা ১০টাকা কেজির বংগবন্ধুয়ীয় চাউল ফেরৎ পাঠানোর সিদ্ধান্ত লইতে বাধ্য হইলাম। আগে জান তারপর খোয়াব!

পাঠককুল, আপনারা আমার জন্যে দোয়া করিবেন যাহাতে ঘন ঘন ভাত খাইবার খায়েশ না জাগে।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন