আমার এ লেখাটা কাউকে অভিযুক্ত করার জন্যে নয়। মাথা পেতে অভিযোগ নেয়ার মত সাহসী আদম আমাদের দেশে জন্ম নেয় না। তাই অভিযোগ করে লাভ হয়না। হতে পারে খোদ সৃষ্টিকর্তাই জাতির ভাগ্যলিপিতে সীল মেরে দিয়েছেন এ নিয়তি, ‘চামড়া মোটা, অভিযোগ প্রুফ জাতি’। দায় দায়িত্ব এড়ানো ও অভিযোগ খন্ন্ডনের বায়োনিক ক্ষমতা আছে আমাদের রক্তে। তাই ঘটনা যত গুরুতর আর ভয়াবহই হোক না কেন এর দায়-দায়িত্ব এড়ানোর আধুনিক কলাকৌশল সব আমাদের নখদর্পণে। উদাহরণ হিসাবে তত্ত্বাবধায়ক আমলে সোনা রফিক নামে আওয়ামী লীগের প্রাক্তন এক সাংসদের কথা ধরা যেতে পারে। গুলশানের এক রেস্ট হাউজে গোটা কয়েক যৌনকর্মী সহ বমাল গ্রেফতার হওয়ার পর চমৎকার এক বক্তব্য রাখেন বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে। বেচারার কথা বিশ্বাস করলে আমাদের মানতে হয় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে পতিতা নাটকের অবতারণা করেছিল তার বিরুদ্ধে। মোক্ষম জবাব বৈকি!
রাজনৈতিক বেশ্যাদের পেশাদারী মিথ্যাচার নিয়ে আমার এ লেখা নয়। আসছি মূল প্রসংগে।
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বুয়েটে রক্তক্ষরণ অব্যাহত রয়েছে। কাঁদছে এর ক্যাম্পাস। কিছুতেই ভুলতে পারছেনা সদ্য ভর্তি হওয়া সহপাঠীর অকাল মৃত্যু। খন্দকার খান জাহান সম্রাটের মৃত্যু আর দশটা মৃত্যুর মত স্বাভাবিক ছিলনা। ঘাতক বাসের চাকা দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে তার মস্তক। সংসারে তিন মেয়ের জন্মের পর বাবা গেলেন খান জাহান আলীর মাজারে। দোয়া করলেন ছেলে সন্তানের জন্যে। হীরের টুকরার মত ফুটফুটে সন্তানের জন্ম হল। আউলিয়ার নামে নাম রাখলেন খান জাহান। আলোকিত হল পরিবার। সাফল্যের সবকটা সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে মা-বাবার অতি আদরের সন্তান শেষ পর্যন্ত ভর্তি হল দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বুয়েটে। ক্লাস করল মাত্র চার দিন। এবং এখানেই সমাপ্তি ঘটল মধ্যবিত্ত পরিবারের কিছু প্রত্যাশার।
কাকে দায়ী করব এর জন্যে? বাস ড্রাইভারকে? কেন? দেশীয় বাস ড্রাইভারদের জন্মের ইতিহাসে কি আমাদের জানা নেই? ওরা খেটে খাওয়া পরিবার হতে উঠে আসে। কিছুদিন হেল্পারী করার পর বসে যায় চালকের আসনে। যথাযত কর্তৃপক্ষের সাথে নগদ কিছু বিনিময়ের মাধ্যমে যোগাড় করে নেয় লাইসেন্স নামক টয়লেট পেপার। আইনের সাথে পরিচয় হল না, নিয়ম-কানুন জানতে হল না, তার আগেই সম্রাটদের ঘাতক হওয়ার লাইসেন্স তুলে দেওয়া হল এদের হাতে। যারা পয়সা খেয়ে লাইসেন্স নামক কাগজে সই করল তারা কি চাইলেই দায়িত্ব এড়াতে পারবেন? সবাই যদি সোনা রফিক বনে যায় তা হলে তো বলার কিছু থাকে না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের 'মাননীয়' মন্ত্রীবরও কি সোনা রফিকদের একজন নন? হাতি ঘোড়া অশ্ব ডিম্ব সহ আলিশান আয়োজনে দিন গুজার করেন যোগাযোগ মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রীবর। সভা সমিতি আর নেত্রী স্তূতির তাবেদারীতেই সময় চলে গেলে কোথাকার কে, কার কাছে থেকে পয়সা খেয়ে কি সই করল এত কিছু দেখার সময় থাকবে কি করে? পয়সা যে সবাইকেই খেতে হয়। কেউ খায় লাইসেন্সে সই করে, কেউবা আন্তর্জাতিক টেন্ডারে সম্মতি দিয়ে। ৬০ মন্ত্রী, সাথে পাইক পেয়াদা, তীরন্দাজ বরকন্দাজ নিয়ে মহাসমারোহে বাস করছেন সই সমিতির মহা কর্ণধার জনাবা প্রধানমন্ত্রী। ইডেন কলেজের সামনে কোথাকার কোন সম্রাটের মগজ থেতলে গেল তাতে উনার কি? এত ক্ষুদ্র ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামালে অভাগা দেশটার হবে কি? পরিবারের কারও জন্যে ভুনা খিচুড়ি পাকিয়ে উনাকে যে অপেক্ষা করতে হয়না। কারণ এক উনি ছাড়া সবাই বিদেশ। ওখানে পয়সা খেয়ে ঘাতক তৈরীর লাইসেন্স ইস্যু হয়না। তাই প্রধানমন্ত্রী নিরাপদ এবং সন্তানাদির ভাগ্য নিয়ে নিশ্চিত।
তারুণ্যের উদ্দামতার কাছে বিবেক, বিচার ও বুদ্ধি মার খায়, এ নিয়ে হা হুতাশ করে লাভ নেই। ছাত্র তান্ডবে আগুনের লেলিহান শিখায় প্রাণ দিয়েছে বেশ কিছু যানবাহন। কার লাভ হল? সম্রাট ঘাতকদের বিবেক কি নাড়া দিয়ে গেল? মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীদের দায়িত্ববোধ কি উথলে উঠলো? বরং উলটো এমন কিছু হল, যার ফলে লাভবান হবে সেই সোনা রফিকেরই দল। ইনস্যুরেন্স কোম্পানীর বড় কর্তাদের হাতে নগদ কিছু ধরিয়ে দিয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা আদায় করে নেবে বাসের দ্বিগুন মূল্য। থানার দারোগা পুলিশরা হিংস্রতার অজুহাতে দায়ী ছাত্রদের অভিভাবকের পকেট হতে খসিয়ে নেবে বেশ কিছু বঙ্গবন্ধু মার্কা নোট।
গদি দখলের রাজনীতিতে আমাদের দেশ ক্লান্ত, শ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট। রাজনীতির গোলক ধাঁধায় আটকে আমরা এতটাই বিভ্রান্ত, ভুলে গেছি জনগণের স্বাভাবিক জন্ম মৃত্যুর নিশ্চয়তা দেয়ার অপর নামই রাজনীতি। রাস্তাটা কার নামে নামকরণ করা হল তার চাইতে বেশী জরুরী একই রাস্তা চলাচলের জন্যে কতটা নিরাপদ। এই সহজ সত্যটা ছাত্রদের মগজে ঢুকানো গেলে টলে উঠবে সোনা রফিকদের তখততাউস। বাসে আগুন না দিয়ে ছাত্রদের আহ্বান জানাবো এই সোনা রফিকদের পশ্চাতদেশে আগুন জ্বালাতে। কে জানে, আগুনের লেলিহান শিখা হয়ত প্রধানমন্ত্রী সুরক্ষিত প্রাসাদ পর্যন্ত গড়াবে। সেদিন, কেবল সেদিনই সম্রাট ঘাতকদের চিরস্থায়ী কবর হবে। এর আগে নয়।