প্রকৃতিতে এখন পরিবর্তনের পালা। ফুলে ফলে প্রস্ফুটিত হয়ে গেছে চারদিক। সাথে বসন্তের মৃদুমন্দ সমীরণ সবকিছুতে এনে দিয়েছে কাব্যিক পরিবর্তন। শহরের প্রান্তসীমায় রাজত্ব করা সান্দিয়া পাহাড়ের চুড়গুলো হতে অমল ধবল বরফ মালাও বিদায় নিয়েছে নীরবে নিঃশব্দে। এক কথায়, শীতের খোলস হতে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে বসুন্ধরা। আমেরিকার বন্য পশ্চিমে এ পরিবর্তন শুধু মনে নয়, শরীর মন দুটোই ছুঁয়ে যায় ভোঁতা হিংস্রতায়। গোটা এপ্রিল মাস ছিল আনপ্রেডিক্টেবল। সকালে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা তো দুপুরে তীব্র গরম, বিকেল নামতেই আবার শুরু হয় প্রচন্ড ধূলি ঝড়। বাতাসের প্রচণ্ডতা এখানে এতটাই হিংস্র হাইওয়ে ধরে গাড়ি চালালে মনে হবে উড়ছে আমার গাড়ি। মে মাসের শুরুটাও ছিল একই রকম। গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে বিজ্ঞজনেরা বহুমুখী তত্ত্ব ঝারলেও এসব নিয়ে নির্বিকার শহরের মুল বাসিন্দা রেড ইন্ডিয়ানরা। প্রকৃতি ও মনুষ্য সৃস্টি হিংস্রতার সাথে লড়াই করেই বেড়ে উঠে তাদের জীবন, যার ছোয়া পাওয়া যায় তাদের সবকিছুতে; চেহারায়, কথায়, কাজে ও চলাফেরায়। এপাচি, সান ফেলিপে, জিয়া, সান্দিয়া, এসব পুয়েবলোগুলোতে গেলে হঠাৎ করেই মনে হবে মধ্য আমেরিকার কোথাও আছি আমরা। দারিদ্র্য, অবহেলা আর অযত্নে বেড়ে উঠা রেড ইন্ডিয়ানদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে মূলধারার আমেরিকানদের তুলনা করলে কষ্ট লাগবে, দুঃখ লাগবে এদের জন্যে। কারণ দেশটা তাদের, এরাই আমেরিকার আসল মালিক।
আমার এ লেখাটা আমেরিকার আসল মালিকদের নিয়ে নয়, আমার মত নকল মালিক, ইমিগ্রেন্টদের নিয়ে। সাদা চামড়ার ইমিগ্রেন্ট।
জুন মাস সামনে। কর্পোরেট দুনিয়ায় জুন মাসের গুরুত্ব অপরিসীম। কোয়ার্টার ও হাফ-ইয়ারলী প্রফিট & লসের হিসাব কষার মাস এটা। এ নিয়ে অফিসে এখন মহামারির মত ব্যস্ততা। বসের অনুরোধে শনিবারও কাজে আসতে হল আমার। মার অসুখের কারণে গৃহিণী একদিনের নোটিশে তার নিজ দেশে চলে গেছে। বেশ কটা মাস বেকার থাকায় আমার পকেটের অবস্থাও বেশ নড়বড়ে। তাই বিনা তর্কে রাজি হয়ে গেলাম শনিবার টা অফিসে কাটাতে। সুবিশাল দালানের পাঁচতলার সবটা জুড়ে আমাদের অফিস। একদল প্রকৌশলী এখানে দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে যন্ত্রের মত। হাল্কা পায়ের আওয়াজ ছাড়া বিশেষ কোন শব্দ হয়না এখানটায়। শনিবারের ব্যাপারটা অবশ্য অন্যরকম। দু’একজন যারা কাজে আসে তাদের পরনে থাকে ’বিপজ্জনক’ খোলামেলা পোশাক, মুখে রাজ্যের গল্প, আর গোটা ফ্লোর জুড়ে উচ্চস্বরে গানের আওয়াজ। পরিবেশটাই অন্যরকম। জানালার বাইরে সান্দিয়া পাহাড়ের চূঁড়াগুলোকেও অন্যরকম মনে হয় এদিন। আমাকে ছাড়া কেবল অন্য একজন হাজির হল এ যাত্রায়। জন এডামস, আমার কলিগ হলেও এ লাইনে সে কাজ করছে অনেকদিন।
টেলিকমিউনিকেশন লাইনের প্রথম চাকরিটা নিয়ে যেদিন এ অফিসটায় পা রেখেছিলাম পুঁজি ছিল কেবল সিলিকন ভ্যালিতে নেয়া তিন সপ্তাহের একটা ট্রেনিং। তাই ছয় ফিগার বেতনের চাকরিটা ধরে রাখতে পারবো কিনা এ নিয়ে মনে ছিল যথেষ্ট সন্দেহ। কিন্তু জন এডামসের কারণে সে সন্দেহ দূর হতে খুব একটা সময় লাগেনি। সাদা চামড়ার এমন একজন ভাল মানুষের সাথে আগে কখনো পরিচয় হয়েছিল কিনা চাইলেও মনে করতে পারিনা। বলতে গেলে নিজ হাতের নিবিড় ছোঁয়ায় গড়ে তুলেছে আমার মত বেশ কজনকে। অফিসে তাকে বলা হয় মানুষ তৈরীর কারিগর। আসলেই বোধহয় তাই। অস্বাভাবিক অমায়িক এবং কথা বলে খুব নীচু স্বরে। আমাদের লাইনে এমন কোন সমস্যা নেই যার সমাধা ওর জানা নেই। ওর একটা টেকনিক্যাল খেতাব আছে, ভার্চুয়্যাল ল্যাব! এ নিয়ে অফিসে হাসি ঠাট্টারও অভাব নেই (ব্রেক সময়ে)। এক কথায়, অন্য দশটা কর্পোরেট জীবনের মত আমাদের জীবনও এখানে বেড়ে উঠে ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে। প্রায় ঘন্টা দশের মত কাজ করার পর মনে হল আমি ক্লান্ত এবং এক্ষুণি ঘরে ফিরতে হবে। জনকে ফোন করে জানিয়ে দিলাম আমার সিদ্ধান্ত। উত্তরে জানাল সেও বের হচ্ছে আমার সাথে।
এলিভেটরে দেখা হল তার সাথে। প্রস্তাবটা আমিই দিলাম। ফোর্থ স্ট্রিটের কোনায় চমৎকার একটা পাব আছে, স্বল্প বসনা রমণীদের সার্ভিসে বিয়ার পান ওখানটায় সবসময়ই উপাদেয় অভিজ্ঞতা। এর আগেও দু’একবার কাজের শেষে দলবেঁধে আড্ডা দিয়েছি পাবটায়। জন রাজি হয়ে গেল। দুজনের জন্যে দু পাইন্ট ড্রাফট বিয়ার সাথে মেক্সিকান চিলি ও গোটা বিশেক ঝাল চিকেন উইং অর্ডার দিয়ে ভুলে যেতে চাইলাম কাজের ক্লান্তি। ব্যাক্তিগত ব্যাপার নিয়ে আলোচনা সাধারণত এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি অফিসে। জনকে অনেকদিন ধরে জানলেও তার নিজের সম্পর্কে বলতে গেলে কিছুই জানা ছিলনা। ভাবছিলাম এ নিয়ে কথা বলি তার সাথে। আমাকে তা করতে হল না, জন নিজেই তার সূত্রপাত করলো। ’তুমি কি জান চাকরী ছেড়ে চলে যাচ্ছি আমি? এবং আগস্টই হবে আমার শেষ মাস‘। ভূমিকম্প হলেও এতটা চমকে উঠতাম না বোধহয়। প্রশ্ন না করে তাকেই বলতে দিলাম নিজের কাহিনি। অদ্ভুত সব কাহিনি বলে গেল সে, আমি শুধু হা হয়ে গিলে গেলাম। ডাক্তারের নির্দেশে চাকরী ছাড়ছে সে। ডাক্তারী ভাষায় ’পোস্ট ওয়্যার ট্রমাটিক সিনড্রোম’ রোগে আক্রান্ত সে, এবং কাজের লোড না কমালে নার্ভাস ব্রেকডাউনে চলে যেতে পারে যে কোন সময়। আমি জানতাম জন ইরাক যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু এ যুদ্ধের কোন স্থায়ী এফেক্ট তার মধ্যে বাসা বেধে আছে বলে কখনো মনে হয়নি। কথা প্রসংগে জানা গেল অফিসের লিওনার্ড, জেফ্রি, এরিক ও ডোনাল্ড ওরা সবাই তার সাথে একই প্লাটুনে যুদ্ধ করেছে ইরাকে। কম্যুনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে লজিস্টিক সাপোর্ট দেয়াই ছিল তাদের মুল কাজ। কিন্তু সব বদলে দেয় ইরাকের মসুল নগরীতে এক রাতের ঘটনা। আই ই ডির (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) শিকার হয়ে প্রাণ হারায় তাদের ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু। ঘটনার পর হতেই শুরু হয় মানসিক বিপর্যয়। যদিও এগুলো তাদের দায়িত্বের ভেতর ছিলনা তবু তারা জড়িয়ে পরে হত্যা, গুম আর নির্যাতনের মত পশুসুলভ কাজে। এমন কি শিশু কিশোরদেরও নাকি রেহাই দেওয়া হয়নি ঐ রাতে। এক কথায় প্রতিশোধের পশুত্ব স্থায়ী আসন করে নেয় তাদের রক্তে। এর প্রতিফলন ঘটতে থাকে দৈনন্দিন কাজে। তাদের পাঁচ জনকেই অসময়ে দেশে ফেরৎ পাঠনো হয় এবং বলা হয় পশ্চিমের এ অঞ্চলের বড় একটা কোম্পানীর সাথে যোগাযোগ করতে। সে সূত্রেই পাঁচ জনের সবাই চাকরী পায় এ কোম্পানিতে। এত সূযোগ থাকতে আর্মি কোরে কেন যোগ দিল এর উত্তরে জন জানাল আরও হূদয়বিদারক কাহিনি। ছোট হতেই মা-বাবা বহু বিয়ের নদীতে ভেসে কোন বন্দরে ঠাঁই নিয়েছে তা কেউ জানতো না। মানুষ হয় দাদা-দাদীর কাছে। ড্রাগ, অ্যালকোহল আর নারীর সহচর্যে আর দশটা বখে যাওয়া আমেরিকান যুবকের মতই বেড়ে উঠে টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের অষ্টিন শহরে। দাদা-দাদি আর কিছু না পারুক জোর করে কলেজে পাঠিয়েছিল তাকে। লেখাপড়া শেষে বিরাট অংকের দেনা কাধে নিয়ে ফিরে যায় দাদাবাড়িতে। কিন্তু তাদের অবস্থা ছিল আরও শোচনীয়, বিশেষ করে আর্থিক ভাবে। এমন প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনীতে যোগদান ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। স্টুডেন্ট লোনের অনেকটাই বহন করে নেয় সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর এবং ইরাক ডেপ্লয়মেন্ট সুযোগ এনে দেয় বেশ কিছু অতিরিক্ত পয়সা আয়ের। এ জন্যেই নাকি তার যুদ্ধে যাত্রা। দেশপ্রেমের প্রসঙ্গ টানতে তুবড়ি মেরে উড়িয়ে দিল এবং জানাল এসব নাকি তৃতীয় বিশ্বের গরিবী বাগাড়ম্বরতা। যুদ্ধের ভাল-মন্দ নিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করলাম না আমি। যা বলার সেই বলে গেল। কর্পোরেট ইহুদী স্বার্থের সাথে রিপাবলিকানদের হানিমুন হতেই নাকি এ যুদ্ধের শুরু। এবং তার ভাষায়, এ যুদ্ধ চলতে থাকবে অনন্তকাল ধরে। জন জানালো, তাদের ৫ জনকে প্রায়ই কাউন্সিলিং'এ হাজির হতে হয় এবং শুনতে হয় যুদ্ধ ফেরৎ অনেক আমেরিকানের না বলা কাহিনি। গল্পের কোন ফাঁকে অর্ধ নগ্না ওয়েট্রেস বিয়ার আর খাবার দিয়ে গেল তার হুস ছিলনা। জন হঠাৎ করেই থেমে গেল এবং বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ রইলো। ‘ফুড ইজ গেটিং কোল্ড, লেটস স্টার্ট’। ’চিয়ার্স’ বলেই শুরু হল আলোচনার দ্বিতীয় পর্ব। এ পর্বে যুদ্ধের কোন ছায়া ছিলনা, ছিল বন্য আমেরিকার বন্যতায় ভরা পুরুষালী গল্প। বেলা পরে আসছিল। উঠতে হলে আমাদের। আমি দিতে চাইলেও সে মানল না। বিল দুজনে শেয়ার করে বড় ধরনের টিপস দিয়ে বেরিয়ে এলাম পাব হতে। ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নেয়ার আগে জন জানাল, যুদ্ধের আগে সে বিয়ে করেছিল এবং স্ত্রীকে ভীষন ভালবাসত। কিন্তু ইরাক হতে ফিরে আসার আগেই অন্য একজনের হাত ধরে তার নিজের মা-বাবার মতই ভালবাসার নদীতে নাও ভাসিয়ে নিখোঁজ হয়ে যায় তার স্ত্রী।
ফোর্থ ষ্ট্রীটের পাব হতে আমার বাসা পাঁচ ব্লক হেটে যাওয়ার রাস্তা। আমাদের অফিসটা ফিফথ ষ্ট্রীটে। প্রতিদিন চার পাঁচ ব্লগ হেটে অফিসে আসা যাওয়ার ভেতর অন্যরকম একটা মাধুর্য আছে। দারুন উপভোগ করি সকালের ডাউনটাউন। ফিকে হয়ে আসা সূর্যটার তেজও নেতিয়ে গেছে ততক্ষণে। পাশের ক্যাথলিক চার্চ হতে ভেসে আসা সন্ধ্যা ছয়টার ঘন্টা জানিয়ে দিল এবার ঘরে ফেরার পালা। হাতের ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে প্রতিদিনের মত রওয়ানা দিলাম বাসার উদ্দেশ্যে।
ফোর্থ স্ট্রীট আর সেন্ট্রালের কোণাই ওদের বাড়িঘর। অফিশিয়ালি ওরা হোমলেস, আন-অফিশিয়ালি ওরা রেড ইন্ডিয়ান, এবং মার্কিন মুলুকের আসল মালিক। প্রতিদিন একই রাস্তা মাড়ানোর কারণে একজন আরেক জনকে ভাল করেই চিনি। দেখলেই লম্বা একটা সালাম দেয় এবং হাত বাড়িয়ে দেয় কিছু সাহায্যের আশায়। অফুরন্ত সুযোগের দেশ আমেরিকায় এ ধরনের ভিক্ষাবৃত্তি আমার কাছে এক ধরণের বিলাসিতা মনে হয়। তাই কোনোদিনই কাউকে এক পয়সা দিয়েও সাহায্য করি না। আজ কি মনে করে দুটা ডলার এগিয়ে দিলাম। কোথায় যেন দায় শোধের একটা মিহি তাগাদা অনুভব করলাম। হতে পারে বিয়ারের কারণে।