এমনটাই ছিল মার্কিনিদের প্রত্যাশা, যাব, দেখব এবং জয় করব। কালো মহাদেশ আফ্রিকার ঘরে ঘরে তখন ক্ষুধার দামামা। একমুঠো আহারের সন্ধানে মানুষ হন্যে হয়ে চষে বেড়াচ্ছে বন-বাদর আর পাহাড় পর্বত। বৈরী প্রকৃতি, সাথে মনুষ্য সৃষ্টি হানাহানির বলি হয়ে যত্রতত্র প্রাণ হারাচ্ছে নারী, পুরুষ আর শিশুর দল। এমনই এক প্রেক্ষাপটে বিশ্ব বিবেকের প্রতিনিধিত্ব করার ম্যান্ডেট পায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। খাদ্য, পানি আর ঔষুধ নিয়ে ’Restore Hope’ মিশনের ছায়াতলে মার্কিন সেনাবাহিনী জল, স্থল আর অন্তরীক্ষ হতে অবতরণ করে অঞ্চলের অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ সোমালিয়ায়। আশা ছিল ভুক্তভোগি জনগণ কৃতজ্ঞতার ডালা দিয়ে বরণ করে নেবে উদ্ধারকারীদের। বাস্তবে ঘটল ঠিক তার বিপরীত। দেশটার বিবাদমান চার ওয়ারলর্ডদের একজন ফারাহ আইদিদের মিলিশিয়া স্বগোত্রীয় জনগণের সহায়তা নিয়ে প্রচন্ড প্রতিরোধ গড়ে তুলে মার্কিনীদের বিরুদ্ধে। হিউমেনিটারিয়ান মিশন রাতারাতি পরিণত হয় টোটাল ওয়ারফেয়ারে। ১৯৯৩ সালের ৩রা নভেম্বর শুরু হয় ‘Battle for Mogadishu‘ নামের চূড়ান্ত লড়াই। জেনারেল আইদিদের সামরিক শক্তি নিরূপণে ব্যর্থ হয় মার্কিন ইন্টেলিজেন্স, আর তার খেসারত দেয় ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার খুইয়ে। ’ব্ল্যাক হক ডাউন’ কেবল মুগাদিসু যুদ্ধের উপর নির্মিত হলিউডের ছায়াছবিই নয়, সামরিক শক্তি নিয়ে মার্কিনীদের আজন্ম দম্ভে এ ছিল প্রথম ধাক্কা। ’যাব, দেখব আর জয় করব’ গোছের মনোভাব ফেলে শেষ পর্যন্ত পিঠটান দিয়ে আফ্রিকার মাটি হতে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয় মার্কিনিরা।
চট্টগ্রামের বিদায়ী মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী এমন একটা মনোভাব নিয়েই হয়ত দিনটাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন, ’যাব, ভোট দেব আর দিনান্তে বিজয়ীর বেশে ঘরে ফিরব’। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ১৮টা মাস বাদ দিলে দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরীতে মেয়র মহিউদ্দিনের আধিপত্য ছিল প্রশ্নাতীত। পরপর তিন টার্মে নির্বাচিত হলে যে কারও মনেই বাসা বাধতে পারে ধারণাটা, ’আমি অজেয়, অপ্রতিরোধ্য’। চট্টগ্রামের জনগণ তাদের ’প্রিয়’ মেয়রকে প্রায় এক লাখ ভোটে পরাজিত করতে পারে চিন্তাটা বোধহয় ঘুণাক্ষরেও মাথায় আসেনি। তাই পরাজয়ের প্রাথমিক ধাক্কা সামলাতে সময় নিচ্ছেন রাজনীতির এই চৌকস খেলোয়ার। মুখ রক্ষার খাতিরে বলতে বাধ্য হয়েছেন, ’আমার নিশ্চিত বিজয় ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে‘। এতদিন জানতাম প্রশাসন সরকারের অংশ, এবং এই প্রশাসনকে দিয়ে হেন কাজ নেই যা সরকার করায় না। রাষ্ট্র ক্ষমতায় এখন মহিউদ্দিনের নিজের দল, অর্থাৎ, আজ্ঞাবহ দাস প্রশাসনের স্বয়ংক্রিয় প্রভু। তাহলে আমরা কি ধরে নেব কেন্দ্রের হুকুমে মহিউদ্দিনের বিজয়কে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে? দলের ভেতর দ্বিতীয় কেউ মাথাচাড়া দিয়ে উঠুক এমনটা পছন্দ নয়, শেখ হাসিনার এ ধরণের মনোভাবের সাথে কমবেশি সবাই পরিচিত। ঘাদানিক আর জাহানারা ইমামের নিরলস সংগ্রামের ফসল আজ সানন্দে ভোগ করলেও জীবিতাবস্থায় এদের প্রতি শেখা হাসিনার মনোভাব কি ছিল তা বের করতে আশাকরি ইতিহাসের খুব বেশি পাতা ঘাটতে হবে না। বক্তব্যের স্বপক্ষে উপস্থাপন করা যায় বিদায়ী মেয়রের নিজস্ব বক্তব্য। পরাজয়ের জন্য তিনি দায়ি করছেন নির্বাচন কমিশনকে। অথচ দলীয় নেত্রী সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছেন ঐ একই কমিশনকে। সমীকরণের কোথায় যেন কি একটা লুকানো আছে যা খালি চোখে দেখা যাচ্ছে না। সময়ই হয়ত এর জবাব দেবে।
অভিযুক্ত না করেও বলা যায়, বাংলাদেশের এমন কিছু এলাকা আছে যেখানে আঞ্চলিকতা চোখে পড়ার মত বড় একটা ফ্যাক্টর। চট্টগ্রাম, সিলেট আর নোয়াখালী তার মধ্যে অন্যতম। জাতীয় রাজনীতির বাইরেও এতদ্ অঞ্চলে এমন কিছু নিজস্ব ফ্যাক্টর আছে যা শুধু স্থানীয় ফ্যাক্টর হিসাবেই বিবেচিত হবে। চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচনে কি কি স্থানীয় ফ্যাক্টর কাজ করেছে তা এলাকায় বসবাস না করলে হয়ত কোনোদিনই জানা যাবে না। বাংলাদেশের নির্বাচনের এমনটাই ধারা; ক্ষমতাসীন ব্যক্তি অথবা দলকে দাঁড়িপাল্লায় দাড় করিয়ে তার বিচার করা। বলা চলে ’হ্যা’ ’না’ ভোটের গণভোট। চট্টগ্রামের ভোটে ভোটারগন ৬৫ কোটি টাকার ধনসম্পদের মালিক জনাব মঞ্জুরের জ্ঞানে গুনে বিমোহিত হয়ে বাক্স ভর্তি করে ভোট দিয়েছে এমনটা ভাবা হবে নিতান্তই বোকামি। বরং এ ভোট ছিল মেয়র মহিউদ্দিন ও তার দলকে বিচার করার ভোট। যারা সন্তুষ্ট তারা দিয়েছে ’হ্যা’ ভোট আর যারা না তারা দিয়েছে আনারসে ভোট।
বিজয়ী প্রার্থীর দলনেত্রী চট্টগ্রামবাসীদের অভিনন্দন জানিয়েছেন কথিত অন্যায়, অবিচার আর সন্ত্রাষের বিরুদ্ধে রায় দেয়ার জন্যে। তিনি বোধহয় একটা পক্ষকে ধন্যবাদ জানাতে ভুলে গেছেন, নির্বাচন কমিশন। কর্পোরেট মাফিয়া গংদের বিরুদ্ধে লড়াই করে কিছুটা হলেও স্বাতন্ত্র্য নিয়ে টিকে আছে বর্তমান নির্বাচন কমিশন। অন্তত গতকালের নির্বাচন তাই প্রমান করে। নেত্রী খালেদা জিয়া কখনোই বোধহয় ধন্যবাদের ফাঁদে পা দেবেন না, কারণ তা করতে গেলে বৈধতা দেয়া হবে ২০০৮’এর জাতীয় নির্বাচনকে। ক্ষমতার দেড় বছরে মাথায় আওয়ামী শাসনে অতিষ্ঠ জনগণ যদি তাদের রায় বদলাতে পারে তাহলে দেশনেত্রীর বুঝা উচিৎ ২০০৮ সালের নির্বাচনও ছিল জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসা বিএনপি কুশাসনের বিরুদ্ধে জনগণের সম্মিলিত রায়। ঐ নির্বাচন ছিল গুণধর পুত্রদের বিরুদ্ধে রায়, খাম্বা মামুনের বিরুদ্ধে রায়, অফিস পিয়নকে বিলিয়নিওর বানানোর রায়, ছাত্রদল আর যুবদল নামক হিংস্র হায়েনাদের বিরুদ্ধে রায়, বাংলা ভাইয়ের রায়, যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়ানোর রায়।
নির্বাচনে ব্যাপক রায় পাওয়া মানেই দেশের মালিকানা পাওয়ার ফ্রি লাইসেন্স নয়, চট্টগ্রাম মেয়র নির্বাচন নতুন করে তা প্রমান করে গেল। ছাত্রলীগ আর যুবলীগ নামের হিংস্র পশু জাতির পেছনে লেলিয়ে দিয়ে দেশ দখলের স্বপ্ন কোন বন্দরে হোচট খায় শেখ হাসিনার জন্যে চট্টগ্রাম নির্বাচন দারুন একটা উদাহরণ হয়ে থাকবে। দেখার বিষয়, আমাদের স্বশিক্ষিত আর কু শিক্ষিত নেত্রীরা কিভাবে অনুবাদ করেন চট্টগ্রাম নির্বাচনের ফলাফলকে।
মেয়র মহিউদ্দিনের পতন রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগের জন্যে ব্লাক হক ডাউন। সময় মত শিক্ষা না নিলে মার্কিনিদের মত পালাতে বাধ্য হবে দেশের মালিকানা দাবিদার এই ওয়ান-ওম্যান শো দলটি। যেহেতু জনাব মহিউদ্দিন এখন আর সিংহাসনে নেই, তাই এটাই বোধহয় মোক্ষম সময় পরাক্রমশালী ব্যক্তিটির X-File গুলো সচল করার। স্ত্রী খুন, বিদেশী ব্যাংক টাকা, থাইল্যান্ডে হোটেল ব্যবসা, দেশীয় ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা, টিভি চ্যানেল, বন্দর জিম্মি করে দাবি আদায় সহ বেশ কিছু অমিমাংসিত প্রশ্নের উত্তর চাওয়ার এটাই মনে হয় উপযুক্ত সময়।
৬৫ কোটি টাকার ধন সম্পদের মালিক জনাব মঞ্জুরকে স্বাগতম ক্ষমতার গরম সিটে। আশাকরি আগামী নির্বাচনের আগে তা ১৩০ কোটি পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হবে। গুডলাক।