পাঠক, পেপ্পি কেভিনিয়ামি নামের একজন ভিনদেশি মহিলার কথা কি মনে আছে আপনাদের? নামটা যাদের কাছে অপরিচিত তাদের একটু ধৈর্য্য ধরার অনুরোধ করব। এই ফাঁকে একটা খবর বলে নেই, এ যাত্রায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন না এই মহিলা। তন্নতন্ন করে খুঁজলাম কিন্তু পেলাম না। ১০১ জনের তালিকায় ঠাঁই হয়নি এ যাত্রায়। কারণ ছাড়াই মনটা খারাপ হয়ে গেল। বাংলায় একটা কথা আছে, বন্যরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃ ক্রোড়ে। সদ্য জন্ম নেয়া শিশুকে যেমন মায়ের কোলে বেশি মানায় তেমনি পেপ্পিকেও চমৎকার মানায় দেশীয় মিছিলে। আফটার অল রাজতন্ত্রের তিনিও যে উত্তরাধিকারীনি! গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকব দেশের বিচার ব্যবস্থার দিকে। আশা করব অনেক কিছুর মত ভদ্রমহিলার প্রতি এই অকাল বৈষম্যও হাল্কাভাবে নেবেন না ’মহামান্য’ বিচারকগণ। এবার আসছি তাদের কাছে যারা কেভিনিয়ামি নাম নিয়ে ত্যানা প্যাঁচানো শুরু করে দিয়েছেন ইতিমধ্যে। জাতিতে ফিন, অর্থাৎ ফিনল্যান্ডের বাসিন্দা। প্রাসঙ্গিক ভাবে একটা কথা বলে রাখা ভাল, বাংলাদেশ যদি চুরি-চামারিতে পর পর চার বার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে জাতির মুখ ’উজ্বল’ করে থাকে, ফিনল্যান্ড নামের দেশটাও অচুরি-অচামারি প্রতিযোগীতায় অনাদিকাল ধরে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফিন জাতিকে গভীর হতাশায় ডোবাচ্ছে। যেভাবেই দেখি না কেন, তালিকার দুই মেরুতে অবস্থান আমাদের। ব্যাক্তিগত ও পারিবারিক পকেট পূর্তির টেকনোলজিতে আমাদের অবস্থান বিপরীত মেরুতে হলেও হৃদয়ঘটিত ব্যাপারে এসব যে খুব একটা সমস্যা তৈরী করেনা তার প্রমাণ এই পেপ্পি। হ্যা, পেপ্পি কেভিনিয়ামি ব্রিটেন প্রবাসি বাংলাদেশি নাগরিক (নাকি বৃটিশ!) রেদোয়ান সিদ্দিকের স্ত্রী। জনাব সিদ্দিকের আরও একটা পরিচয় আছে, উনি যেন তেন বাংলাদেশি নন, দেশীয় সিংহাসনের সেকেন্ড ইন কমান্ড জনাবা শেখ রেহানার সন্তান। রেহানার সন্তান ফিনিশ না নাইজেরিয়ান ললনা বিয়ে করবে এ নিয়ে আমার মত হাভাতে জনগণের মাথা ঘামানোর কথা নয়। আসছি সে প্রসংগে।
১০১ জন সহযাত্রী নিয়ে নিউ ইয়র্ক যাচ্ছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। উদ্দেশ্য জাতিসংঘের ৬৫তম সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ। ১০১ জনের মধ্যে যেমন আছেন কবি-সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ তেমনি আছেন প্রফেশনাল খুনি। তবে এদের সবাইকে যে জাতিসংঘ ভবনে যেতে হবে তার কোন বাধ্য বাধকতা নেই। নেত্রীর পূজার প্রতিদান, এভাবেই বর্ণনা করলেন পরিচিত এক আওয়ামী নেতা। এক বন্ধু ফোন করে জানাল তার শ্বশুর বাড়ির কেউ একজন আসছেন প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে। আমেরিকায় নাকি এই প্রথম, তাই যথাযোগ্য আয়োজনের অনুরোধ করেছেন। আমি নিশ্চিত যারা আসছেন তাদের সবারই কেউ না কেউ আছেন এ দেশে এবং অতিথি আপ্যায়নে ত্রুটি করবে না প্রবাসী বাংলাদেশিরা। একই কাজে খালেদা জিয়া শেষবার যখন নিউ ইয়র্ক এসেছিলেন খুব কাছ হতে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল নেত্রীর সফরসূচির কিয়দংশ। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বাহিনীর এক ক্যাপ্টেন ছিল আমার আত্মীয়। এখানে এসেই বায়না ধরল শহর দেখানোর জন্যে। কথা ছিল নেত্রীর ভাষণ পর্ব সমাপ্তির রাতে ঘুরতে বের হব। আরও দুই বন্ধু সহ নির্ধারিত সময়ে হাজির হলাম হোটেলে। হোটেল লবিতেই চোখে পরল দৃশ্যটা। শত শত স্বদেশি চীৎকার করছে, হাতাহাতি করছে, ঠেলাঠেলি করছে। স্থানীয় পুলিশ বাহিনীও ব্যর্থ হচ্ছে জনতার ঢল সামাল দিতে। সবার গন্তব্য নেত্রীর কক্ষ। কথা ছিল রাত ১১টার দিকে বেরিয়ে পরব আমরা। কিন্তু সকাল ১টার দিকেও লাইন কমার কোন লক্ষন দেখা গেলনা। নেত্রীর রুমের ঠিক ২টা রুম পর আমরা তিন জন অপেক্ষায় আছি, অপেক্ষা করছি আর মাথার চুল ছিঁড়ছি। আত্মীয় নিজেও বিব্রত। চীৎকার শুনে রুমের বাইরে আসতেই চোখে পরল দৃশ্যটা, নিরাপত্তা বাহিনীর সবাই মিলে বেধড়ক পেটাচ্ছে অপেক্ষমান জনতাকে। জনতাও কম যায়না, তারও প্রতিরোধ করছে এবং উচ্চস্বরে শ্লোগান দিচ্ছে। পাঁচতারা হোটলে মধ্যরাতে এমন এক দৃশ্যের অবতারণা হল যা ঠেকাতে কর্তৃপক্ষ NYPD তলব করতে বাধ্য হল। রাত একটার দিকে আত্মীয় এসে জানাল জনৈক ভিজিটর প্রধানমন্ত্রীর পা জড়িয়ে কান্নাকাটি করছে, কোনভাবেই সড়ানো যাচ্ছে না। রাত দুটার দিকে শেষ হল এ সার্কাস। আত্মীয় এসে জানাল প্রধানমন্ত্রী এখন ফ্রি, চাইলে আমরা দেখা করতে পারি। খালেদা জিয়াকে দেখা অথবা তার সাথে কথা বলার কারণ খুঁজে পেলাম না। আত্মীয়কে জানাতে সে একটু অবাক হল। শেষ পর্যন্ত তিনটার দিকে বের হলাম আমরা। পরদিন জ্যাকসন হাইটসে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে সভা হল, শ্লোগান দিল।
একটা ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী প্রশংসার দাবি রাখেন, ১২৪ জন সহযাত্রী নেন নি এ যাত্রায় যেমনটা নিয়েছিলেন ভারত সফরের সময়। এ হিসাবে বেশকিছু অর্থ বাচিয়ে অসীম যোগ্যতার প্রমান দিলেন তিনি। ঐতিহাসিক ভারত সফরে প্রধানমন্ত্রীর সংগী হয়েছিলেন যারা তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বোন রেহানা, পুত্র জয় ওয়াজেদ, পুত্রবধু ক্রিষ্টিনা ওভেরমায়ের, নাতনি সুফিয়া জয়, ভাগ্নি আজমিনা সিদ্দিক, ভাগ্নে রেদওয়ান সিদ্দিক এবং অবশ্যই ভাগ্নে বৌ পেপ্পি কেভিনিয়ামি। জাতিসংঘে বাংলাদেশের কেস তুলে ধরার জন্যে এ যাত্রায় প্রধানমন্ত্রীর সহযোগী হয়েছেন শেখ রেহানা, জয় ওয়াজেদ, ক্রিস্টিনা জয়, খন্দকার মনসুর হোসেন (রাজাকারের দৌহিত্র), কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এবং ভাগ্নি আজমিনা সিদ্দিক সহ আরও ৯৫ জন। প্রধানমন্ত্রীর নাতনি নাবালিকা সুফিয়া এবং ভাগ্নে বৌ ফিনল্যান্ডের নাগরিক পেপ্পিকে কেন বাদ দেয়া হল তার কোন কারণ প্রকাশ করেনি প্রধানমন্ত্রীর দফতর। আওয়ামী ঘরানার জনৈক নেতার সাথে কথা বলে জানা গেল শেখ ডাইনাস্টির পরবর্তী নেতা হিসাবে প্রধানমন্ত্রী আপন কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে সামনে আনতে চাইছেন। রাজাকার পরিবারের গৃহবধূ সায়মা ওয়াজেদ নাকি বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের চিন্তা করছেন এবং হাতে কলমে প্রধামমন্ত্রীত্বের তালিম নেয়ার জন্যে তৈরী হচ্ছেন।
প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাচ্ছি মার্কিন মুলুকে। আর যারা নেত্রী পুজার ঢালি সাজিয়ে ইতিমধ্যে ধ্যানে বসে গেছেন তাদের তলপেট বরাবর কষে একটা লাথি রইল। প্রধানমন্ত্রী আসছেন পরিবার নিয়ে বনভোজন করতে। এ ধরনের বনভোজনে অনাহূত অতিথির অত্যাচার কতটা বিরক্তিকর হতে পারে তা আশাকরি নিউ নিউইয়র্কবাসীদের নতুন করে বুঝাতে হবেনা। আফটার অল নিউ ইয়র্ক বনভোজনের শহর। আর যারা সুফিয়া জয় ও পেপ্পি কেভিনিয়ামিকে সহযাত্রী বহরে না দেখে আমার মত কষ্ট পেয়েছেন তাদের জন্যে খবর হল, এটা নিশ্চয় শেষ সফর নয়! ১০০ বছর পরে আছে সামনে।