বিল পরিশোধ হোক আর ক্রেডিট সংক্রান্ত সমস্যা হোক, যুক্তরাষ্ট্র হতে ১৮০০ নাম্বারে ডায়াল করলে প্রায়শই ফোনের অপর প্রান্ত হতে ভেসে আসে পরিচিত গলার আওয়াজ। তিতা মিঠা যাই হোক, পৃথিবীর এ অঞ্চলে বসবাসকারী সবাইকে কম বেশি এ অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়। বলছিলাম ভারত ও দেশটার বিদেশমুখী কলসেন্টার গুলোর কথা। ভারতীয়দের ইংরেজী উচ্চারণ নিয়ে এ দেশে (যুক্তরাষ্ট্র) অনেক ঠাট্টা তামাশা হয়, আলোচনা সমালোচনা হয়। উচ্চারণে ডিফেক্ট থাকলেও ব্যাকরণ আর ফ্লুয়েন্সিতে এদের সুনাম বিশ্বব্যাপী। বাংলায় একটা কথা আছে ’ভ্রমরে ভ্রমর চিনে‘। এ অর্থে কর্পোরেট দুনিয়াও ভারতকে চিনতে ভুল করেনি। আউটসোর্সিং আর ইনসোসিং’এর আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা পরলেও পশ্চিমা দুনিয়ায় ভারত বিরোধীদের সংখ্যা হাতে গোনার মধ্যেই সীমিত থাকবে। সিটি গ্রুপের মত কর্পোরেট জায়ান্ট কে সচল রাখতে যেমন ভারতীয় সিইওর দ্বারস্থ হতে হয়, তেমনি আমেরিকার নিভৃত অঞ্চলের গর্ভবতী মাকেও প্রয়োজনে সাহায্য নিতে হয় ভারতের ব্যাঙ্গালুরের। প্রশ্নটা অনেকের মত আমার মাথায়ও ঘুরপাক খায়, কেন বিক্রম পণ্ডিত, কেন ব্যাঙ্গালুর? আমাদের ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, রাজশাহী কি হতে পারত না এর বিকল্প?
এ নিয়ে জাতিকে বেশকিছু মেগা স্বপ্ন দেখিয়েছিল ১/১১ সরকার। কথা ছিল বাংলাদেশ হবে দুনিয়াব্যাপী আউটসোর্সিংয়ের অন্যতম প্রধান ঠিকানা। প্রাথমিকভাবে এ খাত হতে ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (যদি ভুল না হয় টাকার অংকে প্রায় ৪২,০০০ কোটি) আয়ের লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারণ করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল এ খাত পোশাক শিল্পকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশের জন্যে হয়ে দাঁড়াবে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। এ উদ্দেশ্য ৪২৬ টি কল সেন্টারের লাইসেন্সও ইস্যু করা হয়েছিল। হুম! স্বপ্ন বোধহয় শুধু দেখার জন্যেই, অন্তত বাংলাদেশের বেলায়। তা না হলে আজ কেন শুধু ৮৯ টা চালু থাকবে (বর্তমান আয় শতকরা ১ ভাগেরও কম)! এই ৮৯টির অবস্থাও না-কি তথৈবচ এবং যে কোন মুহূর্তে সমাহিত হওয়ার প্রহর গুনছে। স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝে যোজন যোজন মাইলের দূরত্বের মূল কারণ হিসাবে উল্লেখ করা হচ্ছে দক্ষ জনবল। এক কথায়, প্রয়োজনীয় ইংরেজী।
বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের ভালবাসা আক্ষরিক অর্থেই ঐশ্বরিক। এ নিয়ে কথা বলতে গেলে ঘাড়ের উপর গর্দান রাখা মুস্কিল হয়ে পরে। তবু দুএকটা কথা না বললেই নয়। দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যার প্রায় সবটাই সম্ভব হলে বিদেশ পাড়ি জামায়, এটা গোপন কোন তথ্য নয়। সবার পক্ষে সম্ভব না হলেও আমরা অনেকেই দেশ ছাড়ছি। দেশের বাইরে পা রাখতে গেলে যে সমস্যটা দৈন্যতা হয়ে আমাদের সামনে দাঁড়ায় তা আমাদের ইংরেজী জ্ঞান। ভাষা প্রেমের সমুদ্রে অবগাহন করতে গিয়ে আমরা হয়ত ভুলে যাই পেটের তাগিদে আমাদের বিদেশ পাড়ি দিতে হবে, দুনিয়ার সাথে ব্যবসা চালাতে হবে। আর এখানেই মার খাচ্ছি প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে। দেশে ৪২ হাজার কোটি টাকার কল সেন্টার ব্যবসা কল্পনাই থেকে যাবে যতদিন ইংরেজী নিয়ে আমরা সিরিয়াস না হচ্ছি। প্রতিবেশি দেশ ভারত এ খাতে বছরে ৬০ বিলিয়ন ডলার আয় করছে, যা দেশের জিডিপিতে অবদান রাখার পাশাপাশি বেকারত্বেও ভারসাম্য আনছে। মানব সম্পদ রফতানি বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম খাত। এ খাতে ইংরেজির জ্ঞান কতটা ভূমিকা রাখে তা কেবল ভুক্তভোগীরাই বলতে পারবেন। লাইসেন্স ইস্যু করে সরকার যদি ভেবে থাকেন কল সেন্টার খাত হতে হাজার হাজার কোটি টাকা আয় নিশ্চিত করা গেছে, তা দ্বিতীয় বার ভেবে দেখার অনুরোধ করব। এ ব্যবসা চালানোর মত ইংরেজী আমাদের দেশে চর্চা হয়না। বিপুল অংক ব্যায় করে যারা প্রাইভেট খাতে লেখাপড়া করে ইংরেজী শিখছে তারা কখনোই স্বল্প বেতনের কল সেন্টারে চাকরিতে আসবে না। এ জন্যে চাই ভাষাটার সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা ও প্রয়োজনীয় স্বীকৃতি। পরীক্ষা পাশের ইংরেজির সাথে দৈনন্দিন ইংরেজির কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে, যা দেশে চালু উপনিবেশবাদী ইংরেজির মাধ্যমে শিক্ষা দেয়া সম্ভব নয়। এর জন্যে চাই নতুন এপ্রোচ ও চাহিদার পরিপূরক প্রস্তুতি।
কল সেন্টার ব্যবসার প্রি-কন্ডিশন কেবল ভাল ইংরেজী তা বললে নিশ্চয় ভুল বলা হবে। সংশ্লিষ্ট দেশ গুলোতে আইনের শাসন, শ্রমের মর্যাদা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও বাধ্যতামূলক। আউটসোর্সিংয়ের জন্যে পশ্চিমা দুনিয়া এগুলোকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে থাকে। প্রস্তুতি নিশ্চিত না করে কল সেন্টার ব্যবসায় নামতে গেলে বাংলাদেশে তা পোশাক শিল্পের ভাগ্য বরণ করতে বাধ্য হবে। এখানে সোনার ডিম দেয়া হাঁসের মত জবাই হচ্ছে পোশাক শিল্প, সমুদ্র তলায় সাবমেরিন ক্যাবল কাটা হচ্ছে ব্যক্তি বিশেষের ব্যবসায়িক স্বার্থে। বাইরের দুনিয়ায় এসব কালো খবর আমরা না পৌঁছালেও আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বীরা পৌঁছাবে, এটা কর্পোরেট ব্যবসার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। এসবে বিদেশী ষড়যন্ত্রের গন্ধ খোঁজা হবে এক ধরনের আত্ম প্রতারণার শামিল।
সংকুচিত মানব সম্পদ রফতানি ও অস্থির পোশাক শিল্পের বিকল্প হতে পারে কল সেন্টার ব্যবসা। হয়ত পথ দুর্গম, কিন্তু ইচ্ছা থাকলে তা জয় করা অসম্ভব নয়। ৫৪ হাজার বর্গমাইল এলাকার দেশে ১৫ কোটি মানুষ, এই একটা বাস্তবতাই জাতি হিসাবে আমাদের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দিতে বাধ্য। টিকতে হলে আমাদের লড়তে হবে এবং এ লড়াই হতে হবে সময় ও চাহিদার পরিপূরক। পিতা, ঘোষক, যোদ্ধা আর রাজাকারের লড়াই ক্ষমতার পালাবদল নিশ্চিত করলেও ৪২ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা বানিজ্য নিশ্চিত করার জন্যে যথেষ্ট নয়। চাহিদা ও চাওয়া পাওয়ার প্রায়োরিটি গুলো আমাদের নিজেদেরই ঠিক করতে হবে। স্যার নিনিয়ান আর আবাবিল পাখিদের আশায় বসে থাকলে তা হবে অনন্তকালের অপেক্ষা।