পর্দা উঠছে বিশ্বকাপ ফুটবলের। এখন ফুটবলের সময়। উত্তর হতে দক্ষিন, পূব হতে পশ্চিম, পৃথিবীর সব গোলার্ধে কটা দিনের জন্যে হলেও রুটি রুজির জীবন সড়ে যাবে দ্বিতীয় সারিতে। এ সময় রাজত্ব করবে লায়নেল মেসি, ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো, ওয়েন রুণি আর দিদিয়ের দ্রগবার মত তারকার দল। ১৯৩০ সালের ১৩ই জুলাই দক্ষিন আমেরিকার দেশ উরুগুয়ে হতে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা আমেরিকার দক্ষিন, ইউরোপ আর এশিয়া হয়ে প্রথম বারের মত জায়গা করে নিচ্ছে আফ্রিকায়। আফ্রিকানদের পাওনা ছিল এ অনুষ্ঠানটা। ইউরোপের ক্লাব ফুটবলে কালো আফ্রিকার উপস্থিতি এখন চোখে পড়ার মত। কোয়ালিটি ফুটবল নিয়ে ইউরোপ আর দক্ষিন আমেরিকার এতদিনের গর্বের ভাগিদার এখন আফ্রিকাও। আফ্রিকান নেশনস্ কাপে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর খেলার মান ও এর আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা কর্পোরেট মিডিয়াকে ও আকর্ষণ করছে বিনিয়োগের জন্যে। গৃহযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত দেশ লাইবেরিয়ার ক্ষুদে ফুটবলারদের নিয়ে বিবিসির তৈরী একটা ডকুমেন্টারি দেখেছিলাম। খেলার মাঠ নেই, পায়ে জুতা নেই, যে বলটা দিয়ে খেলছে সেটাও আবর্জনা দিয়ে তৈরী। হাতের অটোমেটিক রাইফেল মাটিতে রেখে ওরা মাঠে নামছে, ভুলে যাচ্ছে যুদ্ধের ভয়াবহতা। একই দৃশ্য আফ্রিকার দেশে দেশে। সিয়েরা লিওন, আইভরি কোস্ট, ঘানা, ক্যামেরুন, নাইজেরিয়া সহ কালো আফ্রিকার সব দেশেই সমস্যা। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের পাশাপাশি এ অঞ্চলের মানুষকে লড়তে হয় ঘাতক এইডসের বিরুদ্ধে। মহাদেশের খেলাধুলা তাতে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে এমনটা বললে অন্যায় করা হবে আইভরি কোস্টের ফুটবলার, কেনিয়ার দৌড়বিদ আর দক্ষিন আফ্রিকার বাস্কেটবল খেলোয়াড়রদের প্রতি।
এ নিয়ে জল্পনা কল্পনার শেষ ছিলনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিশ্চিত করা হল, উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকছেন দেশটার আসল মানুষ। ফুটবল নিয়ে আমার তেমন কোন উচ্ছাস নেই। কে জিতল আর কে হারল এ নিয়েও নেই বিশেষ মাথা ব্যথা। বিশ্বকাপ ফুটবলের শুরুটা দেখতে ভুল করব না তাও। কারণ ওখানে উপস্থিত থাকবেন নেলসন মেন্ডেলা। ৯১ বছর বয়স্ক এই কিংবদন্তী নেতা ও রাষ্ট্র নায়ককে জীবিতাবস্থায় দ্বিতীয়বার দেখা হবে কিনা কেন জানি সন্দেহ হয়। কাঁচা হাতের বাঁকা লেখা দিয়ে নেত্রী পূজার গুষ্টি উদ্ধার করছি নিয়মিত, কিন্তু এই একটা নাম নিয়ে কিছু লিখতে গেলে কলম এমনিতেই থেমে আসে। মনে হয় যথেষ্ট হচ্ছে না তার পূজা। ওদের চামড়া সাদা। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ হতে আফ্রিকার এ প্রান্তে এসেছিল সোনা, রূপা, হীরা জহরতের সন্ধানে। কাল চক্রে এই এরাই স্বদেশী কালোদের নিজ ভূমিতে অচ্ছুত বানিয়ে শাসনে শোষনে জর্জরিত করে রেখেছিল যুগ যুগ ধরে। দেশটার রব্বেন দ্বীপের নির্জন কারাকক্ষে জীবনের ২৭টা বসন্ত পার করতে বাধ্য হয়েছিলেন নেতা ম্যান্ডেলা। শোষিত কালোদের মুক্তি নিয়ে কথা বলতেন তিনি এবং এটাই ছিল তার অপরাধ। ১৯৯০ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারী জেল হতে বেরিয়ে প্রতিশোধের নাঙা তরবারি হাতে ঝাপিয়ে পরেননি ভিনদেশী সাদাদের উপর। বরং ন্যাশনাল রিকনসেলিয়েশনের কথা বলে একত্রিত করেছিলেন দেশটার সাদা, কালো আর রংগিন ভারতীয়দের। এভাবেই শুরু হয়েছিল দক্ষিন আফ্রিকা নামের মালটি রেসিয়াল দেশের যাত্রা। ১৯৯৪ সাল হতে ২০১০ সাল, খুব কি লম্বা সময় একটা যুদ্ধ বিধ্বস্ত জাতির জন্যে? স্বেচ্ছায় ক্ষমতা হতে সড়ে গেছেন সেই ১৯৯৯ সালে, এবং বাস করছেন একান্ত ব্যাক্তিগত জীবন। তৃতীয় বিশ্বের জন্যে তিনি রেখে যাচ্ছেন অবিস্মরণীয় এক ম্যাসেজ, ’ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ’। এখানেই ম্যান্ডেলার অমরত্ব। লোভ লালসাকে জয় করেও যে তৃতীয় বিশ্বের নেতা হওয়া যায় ম্যান্ডেলার অনুপস্থিতিতে পৃথিবী এমনটাই বলবে, বলতে বাধ্য হবে। ১৯৭১’এ শুরু করে আমাদের যাত্রা আজ কোন গলিতে তার প্রমাণ বাংলাদেশের ঘরে ঘরে উড়ন্ত ব্রাজিল আর্জেন্টিনা সহ বিভিন্ন দেশের পতাকা। উদাহরণটা এ রকম, ছাগলের এক বাচ্চা দুধ খায় আর বাকি দুই বাচ্চা নাচে আর গান গায়, ’ কি মজা, কি মজা ও দুধ খায়!‘ ওরা খেলবে আর আমরা নাচব, এটাই বোধহয় আমাদের নিয়তি।
আজ রাজনীতি থাক। আসুন অন্তত কটা দিনের জন্যে হলেও জীবনকে সপে দেই ফুটবলের হাতে। ঘাত প্রতিঘাতে ভরা আমাদের জীবনে আনন্দ করার মত উপলক্ষ খুব কমই আসে। বিশ্বকাপ ফুটবল তেমনি একটা উপলক্ষ যা রাজনৈতিক মেরুকরণের বাইরে এনে আমাদের এক করবে। হয়ত কটা দিনের জন্যে হলেও আমরা ভুলতে পারব দেশটার রাজনৈতিক বিভাজন, নীতি ও নৈতিকতার লড়াই।
সফল হোক আফ্রিকার আয়োজন। জয় হোক ফুটবলের।