আজ বিশ্ব প্রবীন দিবস। এমন একটা দিবস ঘটা করে কোথাও পালন হয় কিনা জানা নেই। বাংলাদেশে তো প্রশ্নই আসে না। কাগজে কলমে এমন একটা দিবস সত্যি সত্যি আছে এবং তা নীরবে এসে নীরবেই ঠাঁই নেয় পরিত্যাক্তের তালিকায়। এ নিয়ে কোথাও কোন সভা-সমিতি হয়েছে বলে শোনা যায়না। ভ্যালেন্টাইন দিবসের মত ফুল আর কার্ডে প্রবীনদের ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে এমন ঘটনারও কোন স্বাক্ষী নেই। দিনটা দিয়ে দেশের দু একটা দৈনিক লেখালেখি না করলেই আমরা বোধহয় জানতেই পারতাম না দিনটার অস্তিত্ব। ধন্যবাদ দৈনিক ইত্তেফাককে।
গাজীপুরে মনিপুর বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে একটা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে আজকের ইত্তেফাকে। পারিবারিক যুদ্ধে পরাজিত এক সৈনিকের কাহিনী নিয়ে এ প্রতিবেদন। কোথাও কোন বাধা না থাকলে ঘটনাটা যে কারও হূদয় ছুয়ে যাবে। ক্ষণিকের জন্যে হলেও নিয়ে যাবে নিজ পরিবারে। সেনা কর্মকর্তার একমাত্র সন্তানের বয়স যখন ৫মাস মারা যান তার মা। কলিজার টুকরা একমাত্র পুত্রের দিকে তাকিয়ে দাম্পত্য জীবনের সবটাই বিসর্জন দেন এ সৈনিক। দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। চাকরীর পাশাপাশি পুত্রকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে মানুষের মত মানুষ করার সিদ্ধান্ত নেন। এমনটাই নাকি ছিল মৃত মায়ের শেষ ইচ্ছা। পিতা নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে পুত্রকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেন। পুত্র লেখাপড়া শেষে ব্যবসা শুরু করেন। রপ্তানীমুখী গার্মেন্টস শিল্পে সফলতা আসে। পুত্রের সফলতায় বুক ফুলে উঠে গর্বিত পিতার। এবার পিতৃ দায়িত্বের শেষ অধ্যায় সমাধার লক্ষ্যে পুত্রের জন্যে খুঁজতে থাকেন সুন্দরী পাত্রী। এমন পাত্রী পেয়ে পুত্রকে ধুমধাম করে বিয়ে করান। বিপত্তির শুরু এখানেই। বিয়ের কিছুদিন না যেতেই শুরু হয় সুন্দরী পুত্রবধূর মানসিক নির্যাতন, নিপীড়ন ও লাঞ্ছনা। পুত্র নিজেও পরাজিত হয় তেজস্বী স্ত্রীর দাপটের কাছে। বিবিসি রেডিও শুনতে গিয়ে পিতা সন্ধান পান গাজীপুর আশ্রমের। একজন সৈনিকের অভিধানে পরাজয় শব্দটা বোধহয় সহজলভ্য হয়না, হোক তা আপন সন্তানের কাছে। এই সৈনিকও পরাজয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে। কাউকে না জানিয়ে চলে যায় গাজিপুর বৃদ্ধাশ্রমে এবং সিদ্ধান্ত নেয় বাকি জীবনটা ওখানে কাটিয়ে দেয়ার। অনেক খোঁজাখুঁজির পর পুত্র সন্ধান পায় পিতার। শিল্পপতি পুত্র দামী গাড়ি হাকিয়ে হাজির হন আশ্রমে। ঘটনার বাকি অংশ পত্রিকা হতে তুলে দিলামঃ
অতিথি কক্ষে শিল্পপতি পুত্র সকাল ১০টায় গিয়ে বসেন। পিতাও একমাত্র পুত্রকে নিজ কক্ষ হতে দেখতে পেয়ে বের হয়ে বারান্দায় হাঁটাহাটি শুরু করেন। পুত্র দেখে খুশিতে দিশেহারা। তবু পিতা স্বেচ্ছায় পুত্রের কাছে হাজির হননি। পুত্র পিতার কাছে এসে আব্বু তুমি কেমন আছো বলেননি কিংবা কুশল জিজ্ঞেস করেননি। একজন অপরজনের দিকে তাকান। পিতা সন্ধ্যা পর্যন্ত কক্ষের বাইরে পায়চারি করেছেন। তবু পুত্রের কাছে জাননি এবং পুত্রও আসেনি পিতার কাছে। এভাবে বেলা গড়িয়ে সন্ধা নামে। শেষ হয়ে যায় সাক্ষাতের সময়। এ কারণে পিতার সাথে কোন কথা না বলেই ফিরে আসতে হল পুত্রকে। একমাত্র পুত্র চলে যাওয়ার ২৪ ঘন্টা পর পিতা হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বৃদ্ধাশ্রমের কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। শিল্পপতি পুত্র জানেন তার পিতা মিষ্টি পছন্দ করেন। সপ্তাহ খানেক পর ১০ কেজি নানান ধরনের মিষ্টি নিয়ে আবারও হাজির হন বৃদ্ধাশ্রমে। কিন্তু এসে তিনি জানতে পারেন, তাঁর পিতা আর বেঁচে নেই। এই কথা শুনে শিল্পপতি পুত্র বৃদ্ধাশ্রমের মাঠে পড়ে আব্বু আব্বু বলে বুকফাটা কান্না করতে থাকেন। বিকাল পর্যন্ত এই মাঠে গড়াগড়ি করেন।
এর পরের কাহিনী খুব সাদা মাঠা। ধনী সন্তান পিতার মাজার পাকা করার আবেদন জানান কর্তৃপক্ষের কাছে। প্রস্তাব করেন আর্থিক সাহায্যের। আশ্রমের খতিব দুটো আবেদনই প্রত্যাখান করেন। আশ্রমে কবর বাধানোর রেওয়াজ নেই এবং নিজের পয়সায়ই যথেষ্ট তা চালানোর জন্যে, এমন দাবির কাছে পাত্তা পায়নি শিল্পপতির আবেদন। শুধু চেহলাম করার সুযোগ দেয়া হয়েছিল এবং আশ্রমের অন্যান্য বৃদ্ধদের অনুরোধে ৪০ গজ কাফনের কাপড় গ্রহন করেছিল খতীব আবদুল জাহিদ।
পাঠক, এ কাহিনী কি শুধু অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা পরিবারের বিচ্ছিন্ন কাহিনী? বাংলাদেশের অনেক ঘরে যেখানে সম্পদ আর জৌলুস একসাথে গড়াগড়ি খায় সেখানে কি নিয়মিত ঘটছেনা এসব হৃদয়বিদারক ঘটনা ? মধ্যবিত্ত পরিবারের শত বর্ষের সম্পর্কে ধ্বস নামাতে এমন একজনই যথেষ্ট যার আছে তথাকথিত সুন্দরীর স্বীকৃতি। স্বামীকে পিতা-মাতার বিরুদ্ধে নামিয়ে পরিবারে এমন এক অস্বস্তিকর অবস্থার তৈরী করে যা সামাল দেয়ার মত বিদ্যা, বুদ্ধি এবং কৌশল অনেক কিছুই লোপ পায় যৌথ পরিবারে বেড়ে উঠা পুরুষদের। এভাবে শুধু একজনের কারণে পরিবারে বাজতে থাকে অশান্তির দামামা, মৃত্যু ঘটে মধ্যবিত্ত পরিবারে আজন্ম লালিত স্বপ্ন। অনেকে বলবেন চাঁদেরও তো অন্যপীঠ আছে। সেখানেও বর্ষিত হয় অনেক অশ্রু। হয়ত সত্য। তবে বাস্তবতা হল আমাদের সবাইকে একদিন না একদিন পাড়ি জমাতে হয় মাতৃত্ব আর পিতৃত্বের রাজ্যে। যে কাহিনীর জন্ম দিয়ে শিল্পপতির স্ত্রী তার শ্বশুরকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়েছিল হয়ত একদিন একই কাহিনী ফিরে আসবে তার জীবনে। এই সামান্য সত্যটুকু মনে রাখলে পরিবারের ছোটখাট অনেক সমস্যা হয়ত সমস্যা থাকে না যার কারণে একজন পিতাকে আশ্রয় নিতে হয় বৃদ্ধাশ্রমে। বাইরে না হোক অন্তত নিজ ঘর হতে শুরু করতে পারি প্রবীনদের সন্মান দেখানো। এটাই হোক এবারের প্রবীন দিবসের দাবি।