অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ

Submitted by WatchDog on Wednesday, August 18, 2010

Photobucket

অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ। কথাটা আমার নয়, মুনি ঋষিদের। লেখার খাতিরে বিজ্ঞজনেরা লিখেন আর আমরা ম্যাংগো পিপলরা এর মুখোমুখি হই চড়া মূল্য দিতে। কে কাকে ভক্তি করবে এবং কতটা করবে তা একান্তই একজনের ব্যাক্তিগত ব্যাপার। এ নিয়ে ত্যানা পেঁচানোর পরিধি তাত্ত্বিক অর্থে সীমিত থাকার কথা। বাস্তবতা হল, তা সীমিত থাকে না, বিশেষ করে বাংলাদেশিদের বেলায়। পৃথিবীর গড় আবেগ উচ্ছ্বাসের তুলনায় আমাদের মাত্রাটা বোধহয় একটু বেশি। এর পেছনে জেনেটিকসের কোন কারণ থাকলে তা এ লাইনের বিশেষজ্ঞরাই ভাল বলতে পারবেন। তবে আমরা যারা মোটা মাথার ডাল-ভাতের বাংলাদেশী তাদের কাছে ব্যাপারটা বোধহয় রহস্য হয়েই থেকে যাবে। কোত্থেকে আসে এত আবেগ, প্রেম? ভালবাসা? সন্মান? শ্রদ্ধা অথবা কৃতজ্ঞতা?

১৫ই আগস্ট হতে আমাদের দূরত্ব এখন কেবল ঘন্টায়। সহস্রাব্দের সেরা বাঙালিকে হারানের ৩৫ বছরের শোক ঘন্টার ব্যবধানেই ভুলে যাবে এতটা অকৃতজ্ঞ জাতি নিশ্চয় বাংলাদেশিরা নয়। পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন আর সভা-সমিতির প্লাবনে একদিনের জন্যে হলেও থেমে গিয়েছিল দৈনন্দিন জীবন। শোকের ব্যাপ্তি এতটাই বিশাল ছিল যার প্রভাবে বাংলাদেশ পরিনত হয়েছিল মৃত্যুপুরীতে। মৃত্যুর ৩৪ বছর পর নিজের পিতাকে কজন স্মরণ করে তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু কোটি কোটি মানুষ মুজিব হত্যার শোক প্রকাশে সামান্যতম কার্পণ্য করেনি। অন্তত বাইরে হতে তাই মনে হতে পারে। তবে বাংলাদেশের মানুষকে যারা কাছ হতে জানে তাদের জন্যে এ দিনটা হতে পারে গবেষণার বিষয়, পিএইচডিতে থিসিস লেখার লোভনীয় উপাদান। আলোকিত পিঠের বিপরীতে চাঁদের আরও একটা পীঠ আছে যেমন আছে আমাদের সার্বজনীন শোকে। আসুন সে পিঠে কিছুটা সময় ব্যায় করে আসি। অন্ধগলিতে হাঁটাহাটি আমার লেখার অন্যতম প্রেরণা। অনেকেরই অপছন্দ হতে পারে, কিন্তু এমনটাই আমি। নামের কাছে আমার এ পছন্দ বিকিয়ে দেব এতটা আবেগি মানুষ আমি নই।

শেখ মুজিবের মত বিশাল একজনের চরিত্র হনন আমার লেখার উদ্দেশ্য নয়। এমন কাজে বাংলাদেশে লেখকের অভাব নেই। আমার কৌতুহল মূলত ১৫ই আগষ্টের শোক নিয়ে। ’কাঁদো বাঙালি কাঁদো’ - শোকের এমন হূদয়বিদারক আহ্বানে স্বদেশবাসী কতটা আন্তরিক লেখার প্রতিপাদ্য এটাই। সালটা মনে নেই তবে ঘটনাটা মনে আছে। নওগাঁ হতে ঢাকা ফিরছি বগুড়া হয়ে। শহরের কাছাকাছি আসতেই চোখে পড়ল পরিবর্তনটা। আকাশ দেখা যাচ্ছে না। চারদিকে মহা আয়োজন। ব্যানার আর তোরণের সমুদ্রে চাপা পড়ে গেছে মা বসুমতি। রাস্তার দুপাশে স্কুল ছাত্রীদের লম্বা লাইন। তাপমাত্রা প্রায় ৪০ ডিগ্রির কাছাকাছি। সবাই উদগ্রীব হয়ে তাকাচ্ছে ঢাকার দিকে। ব্যনারের ভাষা হতে জানা গেল তিনি আসছেন। তিনি আর কেউ নন, ওয়ান & ওনলি তারেক জিয়া। তোষামোদী সাহিত্যে বাংলা ভাষা এতটা উন্নত বগুড়ায় না আসলে বোধহয় জানা হত না। হাজার রকম শব্দে হরেক রকম স্তুতি। না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। যে বানী জনতার কাছে পৌছানো হচ্ছিল তা হল, ’হাসো বাঙালি হাসো, তিনি আসছেন’। তারেক জিয়ার বগুড়া অভিযানে কার মুখে শেষ হাসি ফুটেছিল তার গভীরে যাওয়ার আগে বলে নেই আমার সহযাত্রী ২ শিশু আর ১ বৃদ্ধা বাসের ভেতর মলমূত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তোষামোদী সাহিত্যের অন্তিমে কোথাও না কোথাও উল্লেখ থাকে এসবের আসল তরিকা, স্পনসরের নাম। আনন্দ আর শোকের চাইতেও নাকি বড় এই নাম। এমনটাই আমাকে বুঝিয়েছিলেন সহযাত্রী একজন। কে কতটা গভীরতা নিয়ে তোষামোদি করল এর উপর নাকি নির্ভর করে অনেক কিছু। সংসদ, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় নমিনেশন পাওয়ার প্রাথমিক ক্রাইটেরিয়া এই তোষামোদী। টেন্ডার বাণিজ্যও নাকি এর বাইরে নয়। এই এরাই হাসে শোক দিবসের শেষ হাসি।

শোক মানে শক্তি। এমনটাই জেনে এসেছি ছোটকাল হতে। শেখ মুজিবের শোক আমাদের শোকাতুর জাতির জন্যে কতটা শক্তি নিয়ে আসতে পারে তার ২/১টা উদাহরণ দিলেই বেরিয়ে আসবে এর রহস্যঃ

- শোক দিবস পালন করতে গিয়ে রংপুর মেডিকেল হাসপাতাল বিএমএ দু’গ্রুপের মারামারি। খবরে প্রকাশ, এক গ্রুপের উপর হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও শহীদ মিনারে পুস্পমাল্য অর্পন করতে যায়। বাংলাদেশের বেলায় যা স্বাভাবিক তাই হল এ যাত্রায়, ঝাপিয়ে পড়ল প্রতিপক্ষের উপর। রক্ত ঝরিয়ে বাস্তবায়ন করল হাইকোর্টের রায়, সন্মান দেখাল শোক দিবসের প্রতি।

- যশোরের শর্শা থানার সাংসদ শেখ আফিল উদ্দিন থানার ওসিকে পিটিয়ে এলাকা ছাড়া করার হুমকি দিলেন। খুনের মামলায় সাংসদের অনুমতি না নেয়ায় এই হামলা।

- শোক দিবসের ছুটি না পেয়ে গাজীপুরের পোশাক তৈরীর কারখানায় ব্যাপক ভাংচুর।

শোক কি শুধু বাগাড়ম্বরতা? গলাবাজি? মাজারে ফুল দেয়া? ব্যানারে ফেস্টুনে আকাশ ঢেকে দেয়া? যদি তাই হয় তবে এবারের ১৫ই আগস্টের শোক ছিল পৃথিবীর অন্যতম সফল শোক পালন। গোটা জাতির কথা না হয় বাদ দিলাম, অন্তত এ মাসটায় কি আওয়ামী সেনারা পারত না কথা ও কাজের বৈপরীত্য পরিহার করতে? গোটা আগস্ট মাসকে ঘোষনা দেয়া হয়েছে শোকের মাস হিসাবে। মাস জুড়ে জাতিকে কাঁদার আহ্বান জানিয়ে নিজেরা কাঁদা দূরে থাক, বরং কাঁদতে বাধ্য করানো হয়েছে স্বামীহারা স্ত্রীকে, সন্তানহারা মাকে। এটাই কি তাহলে আমাদের আসল চরিত্র? তা হলে শোক নিয়ে আর মাতম কেন? নাকি জাতিকে বিভ্রান্ত করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার নতুন মন্ত্র এই ভুবন মাতানো শোক? ’অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ’ - এটা বোধহয় আমাদের রক্তে মিশে আছে।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন