১৯৯৫ সালের কথা। ইউরোপ হয়ে অষ্ট্রেলিয়া আসার আগে ৭টা বছর দেশে কাটিয়েছি অনেকটা জেদ করে। দেশপ্রেমিক ভাবতাম নিজকে। সরকারী পয়সায় বিদেশে লেখাপড়ার সময়ই ভাবতাম দেশে ফিরতে হবে, অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে। এ সব বড় বড় ভাবনা ভাবতে ভাল লাগত, নিজকে খুব বড় মনে হত, শরীর বেয়ে এক ধরণের অজানা শিহরণ বয়ে যেত। বন্ধু বান্ধব সবাই যখন পৃথিবীর দেশে দেশে স্থায়ী আবাস খোঁজায় ব্যস্ত, হেমন্তের কোন এক সুন্দর সন্ধ্যায় ইউরোপের ১২ বছরের স্মৃতি পিছু ফেলে নেমে পড়লাম দেশের মাটিতে। মা আর মাটির টানের জয় হল সত্য কিন্তু স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝে যে যোজন যোজন দূরত্ব তা বুঝতে সময় লাগল না বেশি। ফেরার এক বছরের মাথায় বাবার মৃত্যু জীবন নিয়ে স্বপ্ন দেখায় আসে প্রথম হোচট। হঠাৎ করেই মনে হল পৃথিবী যতটা বড় মনে হয় আসলে ততটা বোধহয় বড় না। এখানে ডাল-ভাত খেয়ে বেচে থাকার লড়াইটা মূখ্য, বাকি সবকিছু স্রেফ স্বপ্ন, কল্পনা ও এক ধরণের বিলাসিতা। চাকরী পর্বে টিকতে পারলাম না বহুমুখী কারণে। ঢাকা ছেড়ে ফিরে গেলাম নিজ শহরে। প্রায় অর্ধ শতাব্দি পুরানো পারিবারিক শিল্প প্রতিষ্ঠান দিয়েই শুরু হল বেচে থাকার আসল লড়াই।
এপ্রিলের মাসের ৪ তারিখ। ৭১’এর এ দিনটায় আমাদের শহরে পাকিদের বিমান আকাশ হতে বোমা ফেলেছিল। আগুনের লেলিহান শিখায় শহরের কেন্দ্রস্থল জ্বলছিল দাউ দাউ করে। চোখ বুজলে এখনো প্যানারোমার মত ভাসতে থাকে দৃশ্যগুলো; জ্বলছে শহরের ব্যবসা বানিজ্য, একদল পশু পশুত্বের সবটুকু ঢেলে লুটে নিচ্ছে যতটা সম্ভব। কালচক্রে এদের অনেকের চেহারাই এসে গেছে পরিবর্তন। কিন্তু চিনতে অসুবিধা হল না লুটেরাদের চেহারা। ততদিনে বাহ্যিক চেহারার পাশাপাশি এদের সামাজিক পরিচয়েও এসে গেছে স্বপ্নিল পরিবর্তন। কেউ শিল্পপতি, কেউ এমপি, কেই চেয়ারম্যান, কেউ আবার বিশিষ্ট ধর্ম প্রচারক হয়ে সমাজকে শাসন করছে, বনে গেছে সমাজপতি। কনফ্লিক্টের শুরুটা এখান হতেই। একজন লুটেরা শিল্পপতির সাথে শিল্প নিয়ে কথা বলার ক্ষুধা খুব তাড়াতাড়ি মিটে গেল। চোখের সামনে বেড়ে উঠা একজন খুনিকে রাজনৈতিক দলের বিশিষ্ট নেতা আর জনদরদি ভাবতে অস্বীকার করল আমার বিবেক। ৭৫০ টাকা বেতনের প্রকৌশলী ২০ লাখ টাকার বাড়িতে বাস করে যখন মসজিদের চাঁদা চাইতে আসে মনে হল জ্বালিয়ে দেই এ মসজিদ। অথচ বিদেশে বসে কত স্বপ্নই দেখেছিলাম দেশ নিয়ে। ওরা পিঁপড়ার মত দল বেধে আসতে থাকে। প্রথম কাতারে রাজনীতিবিদ, সাথে এমপি, চেয়ারম্যান, প্রশাসন, ছাত্রনেতা, যুবনেতা, একে একে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, ভূমি অফিস, সাংবাদিক, বিচারক, এমনকি গোরস্থান হতে মরা লাশ পর্যন্ত উঠে আসে। ওদের একটাই চাহিদা, টাকা। ’টাকা আমার চাই, নইলে জমি’, মিয়ার ব্যাটার সেই বিখ্যাত উক্তির মতই উক্তি হুমকি হয়ে পিছু নিল আমার। স্থানীয় আওয়ামী চেয়ারম্যানের ইশারায় হঠাৎ করেই বন্ধ করা হল শিল্প প্রতিষ্ঠানের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা। দাবি ৫ লাখ মাত্র। চেয়ারম্যানের স্বনামধন্য পিতা এক সময় আমাদের প্রতিষ্ঠানে চাকরী করতেন, দৈনন্দিন বাজার সদাই করতেন, বোধহয় সে জন্যেই নিজে আসতে দ্বিধা করলেন। কিন্তু একজন ঠিকই আসল চাঁদার দাবি নিয়ে। হয় টাকা, নয় শিল্প কারখানার মৃত্যু, সময়ের সাথে পছন্দের সীমানাও বেধে দেয়া হল। বিএনপির এমপি, তার চার স্ত্রী, সন্তানাদি গোটা বিশেক। প্রতিরাতে মদ খেতে হয়, তাই বিশাল খরচ। এসব খরচের রসদ যোগানো ব্যবসা বানিজ্যের ’পবিত্র’ দায়িত্ব। সবাই করছে, তাই আমাকেও করতে হবে। শুরু হল নতুন ফ্রন্টের লড়াই। পতনের শুরুটা এভাবেই। সকালে বিদ্যুৎ অফিসের বড় বস তো রাতে গ্যাসের বড় মাথা, দফায় দফায় ওসি আর এসপির ফোন, ক্রিকেট আর ব্যাডমিন্টন খেলার কনট্রিবিউশন চাইতে পঞ্চম শ্রেনী হতে দশম শ্রেনী ছাত্রদের ধর্ণা। ২০০ শ্রমিকের ভাগ্য নিয়ে খেলতে গিয়ে খুব তাড়াতাড়ি একা হয়ে গেলাম। কোন এক সুন্দর সকালে আবিষ্কার করলাম আমি অসুস্থ, রক্তের চাপ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
ঢাকা ছাড়ার আগে অস্ট্রেলিয়ান দূতাবাসে কখন দরখাস্তটা ফেলে এসেছি মনে ছিল না। তাই মাইগ্রেশন এপ্রুভালের চিঠিটা হাতে পেয়ে একটু অবাকই হয়েছিলাম। দস্তুরমত পালালাম দেশ হতে। চলে আসার ঠিক ৬ মাসের মাথায় বসে গেল আমাদের শিল্প প্রতিষ্ঠান। ২০০ শ্রমিকের ভাগ্য কবর রচিত হল জনদরদি আর গরীবের বন্ধু নেতা নেত্রীদের ঋতুস্রাবে।
এ আগুন পানি দিয়ে নেভানোর আগুন ছিলনা, এ ছিল প্রতিশোধের আগুন, যা তুসের মত জ্বলতে থাকে। পথের সন্ধানে ছিলাম এবং শেষ পর্যন্ত পেয়ে গেলাম সে পথ, ভার্চুয়াল পৃথিবী! ক্যালেন্ডারের পাতায় বোধহয় ১৯৯৮ সাল হবে তখন। নেটের দাবানল জ্বলতে শুরু করেছে কেবল। আমি তখন অষ্ট্রেলিয়ায়। খুঁজতে খুঁজতে সন্ধান পেলাম ই-মেলা নামের ভার্চুয়াল দুনিয়ার। বিখ্যাত জাকারিয়া স্বপন ভাই যুক্তরাষ্ট্র হতে শুরু করেছিলেন ব্লগীয় যাত্রা। লিখতে হত ইংরেজিতে। তাতে দমে না গিয়ে এ রাস্তায় পুরোদমে নেমে গেলাম ২০০১ সাল হতে। রাজনীতিবিদদের ব্যাক্তিগত পাপাচার, তাদের অযোগ্যতা, ব্যর্থতা আর পাশাপাশি দেশের মালিকানা নিয়ে দুই পরিবারের অন্যায় ও অবৈধ লড়াইয়ের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক ভাবে লিখে গেলাম বছরের পর বছর ধরে। ব্লগীয় শত্রু তৈরী হতে সময় নিল না। হাসিনা-খালেদা আর আওয়ামী বিএনপির বাইরেও পৃথিবী থাকতে পারে আমাদের পিএইচডিধারী অনেক শিক্ষিতের কাছেও তা অস্টম আশ্চর্য বলে মনে হল। শুরু হল আক্রমণ। এ আক্রমণ হতে মৃত মা-বাবাকেও রেহাই দেয়া হলনা। আমি থেমে যাইনি, কারণ এ সব লিখতে আমাকে বই পুস্তক পড়তে হয়নি, নিতে হয়নি মুনি ঋষিদের রেফারেন্স। রাজনৈ্তিক চামড়ার আড়ালে বাংলাদেশে কোন পশুরা বাস করে তাদের জন্মের সাথেই পরিচয় ছিল। ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে ২০১০ সালে ব্লগ যাত্রার পিছন দিকে তাকালে মনে হবে সার্থক হয়েছে আমার ক্ষুদ্র প্রয়াস। ব্লগে ব্লগে আজ প্রশ্ন উঠছে রাজনীতিবিদদের সততা আর যোগ্যতা নিয়ে। আমি নিশ্চিত, নেট আগুনের ছোয়া যেদিন বাংলাদেশের গ্রাম গঞ্জ পর্যন্ত পৌঁছে যাবে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে রাজনীতির মাঠে নেত্রীদের পারিবারিক ব্যবসা।
এ আমাদের দেশ। আমরা যুদ্ধ করেছি পাকিস্তানী সামরিক শক্তি ও তাদের নিয়ামক শক্তি ২২ পরিবার হতে মুক্তি পাওয়ার আশায়। আজ ২২ পরিবারের জায়গায় জগদ্দল পাথরের মত বুকে চেপে বসেছে দুই পরিবার আর তাদের পা চাটা কুকুরের দল। ক্ষমতার দাপট আর পদলেহনকারী কুত্তা বাহিনী লেলিয়ে মানুষের মুখ অনেকদিন আটকে রাখা গেছে, কিন্তু সে দিনে বোধহয় ভাটা লাগার সময় এখন। এ হিসাব আমার ব্যাক্তিগত হিসাব, রাজনীতিবিদদের সাথে যতদিন এর ফয়সালা না হবে আমি ওয়াচডগ ব্যবহার করে যাব আমার শেষ সুযোগ, ভার্চুয়াল সুযোগ।