জুনের শুরুতে গরমের তেজ এতটা তীব্র হবে স্বপ্নেও কেউ কল্পনা করেনি। কিন্তু তাই হল। সূর্যের দাপট এখন এতটাই ভয়াবহ, মনে হবে আসমান ফেটে আগুনের গোলা নেমে আসছে। জনজীবন স্থবির হওয়ার মত অবস্থা অনাকাঙ্খিত অতিথির আক্রমণে। তাপমাত্রা ১০৩ ডিগ্রী (ফারেনহাইট) পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে ভরদুপুরে। প্রতিবেশী কালর্সবাদ শহরে ১০৭ ডিগ্রী অতিক্রম করে ফেলেছে ইতিমধ্যে। চারদিক জনশূন্য। পরিচয় না থাকলে মনে হবে এ এক ভুতুড়ে নগরী। আমেরিকার হিংস্র পশ্চিমে শুধু ঘরে নয়, গাড়িতেও এসি চালাতে হয় বাচার তাগিদে। অন্যের মত আমার গাড়ি ও বাসাতেও এর ব্যতিক্রম নেই। এসব দিয়ে শরীর ঠান্ডা করা গেলেও মনটাকে বশে আনতে কষ্ট হচ্ছে ইদানিং। এর জন্যে এ অঞ্চলের দানবীয় গরমকে দায়ি করব তারও উপায় নেই। সমস্যাটা আসলে আমেরিকার নয়, আমার নিজের।
মধ্যরাতের ফোনকল মানেই খারাপ সংবাদ। এমনটাই হয়ে আসছে আমার সুদীর্ঘ প্রবাস জীবনে। গত রাতে এর কিছুটা ব্যতিক্রম হল। ভোর ৩ টার দিকে বেজে উঠল ফোনটা। ভেবেছিলাম নির্ঘাত খারাপ খবর। কথা বলে দেখা গেল ঘটনা তা নয়। আমার এক ভাগ্নে ফোন করেছে পুরানো কিছু দাবি দাওয়া মনে করিয়ে দেয়ার জন্যে। ইচ্ছা হল রাগ করতে, কিন্তু পারলাম না। মামুর কাছে ভাগিনার আবদার, এ দাবি বিচ্ছিন্ন কোন দাবি নয়, এর গোড়া মিশে আছে আমাদের রক্তে। এ সব নিয়েই বোধহয় আমাদের পরিবার, সমাজ এবং দেশ। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে অনেকক্ষণ কথা বললাম তার সাথে। নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি, কথা বললে সম্যক ধারণা পাওয়া যায় কি নিয়ে ব্যস্ত থাকছে এরা। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ছাত্র সে। তার মার হাজারো অভিযোগ ছেলে মানুষ হচ্ছে না বলে। অভিযোগ গুলো কি তা চেপে ধরতেই জানাতে বাধ্য হল আমার বোন। ছেলে যতক্ষণ বাসায় থাকে তার প্রায় সবটাই ব্যায় করে ফেইসবুক আর ট্যুইটার নিয়ে। হাতে আইপড, কোমরে মোবাইল আর মুখে ফাটুস ফুটুস ইংরেজী। এ গুলোর কোনোটাই নাকি ফ্যামিলি ট্র্যাডিশনের মধ্যে পরে না, তাই চিন্তিত ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে। লেখাপড়া কেমন করছে জানতে চাইলে বোন জানাল এ নিয়ে অভিযোগ করার মত কিছু নেই। তা হলে সমস্যাটা কোথায় তা ঘাটতে আরও ভেতরে গিয়ে জানা গেল মায়ের আসল চিন্তা। মার সন্দেহ ছেলের গার্লফ্রেন্ড আছে, এবং তার সাথে রাতভর সে কথা বলে। মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী পরিবারের চিরন্তন সমস্যা। প্রাসঙ্গিকভাবেই এসে গেল আমাদের ছোটবেলার কথা। একগাদা ভাই বোন সহ পরিবারের নিবিড় বন্ধনে বড় হয়েছি আমরা। লেখাপড়ার ফাকে ববিতা না শাবানা এ নিয়েও তর্ক করেছি। এগুলোই ছিল আমাদের তারুণ্যের প্রতীক। সময় বদলে গেছে, সাথে বদলে গেছে চাহিদা। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া আধুনা ছাত্র ছাত্রীদের কাছে বাংলা সিনেমার নায়ক নায়িকারা নিতান্তই এলিয়ান। এদের নিয়ে তর্ক দূরে থাক, নাম পর্যন্ত জানে কিনা সন্দেহ। বোনকে এসব বুঝাতে কষ্ট হয়। প্রযুক্তিকে ঘিরে বেড়ে উঠা নতুন প্রজন্মের সাথে মা-বাবার সংঘাত এখন ঘরে ঘরে, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত পরিবারে। সমসাময়িক সন্তানের কাছে পরিবারের চাহিদা কি তারও কোন সুস্পষ্ট ধারণা দিতে পারছেনা মা-বাবা। যার জন্যে বাড়ছে দূরত্ব এবং পাশাপাশি দুর্বল হচ্ছে পারিবারিক বন্ধন। ববিতা শাবানা তর্ক অপ্রয়োজনীয় হলে আমাদের সময় এগুলো রসদ যুগিয়েছে পারিবারিক বন্ধনের ভীত শক্ত করতে। আজকের ফেইসবুক আর ট্যুইটার কাজ করছে ঠিক তার বিপরীত। ঘরের মা-বাবা, ভাই-বোনকে এড়িয়ে নতুন প্রজন্ম ব্যস্ত থাকছে সাইবার পরিবার নিয়ে। এবং তাতে বাড়ছে ভুল বুঝাবুঝি ও দূরত্ব। আর এই দূরত্বই যুব সমাজকে ঠেলে দিচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত পথে।
২০০৮’এর নির্বাচনে ১টা মাস দেশে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। আমার ভাগ্নের আরও একটা দিক আবিষ্কার করেছি ঐ সময়টায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বলীয়ান ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি নিয়ে নিজ এলাকার আওয়ামী প্রার্থীর পক্ষে ভীষন সোচ্চার ছিল সে। এ নিয়ে কিছু বলতে গেলে উলটো ঝারি দিত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধে যাইনি বলে। এই তার মুখেই কাল শুনতে পেলাম অন্য কথা। ভীষন ক্ষুদ্ধ ফেইসবুক বন্ধ করায়। কথা প্রসংগে সায় দিল, ওরা আসলে একই মুদ্রার দুই পিঠ,আওয়ামী লীগ আর বিএনপি। ভবিষ্যতে কারও হয়ে ভোট চাইতে মাঠে নামবে না বলে প্রতিজ্ঞা করল। ফেইসবুক খুলে দিয়েছে এটা তার জন্যে little comfort, তার মতে damage has already been done.
দেশের নতুন প্রজন্মের সবাই রাজনীতির সেবাদাস বনে শেখ অথবা রহমান পরিবারের পূজা করছে, আমার এই সনাতনী ধ্যান ধারণা হতে সড়ে আসতে বাধ্য হলাম ভাগ্নের সাথে কথা বলে।