প্রকৃতিতে এখন বিদায় লগ্ন। অলিন্দ হইতে বসন্ত আর গ্রীষ্মের শেষ চিহ্ন টুকু মুছিয়া যাইতেছে। রৌদ্রের প্রখর উজানে লাগিয়াছে ভাটির ছাপ। অন্তরে এখন বিষণ্নতার নবম সিম্ফোনী বাজিবার কথা। অথচ কি আশ্চর্য, কিছুই হইতেছে না। বরং উপভোগ করিতেছি বিদায় নামের এই ভাংগা গড়ার খেলা। দশটা বছর আগে এমনটা হইলে বড়ই অবাক হইতাম। ভাবিতাম হূদয়ের কিবোর্ডে গোলমাল দেখা দিয়াছে, অন্তরের ষ্ট্রীং গুলা ঢিলা হইয়া গিয়াছে। অন্য সময় এখন। অতি পরিচিত থ্রী ডাইমেনশনাল পৃথিবীতে সংযোজিত হইয়াছে চতুর্থ ডাইমেনশন, ভার্চুয়াল ডাইমেনশন। হইতে পারে এই জন্যেই অন্তরে ৯০ ডিগ্রী পরিবর্তন। উপভোগ করিতেছি নতুন দুনিয়ার সীমাহীন সম্ভাবনা। ধন্য মনে হইতেছে জীবন। সার্থক হইতেছে বাঁচিয়া থাকা।
সহি সেলামতে আছি বলিয়াই হয়ত ব্লগিং করিতেছি। তাও আবার মনের আনন্দে। কয়েকটা বছর আগেও কি ইহা ভাবা যাইত? একবার ঈদের নামাজে ইমাম আর মুয়াজ্জিনের চাঁদা উঠানো লইয়্যা ফ্যাকড়া বাধিয়া গেলে উঁচু গলায় প্রতিবাদ করি। কোথা হইতে কি ঘটিল ইহা বুঝিবার আগে দুই পক্ষ এক হইয়্যা আমাকে বিতাড়িত করিল। এত জোরে নাকি চীৎকার করিতে নাই সৃষ্টিকর্তার ঘরে। ইহাতে ধর্মের অবমাননা হয়, নবীর অপমান হয়, পীর আউলিয়ারা অসন্তুষ্ট হন। ঈদের জমায়েত হইতে সেই যে বিদায় লওয়া আর ফিরিতে পারি নাই পরিচিত ভুবনে। ইহা লইয়্যা প্রতিবাদ করিবার ম্যালা বিষয় ছিল, বলিবার মত রাজ্যের কথা ছিল। কিন্তু কিছুই বলিতে পারি নাই নানাহ কারণে। ভার্চুয়াল দুনিয়ার এই এক সুবিধা, এইখানে সবকিছু বলা যায় এবং তা ২৪/৭। প্রতিবাদের কারণে এত সহজে কেহ কাহাকেও বিদায় করিতে পারে না। সীমাহীন দুনিয়া এইটা। এর কোন বর্ডার নাই। আসা যাওয়া করিতে এইখানে পাসপোর্ট ভিসারও প্রয়োজন হয়না। মেগা আর গিগা বাইটের সীমাবদ্ধতা থাকিলেও সীমা পাহারা দিতে চৌকিদারের প্রয়োজন হয়না। বড়ই সুখে আছি নতুন ডাইমেনশনে। আন্টিল নাউ।
খারাপ সংবাদ হইল এই জগতেও নাকি তেলেসমাতি শুরু হইয়াছে। দূর দেশের জনৈক চে গুয়েভারাকে লইয়া ভার্চুয়াল দুনিয়ার বিশেষ অংশে নাকি তুলকালাম চলিতেছে। যে বিপ্লবের ডাক দিয়া এই ব্যক্তি মহানের খাতায় নাম লিখাইয়াছিলেন উহা হইতে সরিয়া মানুষ এখন ব্যক্তি ’চে কে লইয়্যা মাতম করিতেছ। কবিতা লিখিতেছে। তাহার ছবি সাটিয়া টি-শার্ট বানাইতেছে। জাঙ্গিয়া বানাইয়া অনেকে আব্রু ঢাকিতেছে। সত্যি হইলে ইহা হইবে বড়ই কষ্টের। তবে একটা বাস্তবতা ভাবিয়া অন্তরে উপশম বোধ করিতেছি। একজন চে গুয়েভারা লইয়া মাতামাতি বিশাল এই ভার্চুয়াল মহাসমুদ্রে একফোঁটা পানি মাত্র। ইহাতে কাহারও বিশেষ কোন ক্ষতি হইবে বলিয়া মনে হইতেছে না। ইহা যদি ’চের জন্মদিন পালনের ব্যাপার হয়, বলিতে বাধ্য হইতেছি এইখানে কেউ ৫ টনি কেক কাটিবে না, কেহ চুলাচুলি করিবে না, রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম সৃষ্টি করিবে না। ক্ষতি কি চে’র নামে ভার্চুয়াল দুনিয়ায় কিছুটা মাতামাতি হইলে?
একটা সময় ছিল যখন চে গুয়েভারা, কার্ল মার্ক্স, ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস আর ভ্লাদিমির উলিয়ানভের নাম শুনিলে অন্তরের অন্তস্তলে তরঙ্গ বহিয়া যাইত। কলিকাতার বাবুদের কিতাব পড়িলে চারু মজুমদারের শিষ্য হইতে ইচ্ছা করিত। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। ঐ সব কিছুই হইতে পারি নাই। কিন্তু যাহা হইয়াছি উহাই বা কম কিসে! না হইতে পারি চে গুয়েভারার সাথী, কিন্তু তাহার যে বানী এক সময় আন্দেলিত করিয়াছিল উহা কি মানুষ হইতে সাহায্য করে নাই? ’চের জন্মদিন পালন করিতে বিপ্লবের পূজারী হইতে হইবে, এমনটাই বা কেন?
সময় কখনো পশ্চাদ গামী হয়না। এর যাত্রা কেবলই সম্মুখ পানে। আরব দেশে এক সময় মেয়ে মানুষ জন্ম হইলে জ্যান্ত কবর দেওয়া হইত। সেই দেশে নবীরা জন্মাইলেন। ধর্ম প্রচার করিলেন। মানুষের হেদায়েত করিলেন। সময়ের প্রয়োজনের মহিলাদের সাত পর্দায় আটকাইলেন। সভ্যতা আগাইয়া গেল। আরবরাও বাহির হইল জ্যান্ত কবর দেওয়া সাংস্কৃতি হইতে। সভ্যতার বিবর্তনে মানুষ আজ এমন উচ্চতা জয় করিয়াছে যেইখানে মহিলাদের সাত পর্দায় আটকাইবার প্রয়োজন হয়না। তাই বলিয়া আমরা কি আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাইব ধর্মকে? সমাজতন্ত্রী ভাবধারা আগমনেরও একটা প্রেক্ষাপট ছিল, হেতু ছিল। শ্রমের সহিত শ্রমজীবির সম্পর্কের অলিগলিতে জন্ম লইয়াছিল সমবন্টনের ভাবধারা। আঠার ঘন্টা কাজ, অপ্রতুল ভাতা, শাসন, শোষন, নীপিড়ন আর নির্যাতনের জাঁতাকলে খাটিয়া খাওয়া মানুষের নাভিশ্বাসে নির্মল বাতাস আনিতেই জন্ম হইয়াছিল চে গুয়েভারার মত বিপ্লবীদের। ধর্মকে যাহারা গতিহীন এবং অপরিবর্তনশীল আগমন হিসাবে আখ্যায়িত করিতে অভ্যস্ত তাহাদের সহিত দ্বিমত পোষন করি। আমার কাছে সমাজতন্ত্র ছিল ধর্ম, যাহার উত্তরসূরি হিসাবে জায়গা করিয়া লইয়াছে আজিকার মুক্তবাজার অর্থনীতি। আমেরিকার কর্তৃত্বাধীন গ্লোবাল অর্থনীতিকে সরাইয়া আগামীতেও জন্ম লইতে পারে নতুন তত্ত্ব, যাহাকে ধর্ম আখ্যায়িত করিতে বাধা দেখি না। সময়ের সহিত তাল মিলাইতে আমাদের চাহিদারও পরিবর্তন হয়। আর পরিবর্তনের অপর নামই বোধহয় বিবর্তন। একজন শ্রমজীবিকে ১৮ ঘন্টা খাটাইবার কালচার এখন অতীত। চাহিলে সে নিজেও এখন মালিক হইতে পারিবে তাহার কর্মক্ষেত্রের। ইহার জন্যে রহিয়াছে পুঁজিবাজার। বিবর্তনের সহিত তাল মিলাইতে অক্ষম ব্যক্তিদের ভ্রুনেই জন্ম নেয় ওসামা বিন লাদেনের মত ’বিপ্লবী’। চে গুয়েভারার সহিত ’বিপ্লবী’ ওসামার এইখানেই পার্থক্য। একজন সময়ের চাহিদা মিটাইতে আর অন্যজন অতীতে ফিরিয়া যাওয়া জন্যে বিপ্লবী হইয়াছিলেন বা হইয়াছেন। যুক্তিবিদ্যার আশ্রয় নিলে অবশ্য ওসমাকেও বিপ্লবী বলায় কোন বাধা দেখিতেছি না। মানুষ এবং গরু উভয়েই পানি করে, সুতরাং মানুষ =গরু। বিপ্লবীদের কাতারে চে আর ওসামাকে একসাথে দাঁড় করাইতে এমন যুক্তির বিকল্প যুক্তি খুঁজিয়া পাইতেছি না। আমেরিকার পাপে আমেরিকা শাস্তি পাইতেছে। কিন্তু এই পাপে বিন লাদেনকে বিপ্লবী বানাইবার খায়েশকে বলিতে হয় অসুস্থ খায়েশ। এই খায়েশ সভ্যতার বিবর্তনকে পশ্চাৎ দিকে টানিবে। সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টি করিবে।
গানটা আমার খুবই প্রিয়। সময় অসময়ে গুন গুন করিয়া গাহিবার চেষ্টা করি। মাঝে মধ্যে স্টিরিওতে গগনবিদারী শব্দে নিজের কানকে সন্তুষ্ট করিঃ
’দয়াল বাবা কেবলা কাবা
আয়নার কারিগর
আয়না বস্যাইয়া দেয়
মোর কলঙ্কের ভিতর’
আসলেই যদি এমন একজন কারিগরের দেখা পাইতাম, যে কিনা কলঙ্কের ভিতর আয়না বসায়ইয়া দিতে পারিত! আমরা আমাদের নিজের কলংক গুলি দেখিতে পাইলে কতই না ভাল হইত। হয়ত বদলাইয়া যাইত জাতি হিসাবে আমাদের অবক্ষয়ের মাত্রা। সার্থক হইত আমাদের বাঁচিয়া থাকা। চে আর ওসমা বিপ্লব হইতে দূরে সরিয়া হয়ত বিপ্লব করিতে সক্ষম হইতাম নিজ ভুবনে। হউক তা ভার্চুয়াল ভুবন।