নষ্ট রাজনীতির বিষ্ঠা ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম এ সবের বাইরেও আমাদের একটা জীবন আছে। ১৫ কোটি মানুষের জীবন কেবল রাজনীতির রংগিন চশমায় দেখলে হয়ত অসম্পূর্ণই থেকে যাবে সে দেখা। বাংলাদেশের মানুষের পরিচয় কেবল সংসদের চার দেয়ালকে ঘিরে বেড়ে উঠা কিছু ভণ্ড লোকের গুণ্ডামির মধ্যে সীমিত রাখলে নিশ্চয় অন্যায় করা হবে তাদের প্রতি, যারা প্রকৃতি আর মনুষ্য সৃষ্টি নষ্টামোর বিরুদ্ধে লড়াই করে বেচে থাকছে নিরন্তর।
৭০ দশকের শেষ দিকের কথা। পোলান্ডের পজনান শহর হতে ট্রেনে চেপে হল্যান্ড যাচ্ছি লন্ডনের উদ্দেশ্যে। প্রচন্ড ভিড়ের কারণে ভেতরে সীট পাওয়া গেলনা। হাতের ব্যাগটা বিছিয়ে তাতেই বসে পড়তে বাধ্য হলাম করিডোরের এক কোনায়। শুধু আমি নই, এভাবে অনেকেই আমার মত জার্নি করতে বাধ্য হচ্ছে। জানালা দিয়ে ইউরোপের প্যানোরামা দেখতে দেখতে তন্দ্রাভাব আসছিল। ’তোমার সাথে কি কথা বলা যাবে?’ - প্রশ্নটা ছিল আমার এক সহযাত্রীর। আমার মত তাকেও একাকিত্বে ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। এভাবেই শুরু। পূর্ব বার্লিন পৌঁছা পর্যন্ত আমরা একটানা কথা বলে গেলাম। নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা হল যাতে সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের প্রসঙ্গও চলে এলো স্বাভাবিকভাবে। পোলিশ সেনা অফিসার, সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার অংশ হিসাবে যাচ্ছে পূর্ব বার্লিন। ভারত উপমহাদেশের সমস্যার পাহাড় ধরে টান দিতেই সে আমাকে থামিয়ে দিল। তার মতে, আমরা যত সমস্যার কথাই বলিনা কেন, এর বাইরেও এ অঞ্চলে নিশ্চয় একটা জীবন আছে যা আমরা দেখেও না দেখার ভান করি। বয়স কম থাকায় ফিলসফিক্যাল কথা নিয়ে মাথা ঘামাতে উৎসাহ বোধ করিনি। কিন্তু এতগুলো বছর পর এ নিয়ে ভাবতে গেলে সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে যা্য, দ্বিধায় পরে যাই বিশ্বাস অবিশ্বাস নিয়ে। নষ্ট রাজনীতি নিয়ে মাতামাতিতেও কেমন যেন ভাটা চলে আসে। আসলেই কি আমাদের সমাজে এমন একটা অদেখা জীবনের অস্তিত্ব আছে যাকে ঘিরে বেড়ে উঠছে সংসার, জন্ম নিচ্ছে সন্তানাদি, নিত্য পরিশ্রম করছে কোটি কোটি মানুষ? আজকের একটা খবর পড়ে অতীতের ভাবনাগুলোই যেন নতুন করেই ধাক্কা দিয়ে গেল।
চাঞ্চল্যকর তেমন কিছু নেই খবরটায়। তবে এমন কিছু উপাদান আছে যার সন্ধানে প্রতিদিন হাজার হাজার মাইল দূর হতেও কাগজের পাতা উলটাই। দরিদ্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে জীবন যুদ্ধে জয়ী এক কিশোরীকে নিয়ে এ কাহিনি। খবরটা প্রকাশিত হয়েছে আজকের দৈনিক প্রথম আলোতে। ‘পড়াশোনায় ভালো ছিল সে। কিন্তু বাদ সাধল দারিদ্র্য। ভ্যানচালক বাবা আবদুল লতিফ আর ধানের চাতালের শ্রমিক মা রেনু বেগম খরচের বোঝা বইতে পারলেন না। অষ্টম শ্রেণীতে থাকতেই মেয়েকে বিয়ে দিলেন তাঁরা। সেখানে যৌতুকের দাবিতে শুরু হলো স্বামীর নির্যাতন। শেষে তালাকের মাধ্যমে মুক্তি। বাবার বাড়ি ফিরে আবার পড়াশোনাকেই আঁকড়ে ধরল সে। শিক্ষকেরা সাগ্রহে মেধাবী ছাত্রীটিকে নবম শ্রেণীতে ভর্তি করে নিলেন। শিক্ষকদের সেই আদর-ভালোবাসার যথার্থ প্রতিদান সে দিল এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে।’।
এই রোজিনা চরিত্র দিয়ে গোটা বাংলাদেশের একটা বাস্তব চিত্র আঁকলে নিশ্চয় অন্যায় কিছু হবেনা। একদিকে দারিদ্র, পাশাপাশি বেচে থাকার অদম্য লড়াই এবং সাথে সামজিক মূল্যবোধ গুলোর অবক্ষয়। খেজুর পাতার ঘরে ৫ জনের সংসারে বড় হয়ে উঠা রোজিনাকে তার মা-বাবা অল্প বয়সে বিয়ে দিতে বাধ্য হন ক্ষুধার কারণে। সংসারের আয় গড়ে দৈনিক ১২০টাকা। এ আয় হতেই মেয়ের বিয়েতে যৌতুক দিতে বাধ্য হন ২০ হাজার টাকা। যৌতুকখোর স্বামীর ক্ষুধা মেটাতে ব্যর্থ হওয়ায় শুরু হয় রোজিনার উপর শারিরীক অত্যাচার। তালাকের মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে কিশোরীর বিয়ে পর্ব। বিয়ের আগে মেধাবী ছাত্রী হিসাবে স্কুলে ভালই পরিচিতি ছিল তার। নিজ বাড়িতে ফিরে আবারও লেখাপড়ায় মন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় দরিদ্র পরিবারের এই মেধাবী ছাত্রী। স্থানীয় বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিশেষ পরিচর্যায় শেষ পর্যন্ত এস এসসি পরীক্ষায় উত্কীর্ণ হয় জিপিএ-৫ নিয়ে। স্কুলের ইতিহাসে এই প্রথম এত বড় জল, স্বভাবতই আনন্দের বন্যা সবখানে।
রাজনীতির দাসীবৃত্তিতে আটক একটা ক্ষয়িষ্ণু সমাজে নষ্টামীর বিরুদ্ধে লড়াই করে বেচে থাকার এ এক অনন্য উদাহরণ। এ নিয়ে লেখা যেতে পারে বিশাল ক্যানভাসের কোন উপন্যাস, তৈরী হতে পারে অস্কার জয়ী ছায়াছবি। রোজিনা আর তার স্কুলের শিক্ষকদের মত মানুষরা আছে বলেই বাংলাদেশ এখনো দেশ হিসাবে আছে, ব্যক্তি অথবা পরিবারিক তাঁবেদার হয়ে নয়। রোজিনার ভাগ্য এখান হতে কোন দিকে গড়াবে তার খবর হয়ত কেউ রাখবে না। ক্ষতি কি? রোজিনা দেশের লাখ লাখ দরিদ্র পরিবারের নির্যাতিত কিশোরীদের জন্যে প্রেরণা হয়ে বেচে থাকুক, এমনটাই কামনা করি।