'মা, তবারকের হাত অনেক বড়। তোমাদের সবাইকে সে মেরে ফেলবে।' মৃত্যু শয্যায় এটাই ছিল মার সাথে মেয়ের শেষ কথা। ঢাকার পিংকি আত্মহত্যা করলেও কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার পুরুরা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী মরিয়ম আক্তার পিংকিকে (১৫) গায়ে আগুন ধরিয়ে হত্যা করে একই এলাকার তবারক হোসেন (২৫)। সোমবার এ ঘটনা ঘটে তাড়াইলের রাউতি ইউনিয়নের কুনাভাওয়াল গ্রামে। হত্যার কারণ আমাদের অতি পরিচিত, শুরুটা মহল্লার বখাটে যুবক কর্তৃক স্কুলগামী অপ্রাপ্ত বয়স্কা বালিকাকে উত্ত্যক্ত করা দিয়ে। ডালপালা গজিয়ে এই বখাটেপনা একসময় পরিণত হয় একতরফা প্রেম নিবেদনে। সহ্যের শেষ সীমায় পৌছে বালিকা সাহায্য চাইতে বাধ্য হয় পরিবারে কাছে, সমাজের কাছে। শুরু হয় ঘটনার চরম অধ্যায়। একদিকে মান-সন্মান বাঁচানোর আকুল চেষ্টা, পাশাপাশি সামাজিক অবক্ষয়ের রক্তচক্ষু। এই অসম লড়াইয়ে কার জয় হয় তা আমাদের সবার জানা। আত্মহত্যা অথবা হত্যার মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটে একতরফা প্রেমের। এটাকে যদি আমাদের সমাজপতিরা সমস্যা হিসাবে স্বীকৃতি দেন তা হলে এ সমস্যা শুধু ঢাকার অথবা কিশোরগঞ্জের কিশোরী পিংকিদের নয়, এ সমস্যা বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায়, উপজেলায়, থানায়, পাড়ায়, মহল্লায়, এমনকি প্রতিটি পরিবারে। পিংকিদের মত তরুনীদের জীবন শুরু হওয়ার আগেই উদয় হয় তবারকদের, এবং ঘন্টা বাজাতে শুরু করে নতুন ট্রাজেডির।
আসুন খুব কাছ হতে দেখি কি ঘটেছিল কিশোরগঞ্জের পিংকির সাথে। তাড়াইল থানা পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, পিংকিকে স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে উত্ত্যক্ত করত ঝাড়ু মিয়ার ছেলে তবারক। একপর্যায়ে সে প্রেমের প্রস্তাব দিলে পিংকি তা প্রত্যাখ্যান করে। বিষয়টি পিংকি তার বাবা-মাকে জানায়। এতে তবারক ক্ষুব্ধ হয়। ঘটনার আগের দিন সন্ধ্যায় সে পিংকিদের বাড়িতে গিয়ে তাকে গালাগাল করে। পরদিন সকালে তবারক আবারও পিংকিদের বাড়ি যায়। মা লতিফা আক্তার পাশের বাড়িতে গিয়েছিলেন। প্রতিবেশীরা জানায়, তবারক পিংকিকে ঘরে একা পেয়ে ধমকাতে শুরু করে। একপর্যায়ে সে কুপি থেকে পিংকির মাথায় কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায়। প্রাণ বাঁচাতে পিংকি বাড়ির পাশের পুকুরে ঝাঁপ দেয়। আশপাশের লোকজন মারাত্মক দগ্ধ অবস্থায় তাকে পুকুর থেকে তুলে প্রথমে তাড়াইল হাসপাতালে পাঠায়। সেখান থেকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এবং এই হাসপাতালেই নিভে যায় পিংকির শেষ প্রদীপ।
যতদূর জানি আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বিরোধী দলীয় নেত্রীর পদ মহিলাদের দখলে। বিশ্বের দ্বিতীয় কোন দেশে ক্ষমতার মসনদে মহিলাদের এমন একচাটিয়া প্রধান্য আছে কিনা জানা নেই, অথচ এতগুলো শক্তিশালী মহিলার নাকের ডগায় প্রতিদিন ঘটছে কিশোরী পিংকিদের এই করুণ পরিনতি। এ নিয়ে রাষ্ট্রের কোন পর্যায়েই উচ্চবাচ্য নেই, নেই সামান্যতম সহমর্মিতা। মেগা মাপের বড় বড় বিচারের ফাকে আমরা কি আশা করতে পারি এই তবারকদের বিশেষ বিচারের মাধ্যমে যথাসম্ভব দ্রুত আজরাইলের তবারক বানানো হবে?
আসুন, আরও একবার শোনার চেষ্টা করি মৃত্যু পথাযাত্রী পিংকির শেষ কথা; 'মা, তবারকের হাত অনেক বড়। সে তোমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে"। আমাদের সমাজে কাদের হাত এত লম্বা এবং কেন এত লম্বা হয় তা কমবেশী সবার জানা আছে। পিংকিদের স্বাভাবিক জন্ম-মৃত্যর দায়িত্বে নিয়োজিত নেতা-নেত্রী, মন্ত্রী-এম্পিদের লড়াই ফ্রন্টের তৃতীয় লাইনের সৈনিক এরা। এদের হাত ধরেই এক কাপ চা আর একটা আকিজ বিড়ি মার্কা নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে উনারা এম্পি, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী হয়ে থাকেন। তবারক নিজেও জানতো তাকে কেউ বেশীদিন আটকে রাখতে পারবেনা, কারণ তার হাত অনেক লম্বা।
পাঠক, আপনার নিজ ঘরে পিংকিদের বয়সের কেউ কি নীরবে নিভৃতে বেড়ে উঠছে? দেরী না করে এখনই তার সাথে কথা বলুন, খোজ নিতে শুরু করুন। দেরী হওয়ায়র আগেই চিনে নিন তবারকদের, গুড়িয়ে দিন তাদের লম্বা হাত।