’’মাতাসাগর’। বাংলাদেশের কোথাও এমন একটা চমৎকার নামের দিঘি আছে জানা ছিলনা। দিঘিটার উপর আজ একটা লেখা বেরিয়েছে দৈনিক কালের কণ্ঠে। পড়লে যে কোন সূস্থ মানুষের মন খারাপ হতে বাধ্য। নদীর মত দিঘি ঘিরেও মানুষের জীবন বেড়ে উঠতে পারে, দিনাজপুরের মাতাসাগর দিঘি তার জীবন্ত স্বাক্ষী। মানুষ যান্ত্রিক জীবন হতে ক্ষণিক স্বস্তির জন্যে প্রকৃতির কাছে আশ্রয় খোঁজে। দিনাজপুরের ঐ অঞ্চলের মানুষের জন্যে মাতাসাগর দিঘি ছিল তেমনি একটা জায়গা। এখানে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে মানুষ ভীড় জমাতো। ভূমি দস্যুদের খপ্পরে ক্ষতবিক্ষত আজকের বাংলাদেশ। মাতাসাগর দিঘির প্রতি এসব দস্যুদের লোলুপ দৃষ্টির বয়স অবশ্য বেশ পুরানো। শুরুটা জেনারেল জিয়ার সময় হতে। এসব ভূমি দস্যুদের পরিচয় পাঠকদের সামনে তুলে ধরার জন্যেই আজকের এ লেখা। আসুন পরিচিত হই তাদের সাথে।
বাবা ও ছেলের একই নাম, বাংলাদেশে এমন ঘটনা খুবই বিরল। কিন্তু একেবারে যে নেই তা নয়। দিনাজপুরের মজুমদার পরিবার এই ব্যতিক্রমের মধ্যে একজন। ইস্কান্দর ও তৈয়বা বেগমের পাঁচ সন্তান। বড় মেয়ে চকলেট, মেজো মেয়ে পুতুল, ছোট মেয়ে বিউটি, বড় ছেলে ইস্কান্দর আর ছোট ছেলে শামিম। শুনতে সাধারণ শোনালেও এ পরিবার আসলে সাধারণ ছিলনা। বিশেষ করে ১৯৭৭ সালে পরিবারের মেজো জামাই বাংলাদেশ নামের দেশটার কর্ণধার হওয়ার পর। শুরুটা পরিবারের কর্তা ইস্কান্দর মজুমদারকে দিয়ে। যার মৃত্যুকে সততার কাফনে দাফন করে দেশের কোটি মানুষকে চোখের পানি আর নাকের পানিতে ভাসানো হয়েছিল কথিত সেই সৎ মানুষ ক্ষমতার স্বাদ নিয়েই অসততার হাত বাড়িয়ে দেন আপন শ্বশুরের দিকে। আর দশটা জোচ্চুরি ব্যবসার মতই ক্ষমতার ছত্রছায়ায় রাতারাতি গঠিত হয় ’দিনাজপুর লাইভষ্টক & পোলট্রি ফার্ম লিমিটেড’। ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম ই মজুমদার। পাঠক, বিভ্রান্ত হবেন না, এ মজুমদার অন্য কেউ নন, আমাদের ইস্কান্দার মজুমদার স্বয়ং। জাতিকে বিভ্রান্ত করতে নামের কারসাজি! এভাবেই শুরু হয় মাতাসাগর দিঘি অবৈধ ভোগ দখলের লম্বা কাহিনী। কলমের এক খোঁচায় এই দিঘি ৯৯ বছরের জন্য লিজ দেয়া হয় মজুমদার পরিবারের কাছে। সরকারী জমি লিজ নেয়া মহা অন্যায় কোন কাজ নয়, হোক তা রাষ্ট্রপ্রধানের শ্বশুর। কিন্তু অন্যায় পর্ব শুরু হয় লিজ নেয়ার পর। এলাকার মুক্তিযোদ্ধা আবু বকরের মুখেই শোনা যাক মজুমদার পরিবারের অন্যায় পর্ব। ’এ্যয় রকম উঁচা পার ছিল। পাড়ে বড় বড় গাছ ছিল। হামার এলাকার নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা ছিল মাতাসাগর। সব খাইয়া নিছে খালেদা-পটলের পরিবার। খালেদা জিয়ার বাপ এস্কান্দরের রাক্ষুইস্যা চোখের ভেতর চলে গেছে হামার মাতাসাগর। কুটি কুটি টাকার গাছ, মাটি বেচাইছে আর এলাকার মাইনষ্যের নিঃশ্বাসের জায়গার উপর ওপর পুরা পরিবার দাপাদাপি করছে। এখন পটল আর তার ভাই মিজান দখল কইরা রাখছে। গরুর খামার, মুরগীর খামার, চাতাল, মাছের পুকুর, আম বাগান, লিচু বাগান সব ভোগ দখল করতেছে। আর এই জায়গা দেখাইয়া ব্যাংক থেইক্কা কুটি কুটি টাকা লোন নিতাছে।‘ পরিবারের কর্তা ইস্কান্দরের মৃত্যুর পর তার সন্তানেরা ওয়ারিশ সূত্রে ভোগ দখল করতে থাকে মাতাসাগর দিঘি। প্রায় ৪৬ একর জমির উপর বন্দোবস্তকৃত এই দিঘি আইনের পরোয়া না করেই দুই বার মালিকানা হস্তান্তর করে ইস্কান্দর মজুমদারের হাভাতের দল। যা উল্লেখ না করলেই নয়, বন্দোবস্ত বুঝে নেয়ার সময় দিঘির পাশে বসবাসকারী শতাধিক ছিন্নমূল পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয় প্রশানের সহযোগীতায়।
মজুমদার পরিবার নয়, মাতাসাগরের ভোগ দখলকারীর ভূমিকায় এখন খালেদা জিয়ার বিশ্বস্ত লেফটেনেন্ট জনাব ফজলুর রহমান পটল। দিঘিকে কুমিরের দশ ছানার মত বার বার দেখিয়ে ব্যাংক হতে লোন নেয়া ৭০ লাখ টাকার দেনা শোধ না করেই পরপারে পাড়ি জমান মজুমদার পরিবারের কর্ণধার জনাব ইস্কান্দর মজুমদার। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের সাথে ভেতরের ক্ষোভ প্রকাশ করতে এগিয়ে এসেছে এলাকার জনগণ। মানুষ ফিরে পেতে চায় তাদের নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা। এ নিয়ে সরকারী পর্যায়ে তদন্ত চলছে।
পাঠক, আশাকরি আমার মত আপনারাও বুঝে নিয়েছেন সরকারী তদন্ত আর জনগণের ক্ষোভের শেষ ঠিকানা কোথায়। কিছুই হবেনা শেষ পর্যন্ত। চার বছর পর আবার ক্ষমতা ফিরে পাবে মজুমদার পরিবার। নিজেদের অধিকার নিয়ে যারা কথা বলেছিল মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হবে তাদের। মাতাসাগর পটলদের ভোগ দখলেই থাকবে শেষ পর্যন্ত, যার অদৃশ্য মালিক হিসাবে রয়ে যাবে মজুমদার পরিবারের শক্তিশালী ভূমিদস্যুর দল। এটাই হল পরিবার কেন্দ্রিক গণতন্ত্রের আসল চেহারা। এ অভিশাপে শুধু মাতাসাগর কেন পুরা বাংলাদেশই এখন খালেদা-হাসিনার ভূমিদস্যুদের দখলে।
ইস্কান্দর মজুমদার আর তৈয়বা মজুমদারের লাশ কি কংকাল হয়ে মাটির সাথে মিশে গেছে এতদিনে? শোনা যায় সৈয়দা তৈয়বার খপ্পর হতে দিনাজপুরের এতিমখানা পর্যন্ত রেহাই পায়নি। আমার মতে এদের লাশ দিনাজপুরের মাটিতে পুতে এলাকাকে অপবিত্র করা হয়েছে মাত্র। বাস্তবে না হোক, কল্পনায় আমি এদের লাশ ঐ শহরে কোন এক ব্যস্ত মোড়ে ঝুলিয়ে মাতাসাগরে নিঃশ্বাস ফেলার অধিকার ফিরিয়ে দিতে চাই এলাকার জনগণের কাছে।
http://www.dailykalerkantho.com/?view=details&type=single&pub_no=174&cat_id=1&menu_id=13&news_type_id=1&index=0