আবদুল মান্নান ভূঁইয়া। এক কালের পরাক্রমশালী এই মানুষটা এখন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। রুশ ভাষায় একটা প্রবাদ আছে, ’ইয়েসলি মোখাম্মেদ নে ইদয়ত ক গোরে তো গরা ইদয়ত ক মোখাম্মেদু’। অর্থাৎ, ’পাহাড়ের কাছে মোখাম্মদে না গেলে পাহাড় আসে মোখাম্মেদের কাছে’। একজন শক্তিশালী মানুষের ক্ষমতা বর্ণনা করার এসব ইউনিক শব্দ খুঁজলে পৃথিবীর অনেক ভাষাতেই পাওয়া যাবে। সময় ছিল যখন মান্নান ভূঁইয়া ছিলেন শক্তিশালী মোখাম্মেদের ভূমিকায় আর গোটা বাংলাদেশ ছিল পাহাড়ের আসনে। চাহিদা ও প্রয়োজনে আলীশান এই পাহাড়কে ও আসতে হত ভূঁইয়াদের দরবারে। মোখাম্মেদ আর পাহাড় খেলার সে দিনগুলো এখন সোনালী অতীত। মৃত্যু নামের মোখাম্মেদের কাছে প্রায় পরাজিত মান্নান ভূঁইয়া এখন উলটো পথের যাত্রী।
মান্নান ভূঁইয়া নামটার সাথে পরিচয় খুব ছোট বেলায়। অসুখ বিসুখে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে চড়ে সিংগাপুর আসা যাওয়া দূরে থাক, স্বদেশী ভাল ডাক্তারের কাছে যাওয়ারও সংগতি হয়নি তখন। যাপন করতেন মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীর সহজ সরল জীবন। চলতেন স্ত্রীর শিক্ষকতা ও টিউশনির পয়সায়। বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িত হওয়ার আগেই একজন ভাল মানুষ হিসাবে এলাকায় পরিচিত ছিলেন। বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন হয়ে মাওলানা ভাসানীর রাজনীতিতে যোগদান, রাজনীতির এ রোডম্যাপ মাড়িয়েছেন বাংলাদেশের অনেক বাঘা বাঘা নেতা, যাদের অনেকেরই শেষ ঠাঁই হয়েছে জেনারেল জিয়ার নষ্টামো কারখানা জাতীয়তাবাদী দলে। বিএনপিতে যোগ না দিলে মৃত্যু পথযাত্রী মান্নান ভূঁইয়ার নাম পত্রিকার শিরোনাম হত এমনটা ভাবারও কোন কারণ নেই। এ বিবেচনায় রাজনীতিবিদ মান্নান ভূঁইয়ার বিএনপি যাত্রা সফল বললে নিশ্চয় বাড়িয়ে বলা হবেনা।
রাজনীতির যাত্রা সফল হলেও সিংগাপুর হতে জীবনের শেষ যাত্রাটা মান্নান ভূঁইয়ার জন্যে কোন অর্থেই সফল বলা যাবে না। চিকিৎসা বিজ্ঞানের আধুনিকতম সুবিধা নিয়ে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা এয়ারপোর্ট পৌঁছালেন ঠিকই, ওখান হতে সামান্য পথ পেরিয়ে গন্তব্যস্থলে আসতেই প্রায় উড়ে যাচ্ছিল জীবন পাখি। যানজট ডিঙিয়ে বিজয় স্মরণীর কাছে আসতেই ফুরিয়ে যায় অক্সিজেন। লাগানো হয় দ্বিতীয় সিলিন্ডার। কিন্তু তাতেও ফুরায় না অপেক্ষার পালা। এক সময় ফুরিয়ে আসে অক্সিজেনের মজুত। শেষ পর্যন্ত ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকার সাহায্যে কোন রকমে পৌছাতে সক্ষম হন গন্তব্যস্থলে। একজন রাজনীতিবিদের জন্যে এর চাইতে বড় কোন ট্রাজেডি আছে কিনা জানা নেই। রাজনীতির মূল লক্ষ্যই হচ্ছে মানুষের বেচে থাকা সহ স্বাভাবিক জন্ম মৃত্যু নিশ্চিত করা। সিংগাপুর নামক দেশটায় তাই হচ্ছে, এবং মান্নান ভূঁইয়া সহ দেশের রাজনীতিবিদেরা এর সুবিধা নিতে উড়ে যাচ্ছেন চিকিৎসা সহ বিভিন্ন প্রয়োজনে। পার্থক্যটা এখানেই, জনগণের রাজনীতি আর পরিবার ভিত্তিক দাসত্বের রাজনীতি। লম্বা সময় ধরে জিয়া পরিবারের দুই ম্লেচ্ছ সন্তানের সুখ সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে গিয়ে একবারও কি মাথায় আসেনি দেশে আরও ১৪ কোটি ৯৯ লাখ ৯৯ হাজার ৯৯৯ জন মানুষ আছে যাদের চিকিৎসার প্রয়োজনে সিংগাপুর দূরে থাক ঢাকা শহরে যাওয়ার পর্যন্ত সামর্থ নেই? রাজপথের ট্রাফিক জ্যাম দেশের ব্যর্থ রাজনীতির ব্যর্থতারই ফসল। মান্নান ভূঁইয়াও এর দায় দায়িত্ব এড়াতে পারবেন না। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে টিকে থাকলেও নিজেদের তৈরী ব্যর্থতার গিলোটিনে নিজেই প্রাণ দিতে বসেছিলেন এই নেতা। রাজনৈতিক শিক্ষা বলতে কিছু থাকলে মান্নান ভূঁইয়ার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন হতে পারে তার ক্লাসিক উদাহরণ। ক্ষমতা নিয়ে দুই পরিবারের কামড়া কামড়িতে মান্নান ভূঁইয়ার মত এক কালের সহজ সরল রাজনীতিবিদ নেমে আসেন রাজপথে, ডেকে বসেন হরতাল, সন্ত্রাসের কাছে জিম্মি করে ১৫ কোটি মানুষের জীবন করে ফেলেন বিপর্যস্ত। মহান রাজনীতিবিদেরা হয়ত ভুলে যান বাংলাদেশের কোথাও না কোথাও, কেউ না কেউ বিনা চিকিৎসায় হরতালের কাছে জিম্মি হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে।
মৃত্যু পথযাত্রী মান্নান ভূঁইয়ার সমালোচনার জন্যে এ লেখা নয়। মনে প্রাণে কামনা করি সত্বর সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন স্বাভাবিক জীবনে। এ প্রসংগে একটা কথা না বললেই নয়। ইচ্ছা আর অনিচ্ছায় হোক এক কালের নিবেদিত এই নেতা অনেকদিন ধরেই স্বাভাবিক রাজনীতি হতে নির্বাসিত ছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক আমলে সংস্কার নামক গ্যাঁড়াকলে আটকে নেত্রীর রোষানলে পরে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন দল হতে। দুই পরিবারের তথাকথিত নেতা-নেত্রীর বিরুদ্ধে গিয়ে রাজনীতিতে টিকে থাকার দেশ বাংলাদেশ নয়। এখানে রাজনীতির প্রধান ও একমাত্র মন্ত্র হচ্ছে নেত্রী ও নেত্রী পরিবারের বাকি সবাইকে চিরস্থায়ী পুজা করা। মান্নান ভূঁইয়া শেষ কটা বছর এ পাপ হতে মুক্ত ছিলেন। সর্বশেষ খবরে প্রকাশ বহিষ্কৃত নেতাকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে দাসত্বের জিঞ্জির চিরস্থায়ী করতে রাজি হয়েছেন তথাকথিত নেত্রী। এ নিয়ে অনেকে ওকালতি করছেন নেতার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা হিসাবে। যে পাপ হতে মুক্ত হয়ে অনন্তকালের দিকে পা বাড়াচ্ছিলেন তিনি একই পাপ নতুন করে ঘাড়ে চাপিয়ে কার উপকার করতে চাইছে বিএনপি নামের লুটেরা দল তা ভেবে দেখার অনুরোধ করব ভূঁইয়া পরিবারকে।