ওরা আইনের লোক। রাষ্ট্র ও সমাজ কর্তৃক ছাড়পত্র দেয়া তাবৎ আইনের হেফাজতকারী ওরা। ওরা পুলিশ। বাংলাদেশী পুলিশ। বিশ্ব পুলিশ সমাজকে উচ্ছিষ্টতার কাতারে দাঁড় করালে দেশীয় পুলিশদের অবস্থান কত নাম্বারে ঠাঁই পাবে তা নির্ণয় করতে খুব একটা গবেষণার প্রয়োজন হবে বলে মন হয়না। রাজনীতিবিদদের মত ওরাও আপন মহিমায় ভাস্বর এবং এক নাগাড়ে বহুবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার যোগ্যতা রাখে। বলা চলে একে অপরের পরিপূরক। নড়বড়ে শরীর, কোটারা হতে আধা বেরিয়ে আসা চোখ, কাঁধে প্রাগৈতিহাসিক ৩০৩ রাইফেল আর চোখ মুখে অন্তহীন ক্ষুধা, দেশীয় পুলিশের এমন একটা ছবির সাথেই আমরা বেড়ে উঠি। ’হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না’ প্রচলিত এ প্রবাদবাক্যের আদলে বলা যায়, ’পুলিশ বদলায়, কিন্তু পুলিশের চরিত্র বদলায় না’।
কাহিনীটায় নতুনত্ব নেই। বাংলাদেশের জেলা-উপজেলা, শহর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জ আর পথে-প্রান্তরে প্রতিনিয়ত জন্ম নিচ্ছে এ কাহিনী। ফাঁক ফোকর গলে দু একটা মিডিয়াতে ঠাঁই পেলেও বেশিরভাগ চাপা পরে যাচ্ছে পুলিশ আর সাংবাদিকতার অবৈধ মিলনের ফসল হয়ে। ৪২ বছর বয়স্ক পরিবহন কর্মী মজিবর রহমানের লাশ পাওয়া গেল রাজধানীর তুরাগ নদীতে। কে বা কারা তাকে হত্যা করে ভাসিয়ে দিয়েছে বর্ষার ভরা নদীতে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নদীতে ভাসমান লাশ সপ্তাশ্চর্যের আশ্চর্য কোন বিষয় নয়। মানুষের জন্ম-মৃত্যু এ দেশে এক লিটার দুধের চাইতেও সস্তা, এক কাপ চায়ের চাইতেও সহজলভ্য। বাবা মজিবরের সাথে সাত বছরের পুত্র ইকবাল বাজারে গিয়েছিল ফুটবল কিনবে বলে। ছেলের বায়না মেটাতে মেলারটেক ঘাটে আসতেই পুলিশ ধরে নিয়ে যায় মজিবরকে। এলাকাবাসীর সামনে পুত্র ইকবালের বক্তব্য হুবহু তুলে ধরলেই হয়ত ফুটে উঠবে ঘটনার নির্মমতা। ‘ফুটবল কিনতে বাইরাইছি। ঘাটে আব্বুরে আইসা ধরছে ওরা। ছয়জন ছিল। হ্যান্ডকাপ পরাইছে। এরপর আব্বুরে ঘুষাইছে। লাইত্থাইছে, বুকের ওপর খ্যাচসে, পানিতে চুবাইছে। গলায় রশি বাইন্দা টানছে। বন্দুক দিয়াও মারছে। কইতাছিল ট্যাকা দে। আব্বু কয় ট্যাকা নাই। তারপর আব্বুরে নৌকায় উঠাইছে। আব্বু পানিতে পইড়া গেছিল। আমি ভয়ে দৌড় দিয়া নানা বাড়ি গেছি’। এরপর আর বাবার দেখা পায়নি ইকবাল। পরদিন তুরাগ নদীতে ভেসে উঠে পিতার লাশ।
মিরপুর পুলিশ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপকমিশনার মোহম্মদ জাহাঙ্গির আলম মজিবর রহমানের মৃত্যু নিয়ে সাত বছর বয়স্ক পুত্রের বক্তব্য খণ্ডাতে গিয়ে যা বললেন তাও হুবহু তুলে ধরলে কিছুটা হলেও ফুটে উঠবে আমাদের পুলিশ বাহিনীর শৌর্য বীর্য। ’সাত বছর হোক আর পাঁচ বছরই হোক, তার কথা বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। তারা ছোট থেকেই ক্রাইমের সংগে থাকতে থাকতে সে রকম হয়ে যায়’। তারা বলতে এখানে পুত্র ইকবালকে বুঝানো হয়েছে নিশ্চয়। উপকমিশনারের ভাষ্য বিশ্বাস করলে আমাদের মানতে হবে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ইকবালরা ক্রাইমের সাথে বেড়ে উঠে আর পুলিশ বাহিনী বেড়ে উঠে সততার নোনাজলে! হতে পারে বাস কাউন্টারের কর্মচারী মজিবর ক্রিমিনাল, হতে পারে সে মাদক বিক্রেতা। আমরা এমন একটা সমাজে বাস করি যেখানে প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী হতে শুরু সবাই চোর। এমন একটা সমাজ নিয়েই বাংলাদেশর বাস যেখানে অন্যায়, অবিচার আর অনাচারের অবাধ রাজত্ব। এমন সমাজে একজন মাদকসেবী আর মাদক ব্যবসায়ীর উত্থানের দায় দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্রকেই।
আমাদের পুলিশ সেই পুলিশ যারা পতিতার আচল হতে ১০ টাকা পর্যন্ত কেড়ে নেয় অধিকার ভেবে। তারা সেই পুলিশ যারা টাকার জন্যে ভিক্ষুককে পর্যন্ত হয়রানি করতে দ্বিধা করেনা। চাঁদাবাজির পাশাপাশি নিজেদের অস্ত্র পর্যন্ত ভাড়া খাটায় এসব বেজন্মার দল। নিজেরাই রক্ষক, নিজেরাই ভক্ষক, নিজেরাই বাদী আর বিবাদী সেজে সমাজকে নষ্ট করায় মূল ভূমিকা রাখে আমাদের পুলিশ বাহিনী। মজিবর হত্যার বিচার হয়ত কোনদিনই সম্ভব হবে না, কারণ বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর খুঁটির জোড় বেজায় শক্ত। কিন্তু এ নিয়ে কথা না বলা হবে আরও বেশি অন্যায়।