পাঠক, আপনাদের কি হলিউড মুভি ’ব্রেইভ হার্ট’ দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল? না হয়ে থাকলে অনুরোধ করব ছবিটা দেখে নেয়ার জন্যে। হলিউড ফ্যাক্টরী হতে এ পর্যন্ত যতগুলো ভাল ছবি বের হয়েছে ’ব্রেইভ হার্ট’ তার মধ্যে অন্যতম। স্বীকৃতি হিসাবে ৬৮তম একাডেমি এওয়ার্ড অনুষ্ঠানে এ ছবির অভিনেতা ও নির্মান কৌসুলিদের ভাগ্যে জুটেছিল একাধিক পুরস্কার। মুক্তিকামী মানুষের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা আর আত্মত্যাগের মর্মস্পর্শী কাহিনী নিপুণ ভাবে ফুটে উঠেছে বিশাল ক্যানভাসের এ ছবিতে। প্রেক্ষাপট ১২৮০ খ্রীষ্টাব্দ। ইংরেজ রাজা প্রথম এডওয়ার্ডের দখলদার বাহিনীর অত্যাচারে জর্জরিত স্কটিশ জনগণ। প্রকৃতির লীলাভূমির দেশ স্কটল্যান্ডের নয়নাভিরাম পাহাড় পর্বতকে ঘিরে আবর্তিত হওয়া ইংরেজ তাড়ানোর লড়াই নিয়ে ছবির কাহিনী। নায়ক উইলিয়াম ওয়ালেসের প্রেম, ভালবাসা, বিয়ে, মুক্তিযুদ্ধ আর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এমন এক কালজয়ী ছবি আঁকা হয়েছে যা যুগ যুগ ধরে মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণা হয়ে বেঁচে থাকবে। http://www.youtube.com/watch?v=Ifr4aGA2o_A&feature=related
হতে পারত তা নতুন কোন কালজয়ী ছায়াছবির পারফেক্ট প্রেক্ষাপট। স্কটল্যান্ড হতে ফরিদপুর। হোক তা যোজন যোজন দূরত্বের দুটি দেশের কাহিনী। কিন্তু খুঁজলে কোথাও না কোথাও মিল পাওয়া যেত হয়ত। অন্তত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করার কৌশল সমকালের ফরিদপুরবাসী আর খ্রীষ্টাব্দ ১২৮০ সালের স্কটিশদের মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য হত বলে মনে হয়না। অন্তত উপরের ছবিটা তাই বলে। ঘটনা ঘটতে গিয়েও ঘটেনি উপর হতে হস্তক্ষেপের কারণে। কাজে কর্মে তিনি কোন দেশের বাদশাহ নন। অপকর্মের বাদশাহ বললে হয়ত বাড়িয়ে বলা হবেনা। ’মাটির টানে’ ফিরে যাচ্ছিলেন আপন শহর ফরিদপুরে। তিনি আর কেউ নন, সংসদ উপনেতা জনাবা সাজেদা চৌধুরীর পুত্র জনাব আকবর আয়েমন। ক্ষমতার ছত্রছায়ায় দেশের রাজনৈতিক পরিবারগুলোর জীবন কতটা চমকপ্রদ হয় এই আকবর বাদশাহ তার পৌরাণিক উদাহরণ। বনখেকো ওসমান গনির কথা আশাকরি পাঠকদের স্মৃতি হতে মুছে যায়নি। সেই ওসমান গনি যিনি লোটা কম্বল ছাড়াও অন্তর্বাসের ভেতর পর্যন্ত লুটের টাকা লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হতেন। মনে আছে আপনাদের? বনের গাছ আর মন্ত্রনালয়ের মানুষকে বদলির নামে এদিক সেদিক করে কম করে হলেও ৩০ কোটি টাকা পর্যন্ত কামিয়েছিলেন জনাব গনি। মন্ত্রনালয়ের সামান্য একজন কর্মকর্তার পক্ষে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে এত ধন-সম্পদের মালিক হওয়া সম্ভব এমনটা বোধহয় দেশের হদ্দ পাগলও বিশ্বাস করবে না। আসুন সে দিকটায় একটু চোখ ফেরাই। সাজেদা চৌধুরী তখন বন মন্ত্রনালয়ের ভগবান। ’বন-ভগবানের’ সৃস্টি পেয়ারের আদম আকবর বাদশাহর হাতে ধরেই উত্থান বনখেকো ওসমান গনীর। এমনটাই তিনি বলেছিলেন যৌথবাহিনীর ইন্টারোগেশন সেলে। সরকারী কোষাগার লুটপাটের ’গৌরবোজ্জ্বল’ উপাখ্যানের সাথে সাজেদা চৌধুরী নাম উচ্চারিত হয়না, কারণ তিনি এখন বিশাল এক বোয়াল মাছ, যা ধরতে গেলে বাংলাদেশের সমস্ত ছাই এক করলেও যথেষ্ট হবেনা। কিন্তু ধরা পরেছিল অন্য জন, যদিও তা ছিল কাগজে কলমে। আয়েমন বাদশাহ। যৌথবাহিনীর ডান্ডা ও ডিম্ব থেরাপি হতে বাচার জন্যে বাদশাহ চলে গিয়েছিলেন বনবাসে। রাক্ষস-খোক্কসদের রাজত্ব শেষে নতুন করে বুঝে নিয়েছিলেন আপন রাজত্ব। রাজা-বাদশার দল প্রজাদের দেখতে গ্রামে-গঞ্জে যায়, এটা নতুন কোন কাহিনী নয়। একই উদ্দেশ্যে আয়েমন বাদশাহও হয়ত রওয়ানা দিয়েছিলেন ফরিদপুরের উদ্দেশ্যে। বিধি বাম! ওখানে যে অন্য রাজার রাজত্ব! এঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেন! ফরিদপুরের এই উইলিয়াম ওয়ালেস এবং তার সহযোগীরা আগ বাড়িয়ে ঘোষনা দিয়েছিল, পীর আউলিয়ার শহর ফরিদপুরের মাটিতে চৌধুরী পরিবার অবাঞ্চিত। চৌধুরীদের আগমন ঠেকাতে ওয়ালেস বাহিনী মাঠে নামিয়ে দেয় হোম মেড অস্ত্র সহ ভুখানাংগা শহরবাসীকে। অমোঘ পরিণতি হতে শহরবাসীকে রক্ষা করেন সব ভগবানের আসল ভগবান জনাবা শেখ হাসিনা।
ছাত্রজীবনে নগুয়েন ঢিক থি ছিল আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন। জাতিতে ভিয়েতনামি। উত্তর-দক্ষিনে তখন যুদ্ধের দামামা। মার্কিন সৈন্য আর তাদের ন্যাপাম বোমায় জ্বলছে ভিয়েতনামের জনপদ। ভিয়েতনামের মাটি হতে মার্কিনীদের বিদায়ের পর অনেকে মনে করেছিল দুই তত্ত্বে বেড়ে উঠা দুই ভিয়েতনামের মধ্যে শুরু হবে গৃহযুদ্ধ। আজকের ভিয়েতনাম কি তাই বলে? যুদ্ধোত্তর ইউনাইটেড ভিয়েতনামে উত্তরের নগুয়েনদের অবাঞ্চিত করতে শোনা যায়নি দক্ষিণের নগুয়েনদের। ওরা আজ এক এবং দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে আবির্ভুত হতে চলছে। মার্কিন বাজারে ভিয়েতনামি পণ্যের প্রবেশ নিয়ে কেউ এখন হা হুতাশ করেনা, কারণ এমনটাই বর্তমান বিশ্বের চাহিদা। স্বাধীনতা এমনই একটা প্রাপ্তি যা জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মানুষকে এক করে তাদের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির লড়াইয়ের জন্যে। ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ আমাদেরও এক করেছিল কমন উদ্দেশ্যে। স্বাধীনতার ৩৯ বছরে আজ আমরা আওয়ামী-বিএনপি, মুক্তিযোদ্ধা-রাজাকার, আবাহনী-মোহামাডান, সাজেদা-মোশারফ, এ ধরণের হাজারো ধারায় ভক্ত বিভক্ত। শুধু ফরিদপুর কেন, আমরা একজন অন্যজনকে অবাঞ্চিত করছি লন্ডন, প্যারিস আর নিউ ইয়র্কের মত পরদেশের পর শহরে। আমাদের আভ্যন্তরীণ লড়াইকে আমরা বিক্রি করছি বাংলাদেশের ঘরে ঘরে, ছড়িয়ে দিচ্ছি পৃথিবীর দেশে দেশে। সাজেদা চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর বেয়াই মোশারফ হোসেনকে রাজাকার পরিবারের সদস্য বলায় মন্ত্রী বেজার। বাংলাদেশে বেজারের আরও একটা ভাষা আছে যার নাম শক্তি। শক্তি দিয়ে ব্যাক্তিগত সমীকরণ সমাধা করার যে সাংস্কৃতি আমাদের দেশে চালু হয়েছে তার প্রভাব কতটা সুদূর প্রসারী হবে তার কিছুটা হলেও নমুনা আমরা পেতে শুরু করেছি।
অনেকে বলবেন রাজনীতিতে মতপার্থক্য থাকতেই পারে। দ্বিমত নেই। কিন্তু ফরিদপুরের ঘটনায় মত পার্থক্যটা কোথায় তাই বুঝা গেলনা। এখানে কে উইলিয়াম ওয়ালেস আর কে লংস্যাঙ্ক কিং এডয়ার্ড তা আলাদা করার পরিস্কার কোন উপায় নেই। রাজাকার পরিবারের বেয়াই আর চোরাই পরিবারের রাজা-রানীদের লুটপাটের কাহিনীকে যদি দেশ শাসনের অংশ হিসাবে জাতিকে হজম করতে বলা হয় এবং আমরা তা যুগ যুগ ধরে হজম করতে থাকি আমি বলব জাতি হিসাবে আমাদের রক্তে পতনের পূজ প্রবাহিত হচ্ছে।
মনে আছে ব্রেইভ হার্টের শেষ এপিজোড টা? গিলোটিনে শুয়ে আছে উইলিয়াম ওয়ালেস। আকাশে উড়ছে খন্ড খন্ড মেঘ। জনতার ভিড়ে ওয়ালেস দেখতে পায় তার মৃত স্ত্রীকে। জানতে ইচ্ছে করে আমাদের নেতা-নেত্রী সেবকদের যখন ক্রসফায়ারের বধ্যভূমিতে নেয়া হয় কার ছবি তাদের সামনে আসে, স্ত্রী? পুত্র-কন্যা? পিতা-মাতা? না-কি নেতা নেত্রীদের?? সে যাই হোক , মেল গিবসনের তৈরী অবিস্মরণীয় ঐ ছবিটা দেখার জন্যে অনুরোধ রইল। কে জানে হয়ত ঐ ছবিতে লুকানো আছে আমাদের সব প্রশ্নের উত্তর।