এ দুর্ঘটনা নয়, ঘটনা

Submitted by WatchDog on Friday, June 4, 2010

Bangladesh

মৃত্যু অনাকাঙ্খিত হলেও অপ্রত্যাশিত নয়, এবং তাতে অগৌরবের কিছু নেই। মৃত্যু মৃত্যুই, তা যেভাবেই আসুক। মানুষ জন্ম নেয় মরার জন্যে। আমাদের জীবনটাই পল্লবিত হয় জন্ম-মৃত্যুর লড়াইকে ঘিরে। এ লড়াই জয়ী হওয়ার লড়াই নয়, অবধারিত পরাজয়ের লড়াই। জেনেও আমরা লড়ি, কারণ এর নামই বেচে থাকা। আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলোতে এ লড়াই চালাতে হয় মাল্টি ফ্রন্টে। প্রকৃতি ছাড়াও লড়তে হয় মনুষ্য সৃষ্টি মৃত্যুর সাথে। আমাদের প্রতি পদে ওৎ পেতে থাকে হাত পা ওয়ালা আজরাইল। দিনান্তে অনেকে জয়ী হলেও সবাই হয়না। কাউকে ধরা দিতে হয় নিরাকার আজরাইলের কাছে। এ পথেই গতকাল ধরা দিল পুরানো ঢাকার বেশ কিছু স্বদেশী।

আমার গিন্নী সুদূর পেরু হতে গোটা পাঁচেক এসএমএস পাঠিয়ে জানাল তার উৎকণ্ঠার কথা। তাদের টিভি নেটওয়ার্কগুলো ফলাও করে প্রচার করছে ঢাকার কথা। বাংলাদেশের ভাল কিছু নিয়ে বিদেশী মিডিয়া মাথা ঘামাবে এমনটা আজ পর্যন্ত দেখিনি। এ যাত্রায়ও হল তাই। ওরা ঢাকার আগুন নিয়ে সোরগোল করছে। ছবি যা দেখাচ্ছে তাতে নাকি মনে হচ্ছে গোটা শহর জ্বলছে। আমাদের বাড়ি ওদিকটায় নয় এমনটা বলে আশ্বস্ত করলাম। মন চাইল না জন্মভূমির কালো কাহিনী বিদেশী স্ত্রীর কাছে বলে দেশকে খাটো করতে। বলতে বাধ্য হলাম এটা ছিল নিছকই একটা দুর্ঘটনা, এমনটা হতেই পারে।

গিন্নিকে বুঝানো গেলেও নিজেকে বুঝাতে একটু কষ্ট হল। ঘটনা আসলেই কি দুর্ঘটনা ছিল? দুটা ট্রান্সফরমার একসাথে বিস্ফোরিত হল, এটা কি দুর্ঘটনা ছিলনা? অনেকের কাছে তা মনে হলেও আমার কাছে নয়। কারণ আমি এ লাইনের লোক। ঘটনা কেন ঘটে এবং তাকে দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দিয়ে কারা লাভবান হয় এ কাহিনী আমার নিজের কাহিনী। শতাধিক প্রাণ বধ কারী দুটো ট্রান্সফরমারের কাহিনী নিয়েই শুরু করা যাক আজকের লেখাটা।

আমার জানা নেই কত কেভিএ ক্ষমতাসম্পন্ন ট্রান্সফরমার ছিল ওগুলো। এমন কোন তথ্য পত্রিকায় বেরিয়ে থাকলেও চোখে পারেনি। রাস্তার ট্রান্সফরমারগুলোকে বলা হয় ষ্টেপ-ডাউন ডিস্ট্রিবিউশন ট্রান্সফরমার। গ্রাহকের সাথে বিতরন ব্যবস্থার যোগযোগ করিয়ে দেয়াই এগুলোর কাজ। এক সময়ের আমদানি নির্ভর এ পণ্য এখন দেশেই তৈরী হচ্ছে। 'এনার্জি প্যাক' নামের এক কোম্পানী আভ্যন্তরীণ বাজার ছাড়াও বিদেশে রপ্তানী করছে তাদের তৈরী প্রডাক্ট। রপ্তানী পন্যের গুনগত মান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিলে রপ্তানী বাজার সহজেই মার খায়, সুতরাং এর সাথে কম্প্রোমাইজ করার কোন অবকাশ নেই। কম্প্রোমাইজ যা করার তা করতে হয় দেশীয় বাজারে। নিম্ন মানের তামার তার, ততধিক নিম্ন মানের ইনসুলেশন পেপার, রুগ্ন কুলিং ওয়েল, এসব একসাথে করে যা দাড় করানো তার নাম দেয়া হয় ট্রান্সফরমার। পন্যের মূল গ্রাহক আমাদের বিদ্যুৎ কোম্পানী। সরকারী কোম্পানিকে সাপ্লাই দেয় প্রাইভেট ঠিকাদার। দরপত্রে পন্যের সাপ্লাই মূল্য লেখা থাকলেও যেটা লেখা থাকে না তা হল উপরি। সাপ্লাইয়ের আগে টেস্ট বাধ্যতামূলক। এবং এ টেস্টে সরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির উপস্থিতিও মাস্ট। নিম্নমানের মালামাল দিয়ে তৈরী ট্রান্সফরমারের টেষ্ট রেজাল্ট কি হবে তা সহজেই অনুমেয়। তাতে কি, উপরির উপর ভর করে ট্রান্সফরমার ছাড় পেয়ে চলে যায় গ্রাহকের দোরগোড়ায়। যেমনটা গিয়েছিল ঢাকার নবাব কাটারায়।

একটা ট্রান্সফরমারকে আমরা যদি এক ভান্ডার মিস্টি হিসাবে বিবেচনা করি হিসাব কষে বের করা যায় কজন অতিথিকে এ মিস্টি দিয়ে সন্তুষ্ট করা সম্ভব। ট্রান্সফরমারের ক্ষমতা সীমিত থাকে তার ক্যাপাসিটির ভেতর। এর বাইরে গেলে ভেতরের টেকনোলজি বেঁকে বসতে বাধ্য। অনেকটা হরিলুটের মত লুটপাট করা হয় এর ধারণ ক্ষমতা। উপরির উপর উপরি খেয়ে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, এমনকি যুগ যুগ ধরে চলতে থাকে নতুন সংযোগ। স্বভাবতই ব্যবহৃত ট্রান্সফরমার অতিক্রম করে ফেলে তার ধারণ ক্ষমতা, ভেতরে গরম হতে থাকে তামার তার, কুলিং সিষ্টেম হারিয়ে ফেলে তার কার্যকরিতা। কোন এক সুন্দর বিকেলে স্বভাবতই গর্জে উঠে ক্লান্ত, শ্রান্ত, ওভারলোডেড ট্রান্সফরমার। অনেকে দুর্ঘটনা বললেও আমি তা মানতে নারাজ। আসলে এ ধরণের ঘটনার জন্যে চাতকের মত অপেক্ষায় থাকেন আমাদের প্রকৌশলীগন। ট্রান্সফরমার পুড়ে যাওয়া মানেই নতুন করে দরপত্র আহ্বান। পুড়ে যাওয়া ট্রান্সফরমার মেরামত করেও ব্যবহার যায়। সংগত কারণে এ ধরণের মেরামত খুশির হিল্লোল বইয়ে দেয় সংশ্লিষ্ট দপ্তরে। তেল চুরি, তার চুরি, লোকবল চুরি, পরিবহন চুরি, মেরামতের আদ্যোপান্ত জড়িয়ে থাকে জনসম্পত্তি লুটপাটের কালো কাহিনী।

প্রায় ১০০ জন প্রাণ হারালো চুরির বলি হয়ে। ৮টি বাড়ি ও ৫টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়ে কয়লা হল। এসবের ভেতর হতে বের করা হল কঙ্কালসার লাশের সাড়ি। এর মধ্যে একটা বাড়িতে চলছিল বিয়ের অনুষ্ঠান। আমন্ত্রিত অতিথিরাও ফিরে গেল লাশ হয়ে। এ ঠান্ডা মাথার খুন। কারণ এমনটা যে ঘটতে পারে দায়িত্ব প্রাপ্তদের তা জানা থাকে। তাদের চুরির পথে পা বাড়াতে হয়, কারণ সমাজে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বেচে থাকার তাগাদা আছে, ঘরে আছে স্ত্রীর চাহিদা। একজন প্রকৌশলী এককভাবে এত উপরি হজম করে ফেলেন এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না খাম্বা মামুনদের কথা। বিদ্যুৎ নেই বলে আমাদের দেশে অগ্ন্যুৎপাত হচ্ছে। যে দেশে উৎপাদিত বিদ্যুতের শতকার প্রায় ৫০ভাগ চুরি হয় সে দেশে এর অভাব কোন দিনই মেটার নয়। উৎপাদন যত বাড়বে সাথে বাড়বে চুরি। পাত্রের তলা ফুটা করে পানি ঢাললে সে পানি মাটিতে গড়াতে বাধ্য। আমাদের অর্থনীতিতেও বিশাল এক ফুটা আছে, যে ফুটার শেষ প্রান্তে মুখ পেতে অপেক্ষায় থাকে খাম্বা মামুন আর লালু বুলু টুলুর দল।

চুরি চামারির সাথে জীবনকে খাপ খাইয়ে নিলে এমনটা ঘটতে বাধ্য, তাই ১০০ প্রাণের মৃত্যুতে সমবেদনা জানাতে পারলাম না। আমাদের বুঝতে হবে এবং মানতে হবে একটা ট্রান্সফরমার আপনা আপনি বিস্ফোরিত হয়না, এর বিস্ফোরন ঘটানো হয়।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন