পুরানো জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে চোখে পরল SSC পরীক্ষার মার্কসিটটা। অনেকদিন আগের হলেও মনে আছে ঘটনাটা। পত্রিকায় দেখলাম SSC পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে আজ। সবার জীবনেই আসে এ দিনটা। আমারও এসেছিল। শেয়ার করে আশাকরি ভুল করছি না।
মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টের আশায় বসে আছি অনেকদিন। ঘুরা ফেরা যা করার তাও সেরে ফেলেছি ইতিমধ্যে। দিন যতই ঘনিয়ে আসতে লাগল ভেতরের উত্তেজনাও বাড়তে লাগল। খাওয়া দাওয়া ঘুম সহ দৈনন্দিন রুটিন বিপর্যস্ত হয়ে গেল অজানা আশঙ্কায়। পরীক্ষা আশাতীত ভাল দিয়েছি, তারপরও কেন এই উত্তেজনা বাসার কাউকে বুঝানো গেলনা। এরই মধ্যে স্কুলের এক শিক্ষক গোপনে জানিয়ে গেলেন আমাদের স্কুল হতে একজন মাত্র ষ্টার মার্ক পেয়েছে এবং তা আমি নই। ষ্টার মার্ক না পেলে বাড়ির কেউ তেমন আশাহত হবে ব্যাপারটা এমন ছিলনা। কিন্তু আমার জন্যে সমস্যাটা ছিল অন্য জায়গায়। পরীক্ষা শুরুর দুমাস আগের ঘটনা। আমাদের বাড়িতে নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। পরিবারে ৪ কন্যা ও দুই পুত্র। কন্যাদের একজন আমার মতই পরীক্ষার্থী। পরিবারের তীব্র নিয়ন্ত্রণ আর পাড়া প্রতিবেশীর চোখ ফাঁকি দিয়ে কখন যে পরীক্ষার প্রস্তুতি ফেলে ভালবাসার ধারাপাত পড়তে শুরু করে দিয়েছি খেয়াল ছিলনা। এ ক্ষেত্রে যা হবার তাই হল, কিছুদিন না যেতেই এ কান ও কান হয়ে মা-বাবার কান পর্যন্ত পৌছে গেল পুত্রের লায়েক হওয়ার খবর । ভালবাসার কাঠগড়ায় আমাকে নয়, দাড় করানো হল আমার পরীক্ষাকে। আমার জন্যে এ শুধু পরীক্ষায় পাশ করার প্রশ্ন ছিলনা, প্রশ্ন ছিল মজনু হিসাবে To Be Or Not To Be'র পরীক্ষা।
রেজাল্টের দিন স্কুলে গিয়ে জানতে পারলাম ফল এখনো পৌঁছায়নি। পত্রিকায়ও কোন কিছু খুঁজে পেলাম না। হেড স্যার জানালেন আমাদের রেজাল্ট ঢাকার ওয়েষ্ট এন্ড হাইস্কুলের নোটিশ বোর্ডে ঝুলানো আছে। জরুরী মনে করলে ঢাকায় যেতে হবে। মাথায় আকাশ ভেংগে পরল। একা একা ঢাকা যাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই, আজিমপুর কোথা এবং সেখানে কিভাবে যেতে হয় তা জানার প্রশ্নই ছিলনা। আমার জন্যে এ শুধু পরীক্ষার রেজাল্ট জানার প্রশ্ন ছিলনা, প্রশ্ন ছিল লাইলীর পরীক্ষায় মজনুর উত্তীর্ণ হওয়ার প্রশ্ন। সাত পাচ না ভেবে সঞ্চয় বলতে যা ছিল সাথে নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেলাম শহরের দিকে।
বাস বলতে একমাত্র বিআরটিসি বাসই চলাচল করত আমাদের লাইনে। চেপে বসলাম তেমনি একটা লক্কর ঝক্কর বাসে। ভেতরে ঢুকে সীট নিতে যাব এমন সময় ড্রাইভার লম্বা সালাম দিয়ে জানতে চাইল নিজেদের গাড়ির ফেলে বাসে কেন চড়ছি। আমাদের পুরাণা ড্রাইভার, তাই অনেকটা ধমকের সুরেই জানিয়ে দিলাম NONE OF YOUR BUSINESS. জোর করেও ভাড়া দিতে পারলাম না, কন্ডাকটর জানালো ওস্তাদের কড়া নিষেধ আছে ভাড়ার ব্যাপারে। মনে মনে খুশি হলাম কিছু পয়সা বেচে যাওয়ায়, অচেনা শহরে যাচ্ছি দরকার হতে পারে। কিছুদূর যেতেই আকাশের দিকে তাকিয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল, ঈশান কোণে মেঘ জমছে দৈত্যের চেহারায়। সপ্তাহ দুয়েক আগে এ অঞ্চল দিয়ে ভয়াবহ টর্নেডো বয়ে গেছে, ঘরবাড়ি আর জানমালের ক্ষয়ক্ষতি এখনো কাটিয়ে উঠা যায়নি। বাসায় কাউকে বলে আসিনি, নিজকে ভীষন অপরাধী মনে হল।
বাস তারাবো ফেরিঘাটে থামতেই শুরু হল দমকা বাতাস। আগুনের লেলিহান শিখার মত আকাশ হতে নেমে এল শত শত রাক্ষসে দল, সাথে ডিনামাইট ফাটানোর প্রলয়ংকরী শব্দ। মধ্য নদীতে আমি, ঘূর্ণায়মান বাতাস এসে ৩৬০ ডিগ্রী এংগেলে ঘুরিয়ে দিল আমাদের ফেরী। বেশ ক’জন ছিটকে পরল নদীতে, উন্মত্ত স্রোত গ্রাস করে নিল নিমিষেই। বাচা মরার চরম ক্ষণে আমার মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল, রেজাল্ট! ৫ টনি ট্রাকের ডান্ডায় ঝুলে শরীরের সবটুকু শক্তি ব্যায় করে টিকে রইলাম কোন মতে। ডেমরা ঘাটে ভিড়তেই শুরু হল মাতম, বেশ কজনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মাথার উপর ছাদ না থাকায় ভিজে ততক্ষণে টাকি মাছ বনে গেছি। কান্নাকাটি খুব একটা আমলে না নিয়ে দ্বিতীয় একটা বাসে চেপে বসলাম। ঝড়ের তীব্রতা কমে এলেও বৃষ্টির তীব্রতা বাড়তে থাকল সমান গতিতে।
ভিজে যাওয়া কাগজের টুকরা হতে আজিমপুরের ঠিকানাটা উদ্ধার করতে কষ্ট হল। কিন্তু আজিমপুরস্থ ওয়েষ্ট এন্ড হাইস্কুল চেনে এমন রিক্সাওয়ালা পেতে বিশেষ অসুবিধা হল না। গুলিস্তান হতে আজিমপুর, অনন্তকালের যাত্রার মত ছিল সে যাত্রা। রিকশা চলছে তো চলছেই। ছোট খাট প্লাস্টিকের ঢাকনা দিয়ে বৃষ্টিকে বেশিক্ষণ আটকে রাখা গেলনা। নতুন করে ভিজতে লাগলাম দাঁড়কাকের মত। স্কুলে পৌঁছে নোটিশ বোর্ড বের করতে বেশ কিছু সময় ব্যায় হয়ে গেল।
শেষ পর্যন্ত দেখা মিলল রেজাল্ট বাবাজির। ৫ সাবজেক্টে লেটার সহ ষ্টার মার্ক নিয়ে ভাল ভাবেই পাশ করেছি। আনন্দ শেয়ার করার মত আশপাশে কেউ ছিলনা, না ছিল ফোন করার সুযোগ। রেজাল্টের প্রাথমিক ধাক্কা সামলানোর পর খেয়াল হল শরীর কাঁপছে আমার। জ্বর আসছে বুঝতে অসুবিধা হল না। উলটো পথে কেমন করে বাসায় ফিরেছিলাম তা চাইলে আজও মনে করতে পারিনা। শুধু মনে আছে মা হুজুর ডেকে দোয়ার আয়োজন করেছিলেন। বাস ড্রাইভারের কারণে বাসার সবাই জেনে গিয়েছিল আমার গন্তব্যস্থল। কিন্তু ঝড় তুফানের খবরে সবাই ছিল উদ্বিগ্ন। একা একা এতদূর আগে কোথাও যাইনি বলে মা ছিলেন বিশেষ ভাবে চিন্তিত।
পাক্কা এক মাস বহুমুখী অসুখ কাটিয়ে ’লাইলি’র সাথে দেখা করব বলে তাদের বাসার সামনে যেতেই দেখি লম্বা একটা সাইনবোর্ড ঝুলছে, ‘বাসা ভাড়া হইবে, ছোট পরিবার অগ্রাধিকারযোগ্য’। নোটিশটা আমার নিজের হাতে লেখা, শুধু দ্বিতীয় বাক্যটা যোগ করা হয়েছে।