হতে পারে প্রধানমন্ত্রীর নিউ ইয়র্ক সফর আলোকিত করেছে বাংলাদেশের নাম, অথবা বিক্রি করেছে কর্পোরেট দুনিয়ার কাছে (এমনটাই দাবি করবে বিরোধী দল)। আন্দালনের মাধ্যমে খালেদা জিয়া হয়ত পুনঃ ক্রয় করে নেবেন বিক্রীত দেশ। ক্রয় বিক্রয়ের গ্যাঁড়াকলে বাংলাদেশ নামের একটা দেশ কতবার হাতবদল হয়ছে তার হিসাব স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাও রাখেন কিনা সন্দেহ আছে। তৃতীয় বিশ্বের লুটেরা গণতন্ত্রকে ভালবাসতে চাইলে আমাদের মেনে নিতে হবে বাংলাদেশ নামের একটা দেশ কেনাবেচার লাভজনক পণ্য। এবং তা পৃথিবীর বিভিন্ন পুঁজিবাজারে বিক্রি হচ্ছে চড়ামূল্যে। দেশ নিয়ে রাজনীতিবিদ্দের এই পুরানো বানিজ্য আমাদের জন্যে নতুন কোন চমক নয়। তাদের জন্যে এ হচ্ছে বেচে থাকার প্রয়োজনীয় অক্সিজেন। আমার মত বাবুর হাটের পান-তামুক খাওয়া স্বদেশীর কাছে দেশের মালিকানা ব্যাপারটা আদার বেপারীর জাহাজের খবর নেয়ার মত মনে হলেও যে খবরটা এমন খবর নয় তা হল গতকাল ঘটে যাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ঘটনা।
বিশ্ববিদ্যালয় শহিদুল্লাহ হল শাখার ছাত্রলীগ সভাপতি শাহরিয়ার আজম মুন্নার নির্দেশে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ৫০ জন ছাত্রকে সাড়া রাত ধরে খোলা আকাশের নীচে আটকে রাখা হয়। তাদের অপরাধ প্রতিশ্রুতি দিয়েও প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে এয়ারপোর্ট যায়নি। রাত সাড়ে দশটার দিকে ১০ মিনিট সময় দিয়ে রুম খালি করতে বাধ্য করে এসব ছাত্রদের। সকাল পর্যন্ত মুন্নার সহযোগীরা খোলা আকাশের নীচে ঘেরাও করে রাখে, যার কারণে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি অনেকে।
বাংলাদেশী ইতিহাসের সাথে যাদের পরিচয় নেই তাদের হয়ত বুঝতে অসুবিধা হবে এসব কথাবার্তা। রাজনীতি বুঝি আর না বুঝি, এটা বুঝতে অসুবিধা হয়না এ মঞ্চে চর দখলের মত বিশ্ববিদ্যালয় দখল কেন এতটা জরুরী। আমাদের দেশটাই এ রকম। এখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চর্চা হয় হাতিয়ার তত্ত্ব, গণতন্ত্রের উঠানে অনুষ্ঠিত হয় পরিবারতন্ত্রের ওরস মাহফিল। আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র, ইতিহাস, ভূগোল, পৌরনীতি, সবকিছুকে আগলে রাখার দায়িত্বে থাকতে হয় ছাত্রদের। উচ্চমাধ্যমিক পাশ, মা-বাবার মাসিক মাসোহারার উপর নির্ভরশীল ১৭/১৮ বছরের একজন যুবককে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেই লাভ করতে হয় গণতন্ত্র, সমাজতত্ত্ব, অর্থনীতি, ধর্ম, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, রাজাকার তত্ত্ব সহ তাবৎ ভাল-মন্দের নবুয়ত। মরহুম নেতাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে ছাত্রদের নামতে হয় সঠিক ইতিহাস প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে, গণতন্ত্র নিশ্চিত করার যুদ্ধে, রাজাকার নিধনের ঐতিহাসিক দায়িত্বে। এ ধরণের বহুমুখী ফ্রন্টে যুদ্ধ চালাতে প্রয়োজন হয় পুঁজির। স্বভাবতই পুঁজির যোগাড়ে ছাত্রদের নামতে হয় চাঁদাবাজী, ব্ল্যাকমেইলিং, হত্যা, ধর্ষণের মত 'পবিত্র' কাজে। বাংলাদেশের তাবৎ ব্যবসা বানিজ্য ছাড়াও কমিশনের ধান্ধায় ছাত্রদের ঢু মারতে হয় পতিতালয় পর্য্যন্ত। এমন মহানুভবতার ছাইভস্ম হতেই জন্ম নেয় আমানুল্লাহ আমানের মত নতুন এক 'মহামানবের', যার উত্থানে বাংলাদেশ আলোকিত হয়, আলোকিত হয় তার শিক্ষা ব্যবস্থা, ধন্য হয় ছাত্রজীবন, ধন্য হয় জাতীয় রাজনীতি।
এই একটা সত্য হজম করতে আমার কেন জানি কষ্ট হয়, বাংলাদেশী শিক্ষাঙ্গনে নেতা/নেত্রীর সন্তানাদির অনুপস্থিতি। এক নেত্রীর সুপার ট্যালেন্টেড সন্তান সুদূর মার্কিন মুলুকে লেখাপড়া শেষে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক হিসাবে। অন্য নেত্রীর দুই সন্তান আদৌ লেখাপড়া করেছেন কিনা কেউ বলতে পারে না। শোনা যায় জাতীয়তাবাদের অকুতোভয় সৈনিক জেনারেল নাজমুল হুদার দুই কন্যাসন্তান লন্ডনে লেখাপড়া করছেন মাসে ২০ লাখ টাকা খরচ করে। বাবুরহাটীয় রক্ত পানি করা অর্থে সন্তানাদি বিদেশ পাঠানো বাংলাদেশের বাস্তবতায় অকল্পনীয় ও অবাস্তব, যার কারণে একজন কৃষক তার সমস্ত সম্পদ বাজি রেখে সন্তানকে স্থানীয় স্কুল কলেজে পাঠায় নতুন দিনের আশায়। নতুন দিন আসে ঠিকই, তবে সে দিন হয় হতাশার, আশা ভঙ্গের।
ছাত্রদের কাজ লেখাপড়া, পৃথিবীর দেশে দেশে এ প্রতিষ্ঠিত সত্য। পৃথিবীতে দ্বিতীয় এমন দেশ নেই যেখানে জাতীয় রাজনীতির হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহ্রত হয় ছাত্রদের শিক্ষা জীবন। নেত্রীরা দেশ বিক্রী করে পারিবারিক পিকনিক করবেন তাতে জাতির বিশেষ কোন আপত্তি আছে বলে মনে হয়না। পথে পথে কাটা বিছিয়ে দেশ বিক্রী কণ্টকাকীর্ণ করলেও কেউ গোস্ব করবে বলে মনে হয়না। কিন্তু জাতির মেরুদন্ড শিক্ষাকে পংগু করে দিনের পর দিন নেত্রী পূজার বলি দিতে হবে এমন একটা সত্য মেনে নিতে সত্যি কষ্ট হয়।