ভূমিকাঃ
শুধু ভ্রমণ কাহিনী বললে সম্পূর্ণ হবেনা লেখাটার মূল্যায়ন। প্রকৃতি উপভোগের অপর নাম যদি ভ্রমণ হয় নিশ্চয় বেরিয়ে এসেছি সে মানসিকতা হতে। বয়স বাড়ার সাথে মনের চাহিদা যেমন পূর্ণতা লাভ করে তেমনি অতি ভ্রমণও ভ্রমণ সংজ্ঞায় আনে গুনগত পরিবর্তন। ১৯ বছর বয়সে সাইবেরিয়ার গহীন জঙ্গলকে যেভাবে দেখেছি নতুন করে ওখানটায় ফিরে গেলে নিশ্চয় অনেক কিছু অদেখা অচেনা মনে হবে। প্রকৃতির সাথে মানুষের যে চিরন্তন লড়াই তা দেখতে আমাকে আবারও হয়ত যেতে হবে নাওগাঁ জেলার পত্নীতলায়। একটা বছর কাটিয়েছি বরেন্দ্র এলাকায়, অথচ ধানী জমি ও সেচ ব্যবস্থার বাইরে চোখ ফেরানোর তাগাদা অনুভব করিনি। মাতৃভূমিকে জানতে, এর জীবনকে কাছ হতে দেখতে এক পত্নীতলাই ছিল যথেষ্ট, অথচ কাজে লাগাতে পারিনি সে সুযোগ। এর জন্যে কাউকে দায়ি করলে তা হবে বয়স এবং সময়।
লেখার মুল প্রসংগে যাওয়ার আগে কিছু ব্যাক্তিগত তথ্য না দিলে খাপছাড়া মনে হতে পারে এর ঘটনা প্রবাহ। ’এন্ডিস পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে‘, ১৬ খন্ডের এই আলিশান ভ্রমণ কাহিনী যাদের গেলাতে সক্ষম হয়েছি তাদের জানা থাকার কথা হবু গিন্নির সাথে আমার পরিচয় পর্বের ইতিবৃত্ত। পেরুর রাজধানী লিমাতে পরিচয়। প্রেম, ভালবাসা আর বিয়ে পর্ব শেষে সংসার নামক জটিলতায় ঢুকার আগে আমাদের ভ্রমণ তালিকায় লেখা হয়ে যায় এন্ডিসের অনেক নতুন চুড়া, অষ্টম আশ্চর্যের মাচুপিচু, ইকুয়েডরের কিটো, কলম্বিয়ার বোগোটা, বারাংকিয়া, বলিভিয়ার লা পাস সহ দক্ষিন আমেরিকার অনেক শহর বন্দরের নাম। সে যাত্রায় আমাদের গন্তব্য ছিল পেরুর আমাজন। কথা ছিল নদীতে নৌকা ভাসিয়ে আমাজন দেখব অনেকটা অ্যানাকোন্ডা ছবির মত। কিন্তু বাধ সাধল গিন্নির নানীর অসুস্থতা। ’সাইয়াং’ নামক ছোট একটা শহরে যেতে হবে। ওখানেই আছে অসুস্থ নানী। লেখাটা মূলত এই অনিচ্ছাকৃত ভ্রমণের উপর।
রাজধানী লিমা হতে প্রায় ৩০০ কিলোমিটারের পথ। ঘন্টার হিসাবে ৭ ঘন্টার যাত্রা। লিমা হতে এর আগেও বাস জার্নি করেছি। পেরুর রাস্তাঘাট হেলাফেলার মত কিছু নয়, তাই ৩০০ কিঃ মিঃ পথ পাড়ি দিতে সাত ঘন্টা লাগবে শুনে বেশ অবাক হলাম। গিন্নী ধরতে পারল আমার সন্দেহ। ’ এ অন্য এক পেরু, সভ্যতার খুব একটা ছোয়া লাগেনি দেশটার এ প্রান্তে। সাত ঘন্টায় পৌছাতে পারলে নিজেদের ভাগ্যবান মনে করব।’ - কথাগুলো শুনে কিছুটা নিরাশ হলেও উৎসাহিত হলাম বৈচিত্রতার কথা ভেবে। রাজী হয়ে গেলাম কথা না বাড়িয়ে। ’ উচ্চতার সমস্যা থাকলে তোমার বোধহয় না যাওয়াই ভাল’। ভয়ের চাইতে অবাক হলাম কথাটা শুনে । এর আগেও উচ্চতা অতিক্রম করেছি আমরা, এ নিয়ে কথা উঠেনি কখনও। গিন্নির কথায় বুঝা গেল নতুন এক শৃঙ্গ পদানত করতে যাচ্ছি এ যাত্রায়। ইনকা সভ্যতার লীলাভূমি মাচুপিচুকেই ভেবেছিলাম উচ্চতার শেষ সীমা, অন্তত আমার জন্যে। এন্ডিসের নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের পাশাপাশি এর কঠিন রুক্ষ্মতার কথাও অজানা ছিলনা। ১৯৭২’এ উরুগুয়ের বিমান দুর্ঘটনা এবং টানা ৭২ দিন ক্ষুধা আর এন্ডিসের বৈরী আবহাওয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করে ফিরে আসা ১২ জন যাত্রীর মর্মস্পর্শী কাহিনী কিছুটা হলেও ধারণা দিয়েছিল চাঁদের অন্য পিঠের। সুক্ষ্ম এক ধরনের ভয় চেপে বসল মনে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তা চেপে গেলাম।
শুকনো খাবার, ফলমুল আর পানির বহর দেখে ভড়কে গেলাম। মনে হল অনন্তকালের যাত্রায় রওয়ানা হচ্ছি আমরা। কারণ জিজ্ঞেস করতে গিন্নী মুচকি হাসল। যা বুঝার তা বুঝে নিতে বাধ্য হলাম। পেরুর সীমান্ত শহর পুনো হয়ে বলিভিয়ার যাওয়ার পথে যে ভুল করেছিলাম তা মনে হওয়ায় বুঝে গেলাম হাসির অর্থ। সান্ত্বনা দিলাম নিজকে, এ যাত্রায় একা নই আমি। কথামত সকাল ৬টায় হাজির হলাম ’এস্ত্রেইয়া পোলার’ বাস স্ট্যান্ডে। দূরপাল্লার বাস গুলো ছেড়ে যাওয়ার সময়, তাই যাত্রীদের উপচেপড়া ভীড় দেখে অবাক হলমা না। নজর কাড়ার মত চেহারা বাসগুলোর। আধুনিক ভোগ বিলাসের উপাদান সহ এর বাড়তি আকর্ষণ সুন্দরী গাইড। তেমন একটা বাসের দিকে রওয়ানা হতেই গিন্নী বাধ সাধল। ’বিলাস বহুল দ্বিতল বাস আর যাই পারুক এন্ডিসের চূড়া ডিঙাতে সক্ষম নয়’, কড়া মন্তব্যে বাস্তবতায় ফিরে আসতে বাধ্য আসলাম। এমন একটা সম্ভবনা মথায় ঢুকতে দেরী হওয়ার নিজের কাছেই নিজেকে বোকা মনে হল। বিধ্বস্ত চেহারার লক্কর ঝক্কর মার্কা বাসের দিকে আঙুল উঠাতে রক্ত হিম হয়ে এল। এ ধরনের একটা বাসে চড়ে ৬-৭ ঘন্টার এন্ডিস যাত্রা শুধু অসম্ভব নয়, ভয়াবহ বিপদজনক মনে হল। গিন্নী অভয় দিল। দেখতে খারাপ হলেও বাসগুলো নাকি পাহাড়ে উঠার জন্যে বিশেষভাবে তৈরী।
যদিও বসন্তেরর শুরু কিন্তু শীতের খোলসা হতে বেরিয়ে আসতে পারেনি দক্ষিন আমেরিকার এ অঞ্চল। ঘন কুয়াশার নীচে চাপা পরে আছে রাজধানী লিমা। শহরকে ঘিরে থাকা এন্ডিসের কোল জুড়ে বিশ্রাম নিচ্ছে খন্ড খন্ড মেঘ। সবকিছুতে কেমন একটা আলস্য ভাব। বাস স্ট্যান্ডের কোলাহল ছাড়া যতদূর চোখ যায় কেবল শুনশান নীরবতা। রাস্তার বাতি আর দুএকটা বেওয়ারিশ কুকুরের চলাফেরা ছাড়া জীবনের কোন ছন্দ নেই শহরে। পরিচয় না থাকলে মৃত্যুপুরি বলে ভুল হতে পারে। গিন্নী নিজেই প্রস্তাব দিল জানালার পাশের সীট। এ পথে আনাগোনার অভিজ্ঞতা নাকি তার অনেকদিনের, তাই সীট নিয়ে তর্কে গেলনা। সবকিছু ঠিকঠাক। কিন্তু বাস ছাড়ার কোন লক্ষন দেখা গেলনা। প্রশ্ন করে জানা গেল কুয়াশার ঘন আস্তরণ ধেয়ে আসছে এন্ডিসের বুক হতে। অপেক্ষা করতে হবে ডিজ্যাবিলিটি আশাব্যঞ্জক না হওয়া পর্যন্ত। পনের মিনিটের ভেতর ঢেকে গেল চারদিক। এ যেন মুভিতে দেখা মরু ঝড়ের মত। দরজা জানালা বন্ধ করে শীতের পোশাক টেনেটুনে ঘাপটি মেরে বসে রইল যাত্রীরা। পনের মিনিট চলল এ অবস্থা। হরর মুভি কায়দায় ভোজবাজির মত মিলিয়ে গেল কুয়াশার সমুদ্র। জানালায় চোখ রাখতে দিগন্ত রেখায় ভেসে উঠল এন্ডিসের চূড়াগুলো। জেগে উঠছে ওরা। কুয়াশা আর মেঘের ফাঁক গলে সূর্যের দেখা মিলল অবশেষে। অবশ্য এটাকে পরিপূর্ণ সূর্য বললে হয়ত ভুলই বলা হবে। এ শহরে শীতকালের সূর্যটায় কোন আলো থাকে না, থাকে না তীব্রতার রাজত্ব। কুয়াশার কাছে পরাস্ত হয়ে বসন্তের সূর্যও লুকিয়ে থাকতে বাধ্য হয় এন্ডিসের আড়ালে।
রওয়ানা হতে সাতটা বেজে গেল প্রায়। ততক্ষণে রাস্তার কোলাহল বাড়তে শুরু করেছে। শীতের পুরু পোশাক আর মাথায় আলপাকার টুপিতে ঢাকা চেনার উপায় নেই কাউকে। নতুন একটা দিনের শুরুতে জেগে উঠছে জনপদ। ভাল লাগল কিছুক্ষণের জন্যে হলেও ব্যস্ত নগরীর জনশূন্যতা উপভোগ করতে। এন্ডিস আর প্রশান্ত মহাসাগরের বুক চিড়ে বেরুতে হয় শহর হতে। লিমার এ দৃশ্য বার বার দেখলেও মন ভরতে চায়না। এখানেও কুয়াশার একছত্র আধিপত্য। মাছ ধরার ট্রলারগুলোর মাস্তুলে ঝুলে থাকা বাতি খুব কাছ হতে না দেখলে মনে হবে ভুতুড়ে কোন কিছু। মধ্যদুপুরে দেখলেও এ দেখায় বিশেষ কোন হেরফের হয়না। গ্রীষ্মে ট্যুরিস্টদের ভীড় আর সমুদ্রগামী জাহাজের আনাগোনায় বদলে যায় প্রশান্ত মহাসাগরের চেহারা। শীতে দেখলে তা অকল্পনীয় বলেই মনে হবে।
রক্তের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা ভ্রমণ দৈত্যটার আওয়াজ শুনতে পেয়ে নড়েচড়ে বসলাম। এন্ডিসের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য আর বিচিত্র অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছে সামনে এমন একটা বক্তব্যই আশা করছিলাম গিন্নির মুখ হতে। কিন্তু যা শুনলাম তাতে রক্ত হীম হয়ে গেল। ’আগে বলতে ভয় লাগছিল যদি রাজি না হও। কিন্তু এখন বলতে দ্বিধা নেই, অনেক উচ্চতায় উঠতে যাচ্ছি আমরা। এমন উচ্চতায় যেখান হতে ঈশ্বরের সাথে কথা বলা যায়, হাত বাড়ালে ধরা যায় খন্ড খন্ড মেঘ’। তলপেট মোচর দিয়ে উঠল অজানা আশঙ্কায়।
- চলবে।