এভাবেই শেষ হয়েছিল জনপ্রিয় টিভি সিরিজ ’বহুব্রীহি’, মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের তালিকা তৈরী করার লক্ষ্যে গরুর গাড়ি চড়ে বেরিয়ে পরলেন নাটকের অন্যতম চরিত্র আবুল হায়াত। আবুল হায়াত কি শেষ পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছিলেন তার অভীষ্ট লক্ষ্যে? এ প্রশ্নের উত্তর নিয়ে তৈরী করা যেতে পারে বিশাল ক্যানভাসের নতুন এক সিরিয়াল, যেখানে থাকতে পারে দুঃখ, কষ্ট, আবেগ, ভালবাসা, জন্ম-মৃত্যু আর চাওয়া পাওয়ার জটিলতায় ভরা সমসাময়িক বাংলাদেশের বাস্তব প্রতিফলন। ’বহুব্রীহি’ যে প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে ১৯৮৮ সালে মাঠে বেরিয়ে পরেছিল, আজ পর্যন্ত কোন সরকারই এ খোঁজে কেন শামিল হয়নি তা রহস্য হিসাবেই থেকে যাবে যুগ যুগ ধরে। কাজটা কি খুবই জটিল? বাংলাদেশের আয়তন মাত্র ৫৪ হাজার বর্গমাইল, গ্রামের সংখ্যা বলা হয় ৬৫ হাজার। পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতি দেশ হিসাবে এখানে যোগাযোগেরও নেই তেমন কোন সমস্যা। তা হলে আটকে থাকছে কেন এমন একটা প্রয়োজনীয় উদ্যোগ? যে দেশে খুনাখুনির মাধ্যমে সরকার হটিয়ে সঠিক ভোটার তালিকা তৈরী করা গেছে, সেখানে মুক্তিযুদ্ধে নিহত ৩০ লাখ শহীদের তালিকা তৈরিতে জটিলতা কোথায় তার কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সরকারের হাতে আছে কি-না তা সরকারই ভাল বলতে পারবেন। বিগত জোট সরকার না হয় ’৭১ এর গণহত্যার আসামি জামাতিদের দোসর ছিল, আওয়ামীরা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি হয়ে কেন একই পথে মা মাড়াচ্ছে তা কিছুটা হলেও সন্দেহের সৃষ্টি করবে।
সঠিক ইতিহাস লেখার মিশন নিয়ে এ সরকার পাঠ্যবইয়ে আনছে আমুল পরিবর্তন, অবকাঠামো হতে অনেকটা গায়ের জোরে মুছে দিচ্ছে নিজেদের অপছন্দের নাম, রাজাকারের তালিকা তৈরীর আহ্বান জানাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। সব ঠিক আছে, কিন্তু এ তালিকায় ৩০ লাখ শহীদের নাম অন্তর্ভুক্ত করার কোনোই কি দায়-দায়িত্ব নেই আমাদের? না-কি দায়িত্ব এড়ানোর মধ্য দিয়ে কিছু একটা লুকাতে চাইছে মুক্তিযুদ্ধের একক দাবিদার এ সরকার? আসুন ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করি সে দিকটায়।
আসলেই কি ৩০ লাখ শহীদ হয়েছিল ৭১ সালে? তাই যদি হয় তা হলে এর ভিত্তি কি? সংখ্যা নিশ্চিত করতে সরকারী অথবা বেসরকারিভাবে কোন উদ্যোগ গ্রহন করা হয়ছিল তারও কোন রেকর্ড নেই। তাত্ত্বিকভাবে সংখ্যাটা সম্ভব হলেও বাস্তবে কতটা সম্ভব তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। ক্যালেন্ডারিয় হিসাবে ’৭১ সালে পাকিস্তানীদের সাথে আমাদের যুদ্ধের ব্যাপ্তি ছিল ২৬৭ দিন, অর্থাৎ ৩,৮৪,৪৮০ মিনিট। ৩০ লাখ শহীদের হিসাবে ঐ সময়টায় মিনিটে প্রায় ৮ জন প্রাণ দিয়েছিল বাংলাদেশে। অন্যদিকে ৬৫ হাজার গ্রামের হিসাবে প্রতি গ্রামে প্রায় ৪৬ জন প্রাণ হারানোর কথা। পাঠক, এবার আপনি আপনার নিজ গ্রামে ফিরে গিয়ে তালিকা করুন ৪৬ জনের। ৫৪ হাজার বর্গমাইলের দেশে ৩০ লাখ শহীদকে দাফন করতে কতটা জায়গার প্রয়োজন সে হিসাবে আমাদের প্রতি পদক্ষেপে কবর থাকার কথা। আর তা যদি না পাওয়া যায় তাহলে অস্তিত্ব থাকার কথা শত শত গণকবরের। কোথায় সে সব কবর? ৩০ লাখ সংখ্যাটা প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে আরও একটা সমীকরণ মেলাতে হবে। নব্বই হাজার সেনা নিয়ে পাকিস্তানিরা যুদ্ধ করতে এসেছিল এ দেশে। এদের প্রত্যেকে গড়ে ৩৩ জন করে হত্যা করে থাকলে সংখ্যাটা ৩০ লাখে মেলানো সম্ভব। বাস্তবে যদি এমনটা হয়ে থাকে তা হলে প্রশ্ন জাগবে কোন অধিকারে শেখ মুজিব এসব কসাইদের বিনা বিচারে পাকিস্তান ফেরৎ পাঠিয়েছিলেন।
১ জন বাংলাদেশীকেও হত্যা করার আইনগত ও নৈতিক অধিকার রাখেনি পাকি সিফিলিসের দল। বাস্তবতা হল, তারা হত্যা করেছে, এবং তা করেছে পৈশাচিক উন্মত্ততায়। কিন্তু এ সংখ্যা ৩০ লাখ বিশ্বের কোন পরিসংখ্যানই এর স্বীকৃতি দেয়না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জাতি হিসাবে এ মুহূর্তে আমাদের একমাত্র গর্বের অধ্যায়। এ অধ্যায়ের শুরুটা আবেগ অথবা মিথ্যার উপর দাঁড় করালে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আমাদের দায়ি থাকতে হবে (কারণ সত্য একদিন প্রতিষ্ঠিত হবেই)। রাজাকার অথবা পাকিদের দোসর আখ্যায়িত করে আমার এ লেখাকে হয়ত উড়িয়ে দেয়া যাবে, কিন্তু তাতে ৩০ লাখের সমীকরণ মেলানো সম্ভব হবে বলে মনে হয়না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রতি নিবেদিত ব্লগারদের অনুরোধ করব যুদ্ধাপরাধী বিচারপর্ব শেষে শহীদ্দের তালিকা প্রণয়নের কাজে এগিয়ে আসার জন্যে। প্রজন্ম এখনো বেচে আছে যারা স্বাক্ষী হতে পারবে আমাদের ইতিহাসের। আসুন ফাকা বুলি না ঝেড়ে কাজে লাগাই সে সূযোগ।