দাউ দাউ করা আগুনের মত ছড়িয়ে পরল খবরটা, কচুপাতার উলটো পিঠে নৌকার ছবি দেখা যাচ্ছে। শহরের আবাল বৃদ্ববণিতা হুমড়ি খেয়ে পরল কচু গাছ নিধনের মহোত্সবে। যে দেখতে চাইল সে খুঁজে পেল নৌকার ছায়া, যে চাইলনা অবজ্ঞা ভরে উড়িয়ে দিল নির্বাচনী মাঠে আওয়ামী লীগের নতুন ষ্ট্যান্ট হিসাবে। শহরের সংখ্যালঘুরা খবরটাকে শুধু দৈনন্দিন খবর হিসাবেই নিল না, বরং ঐশ্বরিক কোন আবির্ভাব ভেবে উপবাস পর্যন্ত শুরু করে দিল। একটা মাস ধরে শহরে রাজত্ব করল এই অতি-ঐশ্বরিক দৈবতত্ত্ব। সময় এবং চাহিদার গর্ভে জন্ম নেয়া নতুন তত্ত্বের কাছে পরাজিত হওয়ার আগ পর্যন্ত এ নিয়ে চল্লো হাজার রকমের আলোচনা, সমালোচনা ও মুখরোচক গল্প। এমন আজগুবি গল্প রটানোর পেছনে যাদের যা উদ্দেশ্য ছিল তা কিন্তু হাসিল হয়ে গেল ইতিমধ্যে। অনেকেই বিশ্বাস করলো এবারের নির্বাচনে নৌকার সর্মথনে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা ও মাঠে আছেন, এবং এই বিশ্বাসকে পুঁজি করে শহরের ভোটাররা ব্যালট বাক্স ভাসিয়ে দিল নৌকার জোয়ারে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনী সময় তখন। নির্বাচনে কে জিততে যাচ্ছে এ নিয়ে কারও মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিলনা। নির্বাচনী উৎসবের ভরা যৌবনে শহরের উত্তপ্ত পরিবেশে প্রাণ সঞ্চার করতে করতে এগিয়ে এলেন সময়ের প্রবাদ পুরুষ শেখ মুজিবর রহমান। স্থানীয় ঈদগাহ মাঠে আওয়ামী প্রার্থীর পক্ষে ভাষন দেবেন তিনি। আসার কথা সকাল ১১টায়, এলেন দুপুর ৩টার পর। চাতকের মত আগমনী পথের দিকে তাকিয়ে আছে গোটা শহর। এদের মাঝে কিশোর বয়সের আমিও একজন। শেষ পর্যন্ত উনি এলেন। শুধু এলেন বললে হয়ত কম বলা হবে, উনি এলেন বিশ্বজয়ী বীরের মত। এতক্ষণের সুশৃংখল জনতা বাধ ভাঙা জোয়ারের মত ঝাপিয়ে পরল গাড়ি বহরের উপর। কেউ এক নজর দেখার জন্যে, কেউবা একটু ছোঁয়ার জন্যে, যে যেভাবে পারল এগিয়ে গেল ধাবমান গাড়ির দিকে। কোন কিছু বুঝার আগেই নিজকে আবিষ্কার করলাম নেতাকে বহনকারী জীপের পা-দানিতে। ঠিক একহাত দূরে দাঁড়িয়ে আছেন এমন একজন যাঁকে দেখার জন্যে টেকনাফ হতে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত কোটি কোটি মানুষ উন্মুখ হয়ে আছে। সাথে তোফায়েল আহমেদ। নিজকে খুব ভাগ্যবান মনে হল সে মুহূর্তে। আত্মতৃপ্তি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলনা অবশ্য। নেতার দেহরক্ষী মুনসিগঞ্জের মহিউদ্দিনের ফ্লাইয়িং কিকে ছিটকে পরলাম ঝুলে থাকা জিপ হতে। তারপর আর কিছু মনে ছিলনা। উন্মত্ত জনতার ষ্ট্যম্পপিডে দলিথ মথিত হয়ে চিকিৎসার পাশাপাশি কটা দিন কাটাতে হয়েছিল মা-বাবার কঠিন নজরদারিতে।
৭১’এর শুরুটাই বলে দিচ্ছিল দেশে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। রাজনীতির কঠিন মারপ্যাঁচ বুঝার বয়স হয়নি তখনও। তবে এটুকু বুঝতে পারছিলাম পাকিস্তানী তাড়ানোর কঠিন সময় অপেক্ষা করছে সামনে। ২৬শে মার্চ সকাল হতেই আমাদের শহর তলিয়ে গেল ঢাকা হতে পালানো জনতার পদভারে। বাস, ট্রাক, ট্যাক্সি, রিক্সা, নৌকা, এমনকি পায়ে হেটে পলায়মান হাজার হাজার মানুষ প্রথম বিরতি নিল এখানটায়। ২৫শে মার্চের পৈশাচিকতার প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠে সবাই জল্পনা কল্পনা শুরু করে দিল শেখ মুজিবের ভাগ্য নিয়ে। বাতাসে হাজার রকমের খবর তখন, কারও মতে সপরিবারে হত্যা করে হয়েছে তাকে, কেউ বলছেন নেতার সাথে এক গাড়িতে করে পালিয়েছেন, কেউবা বলছেন ঢাকার অনতিদূরে স্বশস্ত্র প্রতিরোধ করতে দেখেছেন নেতাকে। এই নিয়ে গসিপ চললো গোটা এপ্রিল মাস জুড়ে। শেষ পর্যন্ত বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকার খবরে জানা গেল নেতা পাকিস্তানীদের হাতে ধরা দিয়েছেন এবং নিরাপদে আছেন পাকিস্তানের কোথাও।
নেতা ও রাষ্ট্রনায়ক শেখ মুজিবকে নিয়ে গবেষণার অন্ত নেই বাংলাদেশে। রাজনৈতিক মেরুকরণের প্লাটফর্মে দাড়িয়ে এই মানুষটাকে কেউ আখ্যায়িত করেন সহস্রাব্দীর সেরা বাঙালী হিসাবে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে তার একক কৃতিত্ব হিসাবে দেখতে অভ্যস্ত অনেকে, অনেকে আবার নেতাকে বাংলাদেশের অন্যতম ব্যর্থ রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে আখ্যায়িত করে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করতে ভালবাসেন। তাত্ত্বিক তর্কের বাইরে গিয়ে নেতাকে একজন সাধারণ বাংলাদেশির কাঠগড়ায় দাড় করালে বেশ কিছু আনএনসারড্ প্রশ্ন সামনে দাঁড়াবে যেগুলোর উত্তর চাওয়া ক্ষমতার সমসাময়িক সমীকরণে এ মুহূর্তে প্রায় অপরাধ। ছোট হতেই জেনে এসেছি সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কারও সামনে মাথা নত করতে নেই, ব্যক্তি মুজিবের সামনেও মাথা নত রাজি নই, কারণ উনিও ছিলেন রক্ত-মাংসের মানুষ। তাই আমার ব্যাক্তিগত প্রশ্নগুলো তুলে ধরলাম পাঠকদের জন্যেঃ
- নেতা মুজিব আর রাষ্ট্রনায়ক মুজিবকে কোন দাঁড়িপাল্লায় মাপলে সম্মানের এক কাতারে দাড় করানো সম্ভব?
- যে সেনাপতি যুদ্ব শুরুর আগেই শত্রুর কাছে অত্মসমর্পন করেন তাকে কেন যুদ্ধ জয়ের নায়ক বলবো?
- মুজিব পরিবারের কাউকে যুদ্ধের মাঠে দেখা যায়নি, কেউ আহত নিহত হয়নি, অথচ অনেকে বলে থাকেন শেখ মুজিব আমাদের স্বাধীনতা উপহার দিয়েছেন। এমন তত্ত্ব কি শহীদ হওয়া হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অবমাননা নয়? যুদ্ধের নয় মাসে নিহত ৩০ লাখ, ধর্ষিতা ৩ লাখ মা-বোনদের কি তাহলে কোনোই অবদান ছিলনা? একজন শেখ মুজিব ঘোষনা দিলেন আর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেল, ব্যাপারটা কি বাড়াবাড়ি হয়ে যায়না? তাছাড়া ২৬শে মার্চ এই নেতা স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়ে ছিলেন তারই বা প্রমান কোথায়?
- যে নেতাকে এ দেশের মানুষ সম্মানের সর্বোচ্চ আসনে বসিয়েছিল সে নেতাই দেশের চরম ক্রান্তিকালে ঘটা করে সন্তানদের বিয়ে দিয়েছিলেন, ঘটনাটা কি জনবিচ্ছিন্ন একজন ব্যর্থ রাষ্ট্রনায়কের পরিচয় বহন করেনা?
- এত বড় নেতা/রাষ্ট্রনায়ককে ক্ষমতায় টিকে থাকতে কেন মানুষ খুন করার মত চরম নির্মম পথ অবলম্বন করতে হল?
- যে নেতার সংগ্রামে কচুপাতার অবদান পর্যন্ত মানুষ বিশ্বাস করতো, কি এমন ঘটল যার কারণে স্বাধীনতার এক বছরের মধ্যেই দাঁড়িয়ে গেল একাধিক রাজনৈতিক দল, এবং অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করল তাদের? একজন ঐশ্বরিক নেতার ক্রেডিয়েনশিয়ালে এমনটা থাকার কথা ছিলনা।
আমার এ লেখার প্রয়োজন হতোনা যদি না বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার বাংলাদেশকে মুজিবায়নের উলংগ হার্ড লাইনে না যেতেন। বাংলাদেশ মানেই শেখ মুজিব, শেখ মুজিব মানেই বাংলাদেশে, এমন একটা ভুল এবং মিসলিডিং তথ্য দিয়ে আমাদের ইতিহাসকে বিকৃত করার আওয়ামী চেষ্টার প্রতিবাদ জানানোর জন্যেই এ লেখা। ১৯৭১ সাল হাজার বছর আগের সাল নয় যে একে এত তাড়াতাড়ি বিকৃত করা যাবে। ’৭১এর উত্তাল দিনগুলোতে এ দেশের মানুষ জন্মভূমিকে শত্রুমুক্ত করার পবিত্র কাজ শুরু করতে কোন নেতার ঘোষনার দিকে তাকিয়ে থাকেনি, অপেক্ষায় থাকেনি কোন মেজরের বেতার ভাষণের দিকে। একটা জাতির স্বাধীনতার বীজ সুপ্ত হয় তার খেয়ে পড়ে স্বাভাবিক জীবন যাপনের আকাঙ্খা ভেতর। রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবীরা জাতির এ আকাঙ্খা পরিচর্যা করেন মাত্র, বাঁচিয়ে রাখেন প্রয়োজনীয় মুহুর্ত পর্যন্ত। সময় এলে জাতি নিজেই খুঁজে নেয় নিজের পথ, যেমনটা নিয়েছিল এদেশের মানুষ।
শেখ মুজিব ছিলেন এ দেশের অবিসংবাদী জাতীয় নেতা, স্বাধীনতার অন্যতম আর্কিটেক্ট। কিন্তু একমাত্র নন। এ দেশের স্বাধীনতাও কারও একক অথবা পারিবারিক অবদানের ফসল নয়।