প্রায় ৩ বছর পর দেশে গিয়ে একটা পরিবর্তন দেখতে পেয়ে বেশ আনন্দিত হয়েছিলাম। কাজের বুয়াদের হাতে হাতে মোবাইল। জরিনা নামের এক বুয়া কতদিন ধরে আমাদের বাসায় কাজ করছে তার হিসাব কসতে গেলে সাত খন্ড রামায়ণ ঘাটতে হবে। এক কথায়, ছোট হতে বড় হয়েছে এখানে। বিভিন্ন গ্যাঁড়াকলে আটকে ৩২ বছর বয়সে গোটা চারেক বিয়ে করে ফেলেছে ইতিমধ্যে। ক’বছর আগের জরিনা এবং বর্তমানের জরিনা পরিবর্তন চোখে পরার মত। কড়া ঠোট পালিশ, কদুর তেলে বিন্যস্ত চুল আর হাতে গ্রামীনের মোবাইল। সপ্তাহে একদিন ছুটি এবং সন্ধ্যার পর টিভি দেখার স্বাধীনতা, জারিনার আলটিমেটাম, এগুলো না হলে কাজ করবেনা। কাজের ফাঁকে ফাঁকে মোবাইল রিসিভ করতে হয় তাকে। জিজ্ঞেস করতে মুখের উপর ধপাস করে বলে দিল, ’সাড়া জনম মাইনসের বাড়ির বান্দী খাইট্যা মরমু নাকি?।’ খবর নিয়ে জানা গেল পাশের বাড়ির ড্রাইভারের সাথে তার ভাব, এবং প্লান করছে পঞ্চম বিয়ের। এক জরিনার মাঝেই শুধু এ পরিবর্তন নয়, পরিবর্তনের ছোঁয়া এখন বাংলাদেশের ঘরে ঘরে।
জরিনা প্রসঙ্গটা টানলাম আজকের কোন এক দৈনিকে একটা আজব খবর পড়ে। খবর কোটিপতি কাজের বুয়া আলেয়াকে নিয়ে। পলিটিক্যাল ক্রাইম নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে হরেক রকম কোটিপতির চাঞ্চল্যকর উত্থানের সাথে পরিচিত হয়েছি। কিন্তু কোটিপতি কাজের বুয়া! পত্রিকায় না পড়লে ইহজনমে বিশ্বাস করতাম না। খবরের সারাংশটা এ রকমঃ
গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া কোটিপতি ‘কাজের বুয়া’ আলেয়া (৪০) নামেই পরিচিত আন্ডারওয়ার্ল্ড অপরাধ জগতে। তবে তার আরেকটি নাম হচ্ছে নুরজাহান। গৃহপরিচারিকা হিসেবে রাজধানীর বিভিন্ন বাসায় কাজ নিয়ে লুটপাট করাই ছিল তার প্রধান পেশা। সুযোগ বুঝে দুর্ধর্ষ এই প্রতারক বাসার বাসিন্দাদের ঘুম পাড়িয়ে নিয়ে গেছে স্বর্ণালঙ্কারসহ মূল্যবান জিনিসপত্র। প্রায় ২০ বছর ধরেই চলছে আলেয়ার এ বাণিজ্য। রোববার ঢাকা ও অন্যান্য জেলায় অভিযান চালিয়ে দুজন নারীসহ এ সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের ৬ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। আলেয়া ছাড়া অন্য গ্রেপ্তারকৃতরা হচ্ছে আলেয়ার ভগ্নিপতি বাদশা (৪২) ও তার স্ত্রী, রুজিনা বেগম, রাজধানীর তাঁতীবাজারের আদি কার্তিক জুয়েলার্সের মালিক কার্তিক রায় পোদ্দারের ছেলে কাঞ্চন আকন্দ, শ্যামলাল সরকার ও বিমল ঘোষ। আলেয়ার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী গেণ্ডারিয়ার রজনী চৌধুরী রোডের ৯২/২ বাসায় অভিযান চালিয়ে একটি বিদেশী রিভলবার, দুই রাউন্ড গুলি, এটিভেন নামে সাড়ে ৫০০ নেশাজাতীয় ট্যাবলেট, একটি মোবাইল সেট ও ৫০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।
আলেয়া সর্বশেষ গত ১০ ফেব্র“য়ারি আমেনা বেগম নামে কাজের বুয়া পরিচয় দিয়ে সাবেক আইজিপি এ আর খন্দকারের বনানীর বাসায় কাজ নেয়। একই মাসের ১২ তারিখ কোনো এক সময় এটিভেন নামে ঘুমের বড়ি চায়ের সঙ্গে মিশিয়ে ওই বাসার সবাইকে খাইয়ে দেয়। পরে একে একে সবাই অজ্ঞান হয়ে পড়লে সুযোগ বুঝে ওই বাসা থেকে ৩০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার, নগদ দেড় লাখ টাকা, সাড়ে ১১ লাখ টাকার মূল্যবান মালামাল ও একটি মোবাইল সেট নিয়ে পালিয়ে যায়।
আমাদের অর্থনীতির চাকাকে যদি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও দুর্নীতির করালগ্রাস হতে মুক্ত করা যেত, হয়ত পোশাক শিল্পের মত আরও অনেক খাত খুলে দিত সম্ভাবনার অফুরন্ত দুয়ার। এমন সম্ভাবনার অন্যতম বেনিফিশিয়ারিস হতে পারত দেশের কর্মক্ষম যুব সমাজ। এ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করা সম্ভব হত বাসা বাড়ির চিরস্থায়ী দাসত্বে নিয়োজিত লাখ লাখ অপ্রাপ্ত বয়স্ক তরুণ তরুণী (পশ্চিমাদের মাথাব্যথা উপেক্ষা করেই)। এসব সম্ভাবনা বাস্তবায়ন সম্ভব হলে কাজের বুয়া সংকট হয়ে দাঁড়াবে উচ্চ ও উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের অন্যতম প্রধান সমস্যা (যা ইতিমধ্যে হয়ে গেছে হয়ত)। এ সাংস্কৃতি যতদিন না বদলাবে আলেয়া বেগম চক্র এর সুযোগ নিতে থাকবে প্রায় বিনা বাধায়। কারণ চারদিকে কাজের বুয়া হাহাকার।
খবরটা না দিয়ে লেখাটা শেষ করা ঠিক হবেনা। আমাদের মোবাইল বুয়া শেষ পর্যন্ত পঞ্চম বিয়ের সন্ধান পেয়েছিল, যার চরম মূল্য দিতে হয়েছিল আমাদের গোটা পরিবারকে। কোন এক সুন্দর সকালে আবিষ্কৃত হোল আমাদের মোবাইল বুয়া তার নাগরের হাত ধরে উধাও হয়ে গেছে। সাথে উধাও গোটা কয়েক দামি মোবাইল, কিছু নগদ অর্থ, সোনাদানা আর পুরানো কিছু তৈজসপত্র (নতুন সংসারে ব্যবহারের জন্যে)।
সূত্রঃ http://www.bhorerkagoj.net/content/2010/05/11/news0497.php